Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

দেবতার ঘরে তিনটি দিন

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। লিখেছেন অজন্তা সিনহা

গিরিডি তখনও বিহারের মধ্যে । বিহার-ঝাড়খন্ড ভাগাভাগি হয়নি। গিরিডি তখন বাঙালির স্বাস্থ্য উদ্ধারের প্রিয় জায়গা। সেখানকার জল-হাওয়ার  গুণ এমন যে, কঠিন অসুখ সেরে যাওয়ার পর ডাক্তাররাও বিশ্রামের জন্য ওদিকটায় যাওয়ারই পরামর্শ দিতেন। আমাদের পরিবারের একটা বড় অংশ দীর্ঘদিন গিরিডিবাসী। তাই শৈশবে মাঝে মাঝেই যাওয়া হতো সেখানে। গিরিডির সঙ্গেই সেসময় শোনা যেত মধুপুর ও দেওঘরের নাম। স্বাস্থ্যকর জল-হাওয়া ছাড়াও এই অঞ্চলের প্রতি বাঙালির আকর্ষণের অন্য কারণ ছিল এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। উঁচুনিচু টিলা, নদী, জঙ্গল–সব মিলিয়ে নয়নাভিরাম ! প্রচুর প্রবাসী বাঙালির বসবাস তো ছিলই। বহুল পরিমানে পর্যটকও আসতেন।

গিরিডি বহুবার গেলেও দেওঘর যাওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে অনেক পরিণত বয়সে পৌঁছে দেওঘর যাওয়ার অভিজ্ঞতা হলো। দেওঘরের নাম আর একটি কারণেও জানা হয়ে গেছে ততদিনে–এখানেই রয়েছে বিখ্যাত বাবা বিশ্বনাথের মন্দির। দেবতার ঘর, সেই থেকেই নাম দেওঘর। অতি প্রাচীন এর ইতিহাস। উল্লেখ আছে পুরাণেও। চাকরিজীবনে ছুটির ওপর নির্ভর করে যাবতীয় ভ্রমণ পরিকল্পনা করতে হয়। সেবার পয়লা বৈশাখের ছুটিটা এমন ভাবেই পড়েছিল। একটা দিন ছুটি নিলেই কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে আসা যাবে। কোথায় যাব ভাবছি ! আমার এক পরিচিত ভাইয়ের সঙ্গে কথায় কথায় উঠে এলো দেওঘরের নাম। আমার হারানো শৈশব যেন ডাক দিলো। তাহলে এবার দেওঘরেই যাওয়া যাক। ট্রেনের টিকিট কেটে এক সকালে উঠে বসলাম হাওড়া-নিউ দিল্লী দুরন্ত এক্সপ্রেসে। এ ট্রেন জসিডি পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে গাড়ি বা অটো রিকশ করে দেওঘর। থাকার বুকিং হয়েছে যোগানন্দ সৎসঙ্গ আশ্রমের গেস্ট হাউসে । ব্যাবস্থা সেই ভাইটিই করে দিয়েছে।

যথা সময়ে ট্রেন জসিডি স্টেশনে পৌঁছে গেল। আর নেমেই একেবারে তপ্ত কটাহে ঝাঁপ। তবে, বাতাসে আর্দ্রতা নেই। ঝাড়খণ্ডের মানুষজন দেখলাম খুবই বন্ধুবৎসল। একটি দোকানে গিয়ে অটো স্ট্যান্ডের খোঁজ করতেই দোকানের মালিক দেখিয়ে দিলেন। আগেই জানা ছিল, খুব দূরের রাস্তা নয় দেওঘর। আর রাস্তাও খুব ভালো। অটোচালক ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে দিব্যি চললাম। গরম হাওয়ার হলকা আটকাতে অটোর দুপাশ ঢেকে দিতে চেয়েছিল সে। আমি বললাম, লাগুক গরম, পথের দুপাশ না দেখলে পথে নামার মানে কি? ঠিক হলো সন্ধ্যায় সে-ই আমায় কাছাকাছি অবস্থিত নওলাখা মন্দিরে নিয়ে যাবে। অটো কিছুটা পথ চললো বাজার অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে। এখন এই পুরো এলাকাটাই ঝাড়খন্ড। এমনিতে বিহার-ঝাড়খণ্ডের জীবন সংস্কৃতিতে তেমন কিছু ফারাক নেই। না থাকাই স্বাভাবিক। সমাজজীবন গড়ে ওঠার পিছনে ভৌগোলিক গুরুত্ব অসীম। বেড়া দিয়ে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করা যায়। কিন্তু প্রকৃতি তো  বিভাজনের পথে হাঁটে না। আর এই কারণেই দেখলাম এই এলাকার মানুষের জীবনযাপনে বড় কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। বাজার ছাড়াতেই দুদিকের দৃশ্যপট বদলে গেল। শান্ত, নির্জন প্রকৃতি। গাছপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু এদিকওদিক। খালবিল আপাতত প্রায় শুকনো। দূরে কয়েকটি টিলা। ওপরে খোলা আকাশ। পিচের রাস্তা চলে গেছে তার নিচ দিয়ে। পথের মাঝে মাঝে বাঁক, অটো ঘুরছে সেই মতোই।  যেতে যেতে হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলছে ড্রাইভার ভাই। রাস্তা আগের থেকে অনেক ভালো হয়েছে বলে খুশি সে। তবে যে পরিমান গাছ কাটা পড়েছে তাতে, তার সিকিভাগও লাগানো হয়নি, এটা একটা বড় আক্ষেপ। এছাড়া জঙ্গল কেটে সাফ করার যে চোরাকারবার চক্র, তা এখানেও সক্রিয়। সাধারণ মানুষকে সারা দেশেই ক্ষমতায় থাকা লোকজন গুরুত্ব দেয় না বললেই চলে। পাঁচ বছরে একবার ভোট দেওয়া ছাড়া তারা প্রায় গুরুত্বহীন। অথচ অধিকাংশ সাধারণ মানুষই কিন্তু সমাজ সচেতন। বিশেষত প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতিকে এখনও যথেষ্ট মূল্য দেয়।

আশ্রম ও তার লাগোয়া অতিথিনিবাস দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। প্রচুর গাছগাছালি, ফুলের বাগান, পরিচ্ছন্নতা সর্বত্র। সিমেন্টের ঘরগুলি প্রাচীন ধরণের। চওড়া দেওয়াল। লাল সিমেন্টের মেঝে। সেখানেও পরিচ্ছন্নতা বিদ্যমান। সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করে টাকাপয়সা জমা দিয়ে নির্ধারিত ঘরে গেলাম। সাদামাটা ঘর। কিন্তু খুব পরিচ্ছন্ন সব ব্যাবস্থা। ওই মুহূর্তে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের আরাম পেয়ে সবচেয়ে তৃপ্ত হলাম। বাইরে সূর্যদেব গনগন করছেন। বড় বড় জানালাগুলি এখন বন্ধ। মালবাহক ছেলেটি বললো, বিকেলে খুলে দিলে বাগানের ফুল দেখা যাবে, গন্ধও আসবে ভাসা বাতাসে। খাবারের আয়োজন পাশের বিল্ডিংয়ে, জানিয়ে চলে যায় সে। দ্রুত স্নান করে, পাশের বিল্ডিংয়ে গেলাম। এলাহী বন্দোবস্ত এবং অতি সুশৃঙ্খল। বহু মানুষ একসঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু কোলাহল নেই। আগত অতিথিরা অনেকেই খাবারের অপেক্ষায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটক আসে দেওঘরে। নানা ভাষার এক ককটেল কানে আসছিল। ভিতরে পাশাপাশি রান্নার জায়গা ও খাওয়ার জন্য বেঞ্চ ও টেবিল পাতা। মাটিতে আসন পেতে বসার ব্যবস্থাও আছে। নিয়ম অনুযায়ী সকলকেই ঢুকতে হবে জুতো খুলে। প্রত্যেকটি কর্মী অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। পরিচ্ছন্নতা সর্বত্র। বাসনকোসন থেকে শাকসবজি ও মশলাপাতি। কুপন কিনে নিতে হবে প্রথমেই। তারপর খেতে বসা। শালপাতার প্লেট আর মাটির গ্লাস। নিরামিষ খেতে হবে আগেই জানতাম। এও শুনেছিলাম আমার ওই দেওঘরের খবরদাতা ভাইটির কাছে, যে, এখানকার প্রতিটি রান্না এতই উপাদেয় যে আমি নাকি আমিষ না খাওয়ার দুঃখ ভুলে যাব। কথাটি সর্বৈব সত্য। এমন স্বাদু রান্না হলে তো আজীবন নিরামিষ খাওয়া যায়। ভাত, ডাল, শুক্তো, ভাজা, সবজির দুটি পদ, চাটনি, দই। সত্যি কথা বলতে কী, আজও মুখে লেগে আছে দেওঘরের সেই আশ্রমের রান্নার স্বাদ।

Img 9 1663227320574
দেবতার ঘরে তিনটি দিন 26

একটা নিপাট ঘুম দিয়ে উঠে দেখি বিকেল গড়াচ্ছে। খবর পেলাম সেই অটো ড্রাইভার এসে গেছে। তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে চললাম নওলাখা মন্দিরে। কলকাতার বিখ্যাত পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ির রানী চারুশীলা দেবী প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির নির্মাণে খরচ হয়েছিল নয় লক্ষ টাকা। সেকালের পক্ষে অঙ্কটা কত ভাবুন একবার ! যাই হোক ওই অঙ্ক থেকেই নাম নওলাখা মন্দির। রানী রাধাকৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন। ১৯৪০-এ প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরে অধিষ্ঠিত রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি বড় সুন্দর। দেখে আমার মতো অধার্মিকও মুগ্ধ। কথিত আছে স্বামী ও ছেলেকে চিরকালের মতো হারিয়ে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত চারুশীলা দেবী গুরু বালানন্দ ব্রহ্মচারীর সংস্পর্শে আসেন। তাঁরই পরামর্শে এই মন্দির স্থাপনা ও শান্তিলাভ। মন্দিরটি আজও অতি যত্নে রক্ষনাবেক্ষণ করা হচ্ছে। বহু দূর থেকে ভক্ত ও পর্যটকদের আগমন হয়। স্থাপত্যকলার সুন্দর নিদর্শন মেলে, ডিজাইনে বেলুর মঠের আদল। হালকা লাল রঙের দেওয়াল। দারোয়ানের কাছে জুতো জমা রেখে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠা প্রথমে। তারপর একটি বিশাল সভাঘর পার হয়ে আর একটি কক্ষে রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহের অধিষ্ঠান। সন্ধ্যাপূজার আয়োজন চলছে দেখলাম। মন্দির ঘুরে দেখতে দেখতেই চোখ গেল আকাশে। দাঁড়িয়েছিলাম মন্দিরের অলিন্দে। সেখানে তখন এক অনির্বচনীয় ছবি আঁকা হচ্ছে। পশ্চিম আকাশে লাল রঙ ঢেলে সূর্যদেব ডুবছেন। আর ঠিক উল্টোদিকে মায়াবী চাঁদ উঠছে। প্রকৃতির এটাই কান্ড, যে কোনও মুহূর্তে ম্যাজিক দেখাতে পারে।

ফিরে এসে আশ্রমের ভিতরে যে মন্দির, সেখানে সন্ধ্যারতি দেখলাম। বাইরে শান্ত, সমাহিত পরিবেশ। বাগানে ফুলের দল গন্ধ ঢেলেছে। জোৎস্না মেখে নিয়েছে আকাশ। ইতস্তত ছড়িয়ে মানুষ। কিছুটা ঘোরাঘুরি আশ্রমের মধ্যেই। ঘরে ফিরে গল্পের বইয়ের পাতা উল্টানো। বাইরে থেমে যাচ্ছে শব্দরা। রাতের খাওয়া গেস্টহাউস সংলগ্ন ডাইনিং রুমে। এখানে শুধু গেস্টহাউসের অতিথিদের খাওয়ার ব্যাবস্থা। প্রাতরাশও এখানেই। ঘুম ভাঙলো মন্দিরের প্রভাতী পুজোর ঘন্টাধ্বনিতে। বাইরে আসতেই ফুলের শোভা। কাল তেমন দেখার সুযোগ হয়নি। হেঁটে হেঁটে পুরোটা দেখতে অনেকটা সময় লাগলো। এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। ধর্ম যখন কর্মের পথ ধরে চলে, তখন সত্যি সেটা কুর্নিশযোগ্য হয়। ফুলের বাগান, শাকসবজির চাষ, বিদ্যালয়, লাইব্রেরি সব মিলিয়ে প্রচুর কাজ। সুনিয়ন্ত্রিত ও সুসংগঠিত। আর সবেতেই উপকৃত হচ্ছেন অগণিত সাধারণ মানুষ। ভালো লাগার রেশ নিয়েই প্রাতরাশ খেলাম। খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম তপোবন ও ত্রিকূট পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। কাল বিকেলেই অটো ড্রাইভার ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। সেই মতোই চলে এসেছে সে আমায় নিয়ে যেতে।

Img 13 1651379111920
দেবতার ঘরে তিনটি দিন 29

আশ্রম থেকে বের হয়ে পিচের রাস্তা ধরে আমাদের অটো। দু’পাশে খোলা প্রান্তর, তালগাছের সারি, মাঝে মাঝে প্রাচীন বট, অশ্বত্থ, ইতস্তত জঙ্গল ফেলে এগিয়ে চলেছি। সকালের ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। দেওঘর থেকে তপোবন, তপোবন থেকে ত্রিকূট পাহাড়, সেখান থেকে আবার দেওঘর ফেরা। ঠিক কোথায়, আজ আর মনে নেই–এই যাতায়াতের পথেই দেখেছিলাম এক অনির্বচনীয় দৃশ্য। দুধারে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ। লাল লাল ফুলে সূর্যের কিরণ পরে ঝলমল করছে। দেখা হয়েছিল ময়ূরাক্ষী নদীর সঙ্গেও। তার বুকের ওপর ব্রিজ, সেই ব্রিজের উপর দিয়েই পথ। কত কথা জমে থাকে নদীর বুকে। সেইসব না বলা কথা শুনতে শুনতে এগিয়ে চলি গন্তব্যের দিকে। অটো ড্রাইভার ছেলেটি বেশ ভালো। আশ্রমের অতিথিদের সঙ্গে এদিকওদিক গিয়ে বাংলাটাও দিব্যি বলতে শিখে গেছে। এখানে আসার পর থেকেই সে একাধারে আমার বাহক ও গাইডের ভূমিকা পালন করছে।

দেওঘর শহর থেকে তপোবনের দূরত্ব ১০ কিমি। ঝকঝকে পিচ বাঁধানো পথ দিয়ে পৌঁছে গেলাম তপোবন। ত্রিকূট পাহাড়ের তুলনায় এর উচ্চতা কম। পাহাড়, গুহাপথ, পাথরের খাড়াই ঢাল, পাথুরে সিঁড়ি–সব মিলিয়ে বড়ই দৃষ্টিনন্দন এই তপোবন। সেই প্রাচীন মুনিঋষিদের ধ্যানমগ্ন হয়ে জীবন অতিবাহিত করার যে ভাবনা, তার প্রতিফলন যেন আজও রয়েছে এখানে। তেমনই শান্ত, সমাহিত পরিবেশ। অটো ড্রাইভার আমায় পরিচয় করালো একজন পান্ডার সঙ্গে। ধর্মস্থানের কারবারীদের সম্পর্কে আমার ধারণাই বদলে দিয়েছিলেন এই মানুষটি। তপোবনের নিয়ম হলো, উঠতে হবে সিঁড়ি দিয়ে, নামা পাহাড়ের পাথুরে পথে। সে এক অসাধ্যসাধন ! মানে আমার মতো পৃথুলা, আনফিট মহিলাদের জন্য তো অবশ্যই।

প্রচুর (কয়েকশ হবে/গুনে উঠতে পারিনি) সিঁড়ি বেয়ে, গোপন কুঠুরির পথ দিয়ে, সে পথও একজন মোটা মানুষের পক্ষে পার করা অসম্ভব, আরও কি কি কান্ড করে মূল জায়গায় পৌঁছে আবার পাথুরে পথে নামা। সম্ভব করেছিলাম ভেবে আজও বিস্মিত হই। ওঠার সময় নিজের বৃহৎ শরীরটিকে সংকুচিত করে দুটি পাথরের মধ্য দিয়ে গলিপথ পার করা ছিল সর্বকালের সেরা চ্যালেঞ্জ। আর নামার সময় ধরার কিছু নেই, পড়লেই কয়েক হাজার ফুট নিচে এবং গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়া। এর কোনওটাই হলো না ওই হাড়পাঁজর বের করা পান্ডা ভদ্রলোকের জন্য। পরম মমতায় হাত ধরে নিরাপদ স্থানে নামতে সাহায্য করেছিলেন তিনি আমায়। আমার অসাধ্যসাধনের পুরো কৃতিত্ব আমি তাঁকেই দেব। এছাড়া তপোবনের দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা এখানকার হনুমানদের কান্ডকারখানা। সপরিবারে, সপ্রেমে, সবান্ধবে চারপাশে বিরাজিত তারা। ফলফলাদির কিছুটা তাদের না দিলে, বেশ রেগে যান তেনারা, সেটাও খেয়াল রাখার বিষয়।

Img 17 1644291772675
দেবতার ঘরে তিনটি দিন 32

এবার কিছুটা এখানকার পৌরাণিক কথা। অনেকটা উঁচু পাহাড়ের উপর শিবমন্দির, নাম তপোনাথ মহাদেব মন্দির। শিবলিঙ্গটির ইতিহাস অতি প্রাচীন, যেখানে পুরাণ ইতিহাস মিলেমিশে একাকার। কথিত আছে, স্বয়ং বাল্মীকি মুনি এসেছিলেন এখানে, প্রায়শ্চিত্তের লক্ষ্যে। অন্যদিকে আর একটি কাহিনি–রাবণরাজা এসেছিলেন তপোবনে, ধ্যানের উদ্দেশ্যে। তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য হনুমানকে পাঠান দেবতারা। রামভক্ত হনুমান সফল হয় রাবণের ধ্যানভঙ্গে। সে লাফ দিয়ে পাহাড়ের একটি অংশ ভেঙে দেয়। হনুমান মন্দির প্রতিষ্ঠিত সেই অনুষঙ্গেই। রাম-সীতার কাহিনিতে আছে এর উল্লেখ। ভাঙা অংশটি আজও দৃশ্যমান। ভগ্ন অংশটির মাঝে হনুমানের চিত্র অঙ্কিত। এখানকার মানুষের বিশ্বাস, এই চিত্র আপনা হতেই প্রোথিত পাথরের গায়ে, রামসীতার প্রতি হনুমানের ভক্তির দৃষ্টান্তস্বরূপ। ভক্তের বিশ্বাসের মধ্যে একটা আবেগ কাজ করে। তবে, অবিশ্বাসীরাও নিঃসন্দেহে বিস্মিত হবেন চমকপ্রদ এই চিত্রটি দেখে। কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে এই স্থানে অঙ্কন অসম্ভব ! এছাড়াও শোনা যায়, বালানন্দ ব্রহ্মচারীও সিদ্ধিলাভ করেন এখানে বসেই। সব মিলিয়ে ধর্ম ও পুরানের সুন্দর সমন্বয় ঘটেছে তপোবনে।

তপোবন থেকে ত্রিকূট পাহাড়। দেওঘর শহর থেকে দূরত্ব ১৫ কিমি। আমার মতো লোকের একদিনের পক্ষে একটা তপোবনই যথেষ্ট। ত্রিকূট পর্বতের উচ্চতা ২৪৭০ ফুট। ট্রেকিং-এ সক্ষম না হলে ত্রিকূট পর্বতে ওঠা সম্ভব না। একটি রোপওয়ে আছে শুনলাম পাহাড়ের ওপরে। এমনিতে সিঁড়িও আছে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর–হিন্দু ধর্মের প্রধান তিন দেবতার নামে ত্রিকূট পর্বতের তিনটি চূড়া। শিবমন্দির আছে এখানেও। পৌরাণিক ব্যাখ্যা অনুসারে, এখানেও ধ্যানে বসেন রাবণ। তিনি ছিলেন প্রগাঢ় শিবভক্ত। শিবের উদ্দেশ্যে গীত রাবণের গানের সুর যেন আজও ভেসে বেড়ায় এই নির্জন প্রকৃতির মাঝে অবস্থিত ত্রিকূট পর্বতের বাতাসে। সবই পর্বতের পাদদেশে বসে অনুভব করা। দর্শন দূর থেকেই। গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। পরম শান্তিময় পরিবেশ। ত্রিকূট পর্বতে যাওয়ার পথটিও খুব সুন্দর। প্রাচীন বেশ কিছু গাছ রয়েছে পথের দুধারে । পর্বতের আশেপাশেও প্রচুর গাছ। আর এখানেও হনুমান বাবাজিরা বিপুলসংখ্যক। ব্যস্ত হয়ে এদিকওদিক বিচরণ করছে তারা। অতএব বিশ্রাম, আখের রস পান ও হনুদের মজাদার কান্ড দেখে ফিরে এলাম আশ্রমে।

Img 17 1657360019329
দেবতার ঘরে তিনটি দিন 33

পরদিন রাত থাকতে উঠেছি। বৈদ্যনাথ দর্শনে যাব। ধর্ম নিয়ে তেমন আগ্রহ না থাকলেও পুরান ও ইতিহাসের একটা আকর্ষণ আছে। আশ্রম থেকেই রিকশা ঠিক করে দিয়েছিল। সেই রিকশচালক একবারে ঘড়ি ধরে ৪টের সময় এসে হাজির। খুব সুন্দর ব্যবহার। মন্দিরে পৌঁছনোর পর গেটে আমাকে নামিয়ে সে রিকশা স্ট্যান্ডে চলে গেল। আমি আশ্রম সেক্রেটারির এক চিলতে কাগজে লেখা চিঠি নিয়ে নির্দিষ্ট পান্ডার কাছে গেলাম। তিনি খুবই সমাদর করে মন্দিরের চাতালে বসার ব্যাবস্থা করে দিলেন। এবারও কিছু পাগলামির কারণ ঘটলো। ‘আমি শুধু বাইরে থেকে মন্দির দেখে চলে যাব। পুজোর জন্য যা প্রয়োজন উনি যেন কিনে দিয়ে দেন। আমি টাকা দিয়ে দেব’–আমার এহেন বার্তা শুনে পান্ডা মহাশয় প্রায় মূর্ছা যান আর কি ? ইনিও যথেষ্ট নাছোড়বান্দা। পুজো আমাকেই দিতে হবে এবং আমি যেহেতু বালানন্দ আশ্রম থেকে এসেছি উনি আমাকে তাই স্পেশালি শিবলিঙ্গ দর্শন ও স্পর্শ করিয়ে দেবেন। অগত্যা আত্মসমর্পণ।

পুজোর দেরি আছে। আপাতত অপেক্ষা। একটু একটু করে কাটছে অন্ধকার। তার কিছু পরেই সাদা ধবধবে মন্দিরের চূড়ার উপর এসে পড়ল প্রথম রবির কিরণ। চারপাশে অগণিত ভক্ত, দূর দূর থেকে এসেছেন তাঁরা। ঘন্টা বাজছে। ফুল ও ধুনোর গন্ধ। সব মিলিয়ে এক অনির্বচনীয় প্রভাত চাক্ষুষ করলাম। তারপর প্রবল ঠেলাঠেলি করে বাবার মাথা ছুঁয়ে প্রনাম করে মন্দিরের বাইরে। সাষ্টাঙ্গে প্রনাম আর পেরে উঠলাম না। ফলে ওই হাফ পুণ্য নিয়েই ফেরা। পান্ডা মহাশয় তাঁর দক্ষিণা নিয়ে খুশি হয়ে আবার মন্দিরে। রিকশাচালক ভাই অপেক্ষা করছিল। রিকশায় উঠে তাকে বাবা বৈদ্যনাথের প্রসাদী প্যারা দিতেই সে একগাল হাসলো। খেটে খাওয়া মানুষের এই হাসি আমি যতবার ঝুলিতে পুরি ততবার আরও ধনী হই। আমাকে আশ্রমে নামিয়ে বিদায় নিল সে।

এখন ব্রেকফাস্ট ও একটু বিশ্রাম। কিচেনে পছন্দের ফুলকো লুচি আর সাদা আলুর তরকারি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে কিছুক্ষণ আলস্য। দুপুরের খাবার পর আবার একটু গড়াগড়ি। তারপর আর একবার নওলাখা মন্দিরে গেলাম। আজ হেঁটেই যাওয়া। একেবারে কাছে। চিনেও গেছি। মন্দিরে ঘন্টা বাজছে। রাধা-কৃষ্ণের সান্ধ্যকালীন সাজ সম্পূর্ণ। কিছুক্ষণ থেকে ঘরে ফেরা। সন্ধ্যায় মন্দিরের ঘন্টা বাজে। প্রদীপ জ্বলে উঠছে একে একে। যেমন আকাশের তারারা ফুটছে একটি একটি করে। এক কোণে চাঁদের অপরূপ আলোর ছটা। কি অনাস্বাদিত এক অনুভূতি ! প্রকৃতির মাঝেই যে ঈশ্বরের ঘর, আরও একবার অনুভব করি। কাল ভোরে ট্রেন। ফিরবো কাজের শহরে। সঙ্গে অফুরান স্মৃতির মনিমুক্তো। পাঠকের সুবিধার্থে জানাই, দেওঘরে প্রচুর ভালো হোটেল আছে। আছে বিভিন্ন সংস্থার হলিডে হোম। এছাড়া রামকৃষ্ণ মিশন ও ভারত সেবাশ্রমের গেস্টহাউসেও থাকতে পারেন। হলিডে হোম ও গেস্টহাউসের ক্ষেত্রে আগাম বুকিং করে গেলে ভালো। যাওয়া-আসায় তেমন সময় লাগে না। জল-হাওয়া চমৎকার। দেবমহিমা ছেড়েই দিলাম। প্রকৃতি এখনও বড় মনোরম দেওঘরে। একবার গিয়ে দেখতেই পারেন।