ধর্মের রাজনীতি ও অপরাধের ধর্ম
হাতে হাতে স্মার্টফোন। তরুণ প্রজন্মের চোখ ইদানীং নিত্যনতুন ওয়েব সিরিজে। সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সেইসব সিরিজ নিয়েই নানাকথা এই বিভাগে। ধর্ম আর অপরাধের যুগলবন্দি ‘অসুর’ দ্বিতীয় সিজনে আরও টানটান ও সাসপেন্সে ভরপুর। লিখেছেন মৃণালিনী ঠাকুর।
সিনেমার মতোই ওয়েব সিরিজের ক্ষেত্রেও হিট-ফ্লপ বিচারের ব্যাপারটা মোটামুটি দেখে নেওয়া হয়, ওপেনিং উইকএন্ড অর্থাৎ স্ট্রিমিং শুরুর সপ্তাহান্তে। আর তার প্যারামিটার হলো এইরকম–২০ লাখের নিচে ভিউজ হলে, সেটি ফ্লপ। ২০-৪০ লাখ হলে, গড়পড়তা। ৪০-৭০ লাখ হলে, তাকে হিট ধরে নিতে হবে। আর এই বিচারেই, ৫০ লক্ষের ভিউয়ারশিপ পাওয়া ‘অসুর ২’-কে হিট ধরে নেওয়া যেতে পারে। ‘অসুর ২’ স্ট্রিমিং শুরু হয়েছে এ বছর জুন মাসে। এই কয়দিনে এই সিরিজের ভিউয়ারশিপ নিশ্চয়ই আরও বেড়েছে। ‘অসুর ২’ অর্থাৎ ‘অসুর’ সিজন ২, যার পুরো নাম ‘অসুর : রাইজ অফ দ্য ডার্ক সাইড’।
এই প্রেক্ষিতে আরও একবার আলোচনায় আসে এই সিরিজের প্রথম সিজনের কথা। ২০২০-র মার্চে ‘অসুর’ সিজন ১-এর প্রিমিয়ার হয়, যার পুরো নাম ‘অসুর : ওয়েলকাম টু ইয়োর ডার্ক সাইড’। ‘অসুর’ কথাটির আভিধানিক অর্থ সকলেরই জানা। গল্পের একটি কাঠামো থাকলেও বিষয়টি আসলে প্রতীকী, বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। এই প্রেক্ষিতে সিজন ১-এই বোঝা গিয়েছিল, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের অনেকটা জুড়ে যে অপরাধ-জালের বিস্তার, এটি তারই অনুসারী হবে। একথা স্বীকার করেও উল্লেখ করতে হবে, ক্রাইম থ্রিলার হলেও ‘অসুর’ কিছুটা ব্যতিক্রমী পথেই হাঁটল এবং সাধারণ দর্শকদের পাশাপাশি সমালোচকদের প্রশংসাও ভরে নিল ঝুলিতে।
অকুস্থল বেনারস। পুরাণ ও ইতিহাসের এই প্রাচীন শহরেই জাল বিছায় ভয়ঙ্কর অপরাধ ! সিবিআই ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের একটি টিম একজন সিরিয়াল কিলারকে ধরার চেষ্টা করছে, যে কিনা নিজেকে পুরাণের অসুর (কালী) বলে মনে করে। মানে, পুনর্জন্মের পর কালী একজন সিরিয়াল কিলারে পরিণত। এদেশে ধর্ম ও অপরাধ যে হাত ধরাধরি করে চলে, তার এক নিখুঁত চিত্র এই সিরিজ। এটা বলতেই হবে, বিষয়টিকে নিপুণ দক্ষতায় ওয়েব দর্শকের দরবারে হাজির করেছেন পরিচালক ওমি সেন। কাহিনি লিখেছেন গৌরব শুক্লা, নীরেন ভাট, অভিজিৎ খুমান, চিরাগ স্যালিয়ান, অভিষেক গর্গ।
সিজন ১ শেষ হয়, সিরিয়াল কিলারের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কি আছে, দর্শকের সামনে এই প্রশ্ন, থুড়ি, টানটান সাসপেন্স রেখে। সিজন ২-এ সেখান থেকেই গল্প শুরু হয়। সিবিআই অফিসারদের পক্ষে এই তদন্ত সংক্রান্ত তৎপরতার পাশাপাশি তাদের পেশাদারী ও ব্যাক্তিগত জীবনের নানা পর্ব মিশে যায়। এই কেসেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে চাকরি খোয়ায় সিবিআই অফিসার ধনঞ্জয় রাজপুত তথা ডি জে। হারায় নিজের স্ত্রীকে। অন্যদিকে একমাত্র কন্যাকে হারায় ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ নিখিল নায়ার। নিজেদের জীবনে বিপর্যস্ত এই মানুষগুলো কতটা ব্যাক্তিগত পরিস্থিতি সামলে এই সিরিয়াল কিলারের পর্দা ফাঁস করার পথে নামবে সেটাই দেখান হচ্ছে ‘অসুর ২’-এ।
মহাযুদ্ধ নিকাল হ্যায়, কলযুগ কো উসকে চরম সীমা তক পহুচানে কা সময় আ গয়া হ্যায়…এহেন এক সংলাপের মাধ্যমে নিজেকে জাহির করে শুভ যোশী অর্থাৎ এই সিরিয়াল কিলার। তার অপরাধের যুক্তি ব্যাখ্যা করতে সে পুরাণের আশ্রয় নেয় আর নিখুঁত পরিকল্পনায় একের পর এক খুন করে চলে। সিজন ২-এ এসে অসুর তার সমস্ত শক্তি একত্র করে হুঙ্কার দেয় ধ্বংসের ! স্বাভাবিকভাবেই হিংসা চরম রূপ নেয় এবার। নিজের বাবাকে যে নিষ্ঠুর ভাবে খুন করে, সে কতটা নির্মম ও হৃদয়হীন হয়ে উঠতে পারে অপরের ক্ষেত্রে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চরিত্রটিকে দারুণ ফুটিয়ে তোলেন বিশেষ বানসাল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই কিশোর হিন্দি বিনোদন জগতে নিজের একটি শক্ত জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি যে লম্বা রেসের ঘোড়া, সে প্রমাণ ‘অসুর’-এর প্রতি পর্বে, তাঁর অভিনয় বলে দেয়। দুই সিজনেই এ সিরিজের সেরা প্রাপ্তি অবশ্য আরশাদ ওয়ার্সির (ধনঞ্জয়) অভিনয়। প্রসঙ্গত, বলিউডের অত্যন্ত দক্ষ এই অভিনেতার ওটিটি অভিষেক ঘটে এই সিরিজের হাত ধরেই। আরশাদ ওয়ার্সির সঙ্গে দুর্দান্ত তাল মিলিয়ে চলেন বরুণ সবতি (নিখিল)। ওঁরা ছাড়াও এই সিরিজে অভিনয় করেছেন গৌরব অরোরা, অনুপ্রিয়া গোয়েঙ্কা, রিধি ডোগরা, অ্যামে ওয়াঘ, শরিব হাশমি, মিয়াং চাং, অভিষেক চৌহান প্রমুখ। এই সাইকোথ্রিলার নির্মাণের পটভূমি হিসেবে বেনারসকে বেছে নেওয়া বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে অনেকেরই। রহস্য সহজেই ঘনীভূত হয়েছে এখানকার অজস্র অলিগলিতে। ‘অসুর’ সিজন ১ প্রযোজনা করেন তনভীর বুকওয়ালা। দেখান হয় ভূট চ্যানেলে। সিজন ২ প্রযোজনা করেছেন সেজাল শাহ, ভবেশ মান্ডালিয়া, গৌরব শুক্লা ও বম্বে ফেবলস। ‘অসুর ২’ দেখান হচ্ছে জিও সিনেমায়। আপাতত ‘অসুর’ ভক্ত ওয়েব দর্শক অপেক্ষা করছেন তৃতীয় সিজনের।