Monday, February 3, 2025
বিনোদন প্লাস স্পেশাললাইম-Light

‘নীহারিকা’-র অপেক্ষায় বাংলার দর্শক

আশাভঙ্গের মাঝেও ভালো করে বেঁচে থাকার  মনস্তাত্ত্বিক গল্প বলেছে ইন্দ্রাশিসের চতুর্থ ছবি। লিখেছেন সোমনাথ লাহা

নিছক মনোরঞ্জন বা বাণিজ্যিক ছবি নয়। যদিও গভীর ভাবনায় সম্পৃক্ত এই ছবিতে দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করবার যাবতীয় উপকরণই হাজির। ছবির বিষয়ভাবনা এমন, যা দর্শককে প্রেক্ষাগৃহের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পরও ভাবতে বাধ্য করে। আমাদের সকলেরই অবশ্য জানা, বরাবর এই ধরনের গল্প‌ই বড়পর্দায় বলতে পছন্দ করেন পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্য। তাঁর ছবির তালিকায় চোখ বোলালেই সেটা বুঝতে পারা যায়। ইন্দ্রাশিস তাঁর চতুর্থ ছবি ‘নীহারিকা’-তেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন।

প্রথম তিনটি ছবির কাহিনি তাঁর নিজের লেখা হলেও চতুর্থ ছবির জন্য সাহিত্যধর্মী গল্প‌ই বেছেছেন পরিচালক। বাংলার প্রখ্যাত এক সাহিত্যিকের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবির চিত্রনাট্য বুনেছেন ইন্দ্রাশিস। প্রসঙ্গত, ইন্দ্রাশিস যে উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবি তৈরি করেছেন, সেটির বিষয়ভাবনা মনস্তাত্ত্বিক। ভালোবাসা ছাড়া একটা জীবন শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছায় তাই প্রতিফলিত হবে এই ছবিতে। ইন্দ্রাশিসের কথায়, “এখনকার দ্রুতগতির মোবাইল-ইন্টারনেটের ঘেরাটোপে বাঁধা সময় থেকে পুরোপুরি উল্টোদিকের একটা জীবনের প্রতিচ্ছবি রয়েছে এখানে। জনমানবহীন প্রান্তরে নিজেকে প্রান্তিক করে রাখতে চাওয়া একজন মানুষ। আশাভঙ্গের গল্প এটা। কিন্তু তার মধ্যেও ভালো করে বেঁচে থাকার কথা উঠে এসেছে ‘নীহারিকা’-য়।”

Niharika Simultala 5
'নীহারিকা'-র অপেক্ষায় বাংলার দর্শক 10

ছবিতে মুখ্য চরিত্রে রয়েছেন অনুরাধা মুখোপাধ্যায়। ইতিমধ্যেই ‘পঞ্চলাইট’, ‘সোয়েটার’, ‘গুলদস্তা’ -র মতো ছবির পাশাপাশি ‘তানসেনের তানপুরা’, ‘একেনবাবু’-র মতো ওয়েব সিরিজে অনুরাধার অভিনয় নজর কেড়েছে দর্শকের। এই ছবির চরিত্রের জন্য যে বয়সটা প্রয়োজন তার সঙ্গে অনুরাধা মানানসই হ‌ওয়ায় তাঁকেই প্রোটাগনিস্ট দীপার চরিত্রে বেছে নিয়েছেন ইন্দ্রাশিস। প্রসঙ্গত, আড়াই বছর ধরে এই ছবির শুটিং করেছেন  তিনি। প্রযোজনা সংক্রান্ত সমস্যার কারণে বারবার থমকে গিয়েছে ছবির কাজ। কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল থেকে ছবির শুটিং শেষ করেছেন পরিচালক। আড়াই বছর ধরে ১৭ জন প্রযোজককে একত্রিত করে প্যাস্টেল এন্টারটেনমেন্ট অ্যান্ড মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড-এর ব্যানারে এই ছবিটির নির্মাণ করেছেন ইন্দ্রাশিস। সহ প্রযোজনায় রয়েছে অ্যাডভার্ব মুভিজ প্রাইভেট লিমিটেড অ্যান্ড আদার্স উইথ চেরিপিক্স মুভিজ প্রাইভেট লিমিটেড।

‘নীহারিকা’-র কাহিনি আবর্তিত হয়েছে দীপাকে কেন্দ্র করে। আদর্শহীন, ভোগীদের মাঝে এক ভয়ঙ্কর জটিল পরিবেশে তার কৈশোর অতিবাহিত হয়েছে। ওই পরিবেশেই অল্পবয়সে মা-কে হারিয়ে সে আশ্রয় পায় মামার বাড়িতে। সেখানে শুরু হয় তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। কম বয়সে ভালোবাসা না পাওয়া দীপা এমন অনেক অভিজ্ঞতার সন্মুখীন হয়, যা তার মনে হয় অনুচিত। নিজের অস্তিত্বের সংকট থেকে বেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করে সে। ‘নীহারিকা’-য় মুখ্য চরিত্রে অনুরাধা (দীপা) ছাড়াও দীপার ছোটমামার চরিত্রে রয়েছেন শিলাজিৎ মজুমদার। ‘অসুখ’, ‘মহুলবনীর সেরেঞ’-র পর আবার অন্যরকমের চরিত্রে  দেখা যাবে শিলাজিৎকে। ছবিতে তাঁর অভিনীত চরিত্রটি একজন ডাক্তারের। দীপার ছোটমামীর চরিত্রে রয়েছেন মল্লিকা মজুমদার। দীপার বন্ধু রঙ্গনের ভূমিকায় দেখা যাবে অনিন্দ্য সেনগুপ্তকে। অনিন্দ্যকে দর্শক সম্প্রতি দেখেছেন ‘এক্স = প্রেম’ ছবিতে খিলাতের চরিত্রে। এছাড়াও ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছেন রাজেশ্বরী পাল। তাঁকে দেখা যাবে দীপার বড়মামার মেয়ের ভূমিকায়।

Niharika Simultala 8
'নীহারিকা'-র অপেক্ষায় বাংলার দর্শক 11

‘নীহারিকা’-র কাহিনিতে ঋতুর ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখের আসা যাওয়ার মতোই পালাবদল ঘটে ঋতুচক্রের‌ও। সেই কথাকে মাথায় রেখে গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত ঋতুকে ধরে বিহারের শিমুলতলা, মধুপুর, গিরিডিতে এই ছবির শুটিং করেছেন পরিচালক। এই ছবির প্রায় ৭০ শতাংশ শুটিং হয়েছে আউটডোরে। ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন জয় সরকার। ছবিতে রয়েছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও দাশরথি দাসের লেখা দুটি গান। প্লেব্যাকে রয়েছেন অবর্ণা রায় ও শ্রাবনী রায়। সিনেমাটোগ্রাফার শান্তনু দে। সম্পাদনায় লুব্ধক চট্টোপাধ্যায়। ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে ছবির ফার্স্ট লুক পোস্টার, যা রীতিমতো নজর কেড়েছে দর্শকের।

Niharika Simultala 12
'নীহারিকা'-র অপেক্ষায় বাংলার দর্শক 12

একদা কর্পোরেট অফিসে চাকুরিরত ইন্দ্রাশিস সিনেমার প্রতি ভালোবাসা, প্যাশন থেকে ছবি পরিচালনায় এসেছেন। এই ভালোলাগা, ভালোবাসার টানেই এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কর্মজীবন থেকে ইস্তফা নিয়ে পাকাপাকিভাবে চিত্র পরিচালনার প্রতি মনোনিবেশ করেছেন তিনি। যদিও ইন্দ্রাশিসের কথায়, “আসলে স্বাধীনভাবে ক্রিয়েটিভ কিছু করার জন্য‌ই আমার এই সিদ্ধান্ত। নিজের কনসাল্টিং ফার্ম খোলার ইচ্ছেও রয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য কাজও করতে চাই। সিনেমা আমার সেইরকম ভালোবাসার মধ্যেই একটা।”

ইন্দ্রাশিসের ছবি মানেই সেখানে লং শট থেকে শুরু করে স্ট্যাটিক শটের খুব বেশি ব্যবহার দেখা যায়। অফস্ক্রিন ক্রাফটিং তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় ছবিতে যেটির ব্যবহার খুব কম হয়ে থাকে। সেই কারণেই এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে ব্যবহার করেন পরিচালক। ২০১৭-তে ‘বিলু রাক্ষস’ ছবির হাত ধরে বড়পর্দায় চলচ্চিত্র পরিচালনায় হাতেখড়ি ইন্দ্রাশিসের। ছবিটি সেই সময় বক্স অফিসের আনুকূল্য পায়নি। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, তত‌ই আর‌ও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার পাশাপাশি দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে ‘বিলু রাক্ষস’। ইউটিউবে ইতিমধ্যেই প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ দেখেছেন এই ছবি।

সম্প্রতি নন্দনে এই ছবির চিত্রনাট্য ব‌ই আকারে প্রকাশিত হ‌ওয়ার অনুষ্ঠানে ইন্দ্রাশিস বলেছেন, “এখন আমি যে ধরনের ছবি করি আমার কাছে আজ‌ও বেঞ্চমার্ক বা রেফারেন্স হিসেবে ‘বিলু রাক্ষস’ থাকে।” দ্বিতীয় ছবি ‘পিউপা’-তেও নিজের সাহসী ভাবনার পরিচয় রাখেন পরিচালক। বাবা-ছেলের মুক্তির গল্পের পাশাপাশি স্বেচ্ছামৃত্যুর মতো বিষয়ভাবনা প্রতিফলিত এই ছবিতে। সেই সময় সেন্সর বোর্ডের আঞ্চলিক শাখা ছবির বেশ কিছু দৃশ্য বাতিলের পরামর্শ অবধি দিয়েছিল। পরবর্তীতে সিবিএফসি-র সদর দফতরে পরিচালক আবেদন করলে বিদ্যা বালানের নেতৃত্বাধীন আট সদস্যের জুরিবোর্ড ছবিটির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে মুক্তির ছাড়পত্র দেয়। ২০২০-তে মুক্তি পায় ইন্দ্রাশিসের তৃতীয় ছবি ‘দ্য পার্সেল’। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অভিনীত এই ছবি আসলে থ্রিলারের মোড়কে একটি সামাজিক কাহিনি। সাইকোলজিক্যাল এই ওপেন এন্ডেড ছবিটি ছিল এক্সপেরিমেন্টাল চিত্রনাট্যের এক বলিষ্ঠ উদাহরণ। ২৫তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগিতা বিভাগে থাকা এই ছবির সুবাদে শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসাবে হীরালাল সেন পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন ইন্দ্রাশিস।

Simultala Rain 1
'নীহারিকা'-র অপেক্ষায় বাংলার দর্শক 13

তাঁর আগের তিনটি ছবিই দর্শক ও সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত ও সমাদৃত হ‌ওয়ার পাশাপাশি দেশে ও বিদেশের বহু চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে। তাই এই ইন্ডিপেনডেন্ট পরিচালকের চতুর্থ ছবিকে ঘিরেও সিনেপ্রেমীদের মধ্যে আগ্রহ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। বড় ব্যানার বা প্রযোজনা সংস্থার আনুকূল্য না পেলেও প্যাশনেট এই পরিচালক তাঁর প্রতিটি ছবিই অত্যন্ত যত্ন নিয়ে তৈরি করেছেন। তাঁর কথায় “আমার ছবি সময়ের সঙ্গে বাঁচবে।” বলা বাহুল্য, ‘নীহারিকা’ নিয়েও যথেষ্ট আশাবাদী ইন্দ্রাশিস। এই ছবিটিকেও বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠাতে চান তিনি। অ্যাডিলেড ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গত ২২ অক্টোবর অফিশিয়াল ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়েছে  ‘নীহারিকা’-র। হ্যানয় ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও প্রতিযোগিতা বিভাগে মনোনীত হয়েছে এই ছবি। ২৭তম আন্তর্জাতিক কেরালা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অফিশিয়াল সিলেকশন পেয়েছে ‘নীহারিকা’। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছর মুক্তি পাবে ‘নীহারিকা’। তবে এর পাশাপাশি মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে ইন্দ্রাশিসের প্রথম হিন্দি ছবি ‘থ্রি কোর্স মিল’। এছাড়াও আগামী দিনে একটি ছোটদের ছবিও তৈরি করতে চান পরিচালক। কাহিনি স্বত্ব‌ও কিনে রেখেছেন।