Monday, February 3, 2025
দর্পণে জীবন

পুরুষ দিবসও যেন শুধু পালনে সীমাবদ্ধ না থাকে

জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে নিজেই সে নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।

ছেলেপিলে নিয়ে মা দুগ্গা বাপের বাড়ি গেলেই বড় একা হয়ে যান মহাদেব। তাঁর সংসারে গিন্নিই সব। কোথা থেকে কি হয়, কিছুরই খবর রাখেন না তিনি। পুরো ব্রম্মান্ড জুড়ে কত কি সামলাতে হয়। ভাগ্যিস ঘরের ঝামেলা থেকে পার্বতী রেহাই দেয় তাঁকে। নাহলে হিমশিম খেয়ে যেতেন তিনি। শুধু মর্ত্যের ওই শারদ উৎসবের ক’দিন–তাতেই একেবারে  নাস্তানাবুদ হওয়ার যোগাড় হয় শিব ঠাকুরের। পার্বতী বিনে চোখে অন্ধকার দেখেন তিনি। পার্বতী নিজেও কি জানেন না সে কথা ? তাঁরও কি আর স্বামীকে ফেলে কোথাও গিয়ে মন টেকে ? কিন্তু এও যে দীর্ঘদিনের রীতি। মানতেই হবে। বছরভর মর্ত্যের মানুষও যে তাঁর আসার পথ চেয়ে বসে থাকে। এদিকে ভোলেভালা মহাদেবকে ওই নন্দী-ভৃঙ্গির হাতে ফেলে রেখে গিয়েও তো শান্তি নেই।

পুরান থেকে একবিংশ। আদতে পুরুষ এমন ভাবেই নারীর প্রেমে, আশ্রয়ে, শক্তি ও সামর্থ্যে জীবন নদীতে সঞ্চরণশীল। এটাই স্বাভাবিক জীবনগাথা। এর বাইরে যা যা আমরা প্রতিনিয়ত সমাজের চারপাশে দেখি তা এক সামাজিক অসুখ। সেখানে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে এক অসুস্থ পরিক্রমা ও চক্রে পাক খাচ্ছে। কিন্তু আজ এসব থাক। শিব ও পার্বতীর কথায় আমরা শুরুয়াত করেছি। সে বড় মায়াময় এক অনুভবের কথা। আকাশের এক অর্ধেকে নারী আর বাকি অর্ধেক জুড়ে পুরুষ। এমন সম দৃষ্টি তো প্রকৃতিরই লিখন। পিতা, পুত্র, প্রেমিক, স্বামী, ভাই, বন্ধু কোনও না কোনও রূপে তাঁরাও তো আছেন নারীর জীবনে। ব্যক্তিত্ব, মানবিক গুণাবলী, প্রেম ও সহমর্মিতা নিয়ে তাঁরাও তো চলেছেন নারীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, একে অপরের পরিপূরক হয়ে।

আগামিকাল আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস। ভালোমন্দ মিশিয়ে আমরা যেমন তাঁদের জীবনে আছি, তাঁরাও আছেন। সেই সহযাত্রাকে সহমর্মী করে তোলায় দু’পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ জরুরি অবশ্যই। তবে, সেটা যথাযথ বিচার বিশ্লেষণের পর। প্রতিবাদ হোক। কিন্তু তথাকথিত ভাবে জাতিগত বৈরিতা নয়। কয়েকজন পুরুষের কারণে আমরা সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারি না। মনে রাখা দরকার–অবহেলা, অসম্মান, ঘৃণার বিনিময়ে মঙ্গলময় কিছু পাওয়ার আশা অযৌক্তিক। ভালোবাসাই পারে সব আঁধার দূর করে আলোর রোশনাই জ্বালাতে। এই প্রতিবেদনে তারই নির্যাস। লেখাটি আমার ব্যক্তিগত ব্লগে এর আগে প্রকাশিত হয়েছিল। কিছু পরিমার্জনা করে আরও একবার, প্রাসঙ্গিকতার নিরিখেই।

আমার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক। বাবাকে দেখতাম সংসারের সব কাজে মাকে সাহায্য করছেন। সবজি কাটা থেকে ঘর ঝাড়ু দেওয়া, তথাকথিত সামাজিক নিয়মের ধার না ধেরে, সবেতেই হাত লাগাতেন। প্রতিবেশীদের বাঁকা কথাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে মাকে বলতেন, তুমি যদি সংসারে আমার আর্থিক দায়িত্বের বোঝা ভাগ করে নিতে পারো, আমি কেন ঘরকন্নার কাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেব না ! এটা ছয়-সাত দশকের কথা। সেই সময়ের একজন পুরুষকে এত কাছ থেকে এভাবেই দেখেছি। প্রগতিশীল, মুক্তমনা, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সহমর্মী। গার্হস্থ্যধর্ম পালনে ওঁদের মধ্যে ঝগড়া-তর্ক হতো না, এমন নয় ! কিন্তু কাউকে কারোর প্রতি অশ্রদ্ধাশীল হতে দেখিনি কখনও। বাবা চলে গেছেন বহু বছর। মা বেঁচে। ছেলে-বউয়ের সংসারে ভালোই আছেন। তবে, বাবার কথা উঠলে এখনও, এই আশি বছর পার করেও তাঁর গলা ভারি হয়ে যায়।

ওঁরা আসলে জানতেন, একে অপরের কাছে কী চান, সেটা ! আর সমস্ত চাওয়া পাওয়ার সিলেবাসে সব সময় ওই শ্রদ্ধা, ভরসা, বিশ্বাসের মধুর মশলাগুলি জারিত থাকতো ! আমরা প্রতিবাদে, প্রতিরোধে মুখর হতে গিয়ে কোথাও এই মাধুর্য্যটাই হারিয়ে ফেলেছি। অনুযোগ আর অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফারাক হলো, প্রথমটায় অভিমান জড়িয়ে থাকে। সামান্য মনোযোগেই তা দূর হয়ে যেতে পারে। অভিযোগ আসে তীব্র চাহিদা থেকে। এই চাহিদারও যেন কোনও সীমারেখা নেই। ফলে, অভিযোগের তালিকাও দীর্ঘ হতে থাকে। সেখান থেকে আক্ষেপ, হতাশা, জ্বালা–সব মিলিয়ে সম্পর্কের যাবতীয় মাধুর্য্য তিক্ততায় পর্যবসিত।

সেকালের নারী, পুরুষের প্রতি তার চাহিদাকে ব্যক্ত করতে অক্ষম ছিলেন। তাঁরা হয়তো বহু অন্যায় ও বঞ্চনার শিকারও হয়েছেন। কিন্তু আজকের নারী তার চাহিদাকে নিক্তির হিসেবে বুঝে নিতে গিয়ে, কতটুকু তার চাওয়ার, কতটুকু দেওয়ার সেটাও যে কোথাও কোথাও ভুলে যাচ্ছেন। আমার মায়েদের বা আমাদের সময়টায় সামগ্রিকভাবে একটা সমন্বয় সাধনের চেষ্টা ছিল। আজকাল এটারই বড় অভাব। আর এখান থেকেই আমরা গার্হস্থ্য থেকে সামাজিক ক্ষেত্রে প্রতিশোধের মন নিয়ে অন্যায় অবিচারের চাকাটাকে উল্টো দিকে ঘোরাবার চেষ্টা করছি বলে, আমার মনে হয়।

২০১৯-এর এক পরিসংখ্যান বলছে, বিবাহিত মহিলাদের তুলনায় বিবাহিত পুরুষদের আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। কোথাও কোথাও তো প্রায় দ্বিগুণ। চমকে ওঠার মতো এই পরিসংখ্যান জানাচ্ছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)। এই রেকর্ড এটাও বলছে, অবিবাহিত পুরুষরাও এর বাইরে নয়। প্রতি ৯ মিনিটে ১ জন করে বিবাহিত পুরুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বছর দুয়েক আগের কথা। একটি জাতীয় স্তরের  ইংরেজি সংবাদমাধ্যম গ্রুপের ওয়েব এডিশনে একদল কলেজ ছাত্রের করা একটি সার্ভে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এখানে সব থেকে মারাত্মক যে তথ্যটি উঠে এসেছে, সেটা হলো মেয়েদের প্রতি পুরুষের অত্যাচার প্রতিরোধ আইনের রেকর্ড পরিমাণ অপব্যবহার।

তথ্য বলছে, মহিলাদের ওপর অত্যাচার, যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত এমন প্রচুর এফআইআর হয়, যা আদতে ভিত্তিহীন। দিল্লী হাইকোর্টের এক পর্যবেক্ষণ অনুসারে, মামলা আদালতে ওঠার পর, অভিযোগকারিনীদের অনেকেই যে মিথ্যে বলছে, তা প্রমাণিত। পর্যবেক্ষণ বলছে, ডিভোর্সের মামলা হলো একদল মহিলার রোজগারের রাস্তা। প্রথমে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে লকআপে ঢোকাও। তারপর ডিভোর্সের মামলা করো। দর কষাকষির জন্য উকিল তো আছেই। কোনও ভাবে একটা বড় দাও মারতে পারলে সারা জীবন পায়ের উপর পা দিয়ে আয়েশ করো। এই তথ্যগুলি কোথাও কী আমাদেরও আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় না ?

যে কথা শুরুতেই বলেছি, সেটাই সত্য ! নারী পুরুষ একে অপরের পরিপূরক–সে সম্পর্কের রূপরেখা যাই হোক। সম্পর্কগুলি এগিয়ে চলুক নতুন অভিমুখে, এক সুস্থ মানসিকতার পথ ধরে। তাতে তর্ক-বিতর্ক থাক ! তবে, সেখানে যেন গ্লানির জটিলতা আঁচড় কাটতে না পারে। সে দায় শুধু পুরুষের নয়, নারীরও। বিশ্বাস জোগানো, ভরসা দেবার দায় শুধু পুরুষের নয়, নারীরও। সবচেয়ে বড় কথা, দাম্পত্য বা যে কোনও একান্তের সম্পর্কে শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা না থাকলে সে বাঁধন বরং ছিন্ন করে দেওয়া ভালো। তাকে জোর করে টেনে বেরিয়ে কোনও পক্ষেরই ভালো হয় না। অন্যদিকে অত্যাচারিত হয়ে চলাটাও নারী বা পুরুষ কারও ক্ষেত্রেই যুক্তিযুক্ত নয়। এক্ষেত্রে সামাজিক সমর্থন ও আইনের আশ্রয় নিতেই হবে।

শেষে আর একবার সেই চিরন্তন ভালোবাসার কথা। নারী বা পুরুষ উভয়কেই বলা–শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকুন একে অপরের সঙ্গে। সেটা না পারলে, যদি কিছু হিসেবের বাঁধনে বাঁধা থাকতে চান, তাও কবুল। সেক্ষেত্রে অভিযোগ করবেন না একে অপরের বিরুদ্ধে। সেটা অর্থহীন শুধু নয়, বিরক্তিকরও বটে ! আপনাদের এবং পারিপার্শ্বিক সকলের। নারী দিবসের মতোই পুরুষ দিবস পালন শুধু একটি বিশেষ তারিখে সীমাবদ্ধ না করে প্রত্যেকে আর একটু ভাবুন, নিজেদের কী করণীয় ! আয়নায় নিজের মুখ না দেখলে সত্যিটা কোনওদিন উপলব্ধ হয় না।

ছবি : প্রতীকী