প্রান্তিক মানুষের কথা ‘টুসু’-তে
নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। আজকের ছবিটি অবশ্য টলিউডে নির্মিত নয়। বাংলা ভাষার ছবিও নয়। তবে, এই রাজ্যেই বসবাসকারী মানুষের ছবি। আমাদের না জানা জীবনের কথা বলেছেন বিশ্বজিৎ রায় তাঁর কুর্মালি ভাষায় তৈরি ছবি ‘টুসু’-তে। লিখেছেন নির্মল ধর।
গত কয়েক বছর ধরে কলকাতা ফিল্ম উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন উপজাতির ভাষা নিয়ে তৈরি বিরল ছবির একটি প্যাকেজ। সাঁওতালি, কুর্মালি, রাজবংশী, কুলুক, খারিয়া, গোন্ডী ইত্যাদি ভাষায় যে সব উৎকৃষ্ট ছবি তৈরি হয়, তা এককথায় চমৎকৃত করে দেওয়ার মতো। আজ তেমনই একটি ছবি সম্পর্কে জানাবো। অনেকগুলো মনে রাখা ছবির মধ্যে প্রথমেই স্মরণে আসছে কুর্মালি ভাষায় তৈরি ছবি ‘টুসু’-র কথা। কুর্মালি ভাষা ব্যবহৃত হয় ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলে।
এবার আসি ‘টুসু’ প্রসঙ্গে। ছবিটি বানিয়েছেন বিশ্বজিৎ রায়। প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগে তিনি সাঁওতালি ভাষায় একটি ছবি করেছিলেন–নাম ‘দুলক এক প্রেম কথা’। নাট্যচর্চাতেও আগ্রহ আছে বিশ্বজিতের। এই তরুণ বেশ কিছু সময় ধরে ঝাড়গ্রাম অঞ্চলের বাসিন্দা। কুর্মালি উপজাতির মানুষদের জীবনচর্চা তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতাজাত। তাঁর কথায়, “আমি নিজে দেখেছি, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য নিজেদেরই বিপদে ফেলে না এরা, কিশোর-বয়সী ছেলেমেয়েদেরও ব্যবহার করে।” কুর্মালি সম্প্রদায়ের প্রধান জীবিকা জঙ্গলে ঢুকে কেন্দু বা শালপাতা কুড়িয়ে আনা। তার থেকে ‘থালি’ তৈরি করে হাটে বিক্রি করা। আর দুর্গা ও কালীপুজোয় কলকাতা শহরে এসে ঢাক বাজানো। কিন্তু তাতে কী আর সারা বছর চলে ? জঙ্গলের হনুমান যদি গাঁয়ের কোনও মানুষকে আক্রমণ করে, তাহলে সরকারি নিয়মে সে পাঁচ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পায়।
বিশ্বজিৎ রায়ের ছবি ‘টুসু’ সহায়সম্বলহীন এমনই এক কুর্মালি পরিবারের কথা বলে। কানাই আর আহ্লাদী, তাদের দুই সন্তান টুসু আর প্যাটকাকে নিয়ে কোনও রকমে দিন গুজরান করে। কেন্দু ও শালপাতা জোগাড় করাটাই তাদের জীবিকা। এককথায় প্রান্তিক জীবনেরও প্রান্তসীমায় তাদের অবস্থান। বিশ্বজিৎ এক কুর্মালি গ্রামের লোকেশনেই ছবির শুটিং করেছেন। অভিনয় করিয়েছেন না-অভিনেতাদের! একমাত্র নিজে অভিনয় করেছেন প্রধান চরিত্র কানাইয়ের ভূমিকায়। স্ত্রী ও দুই সন্তানের চরিত্রে নিয়েছেন তিন কুর্মালিকে। আঞ্চলিক মানুষ স্বপ্নাকে সুন্দর মানিয়েছে আহ্লাদীর চরিত্রে–আক্ষরিক অর্থেই যেন একেবারে মাটি থেকে উঠে আসা ! সত্যি কথা বলতে কী, উপজাতি সম্প্রদায়ের এইসব মানুষদের যাপিত জীবনের কতটুকুই বা আমরা জানি! পরিচালকের ক্যামেরা সেই অজানা জীবনকে আমাদের চোখের সামনে তুলে এনেছে। সেই অর্থে, তেমন কোনও গল্প নেই এই ছবিতে। রয়েছে পিছিয়ে থাকা প্রান্তিক মানুষদের জীবনের লড়াই! কলকাতায় বনেদি বাড়ির পুজো হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, সেই বছর পুজোয় ঢাক বাজিয়ে তেমন রোজগার হয়নি কানাইয়ের! এদিকে বাড়িতে তখন চতুর্থ সদস্য আসার অপেক্ষা! আহ্লাদী অন্তসত্ত্বা!
অন্যদিকে হাটে-বাজারে এসে পড়েছে থার্মোকলের থালা। শালপাতার থালা আর তেমন বিক্রি হয় না। বাড়িতে এক মুঠো চালও নেই, বাচ্চাদের মুখে তুলে দেওয়ার মতো। অগত্যা কানাই কিশোরী টুসুকে দোকানে পাঠায় কলা কিনতে। আসল উদ্দেশ্য, হনুমান যদি টুসুর হাতের কলা কেড়ে নিতে আক্রমণ করে, তাহলে সরকারের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা সাহায্য পাবে। সাময়িক সমস্যা তো মিটবে! কিন্তু, ফল হয় মর্মান্তিক !! এখানেই পরিচালক বিশ্বজিৎ আপোষহীন কাজটি ক’রে, ছবিটিকে উত্তীর্ণ করে দেন এক সামাজিক দলিলে! মিথ্যা আশার কোনো বাণী নয়, তিনি প্রকৃত বাস্তবকেই তুলে আনেন তাঁর ক্যামেরায়। ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে ওঠে টুসু-মকর পরবের এক জনপ্রিয় গানের কলি, যে গানে রয়েছে দুঃখ মেশানো প্রান্তিক জীবনের কথা!
বিশ্বজিৎ রায়ের এই ছবিতে কোনও সিনেমা ব্যাকরণের মারপ্যাঁচ নেই। সরল সহজ ন্যারাটিভে ঘটনা এগিয়েছে কুর্মালিদের চলমান জীবনের মতোই ! ছবির মধ্যে লো কালারের আমেজ ভালো লাগে। আর ভালো লাগে স্বপ্নার স্বাভাবিক ব্যবহার–অভিনয় মনেই হয় না ! বিশ্বজিতের এই ছবি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, সত্যিই আমরা দেশের প্রান্তিক মানুষদের কতটুকু চিনি বা জানি ? এই ছবি সেই চেনাবার কাজটিও অত্যন্ত দরদের সঙ্গে করেছে। কুর্নিশ জানাই বিশ্বজিৎকে।