Monday, February 3, 2025
দর্পণে জীবন

বাঁচার বিকল্প পথ

জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে জীবন নিজেই  নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।

অতিমারীর আক্রমণ শুরু হয়েছে। এমনই একদিন সংবাদপত্রে খবরটা দেখে চমকে উঠি। খবরটা ছিল এই–একজন সংগীতশিল্পী কোনও এক রেলওয়ে স্টেশনের পাশে বসে ডিম বিক্রি করছেন। প্রথম চমকটা ভেঙে যেতেই একটা উপলব্ধি হলো–বেঁচে থাকার চেয়ে বড় সংগীত আর কী হতে পারে ? এই শিল্পী মানুষটিও তো সেটাই চেষ্টা করছেন ! অর্থাৎ বাঁচার জন্য বিকল্প পেশা। আর সৎভাবে যে পেশাকেই গ্রহণ করুন তিনি, এতে লজ্জার তো কিছু নেই ! এটাও বোঝা গেল, চাইলে বিকল্প ব্যাবস্থা হয়েই যায়।

সংবাদ মাধ্যমে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও এই ফর্মূলা প্রযোজ্য, তার প্রমান আমি স্বয়ং। আমি নিজে একেবারে প্রশিক্ষণ ও পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই এই পেশায় আসি একদা। নিজের ঢাক পেটানোর জন্য নয়, অভিজ্ঞতালব্ধ কয়েকটি বিষয় আগামী প্রজন্মের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার তাগিদেই কিছু নিজের কথা বলবো আজ। তার আগে চুম্বকে সেই অভ্যাস ও মানসিকতা নিজের মধ্যে গড়ে নেওয়ার প্রসঙ্গে আলোকপাত। 

শুধু সংবাদ মাধ্যম বলে নয়, যে কোনও পেশায় যাওয়ার আগে নিজেকে কয়েকটা কথা বলে নেওয়া দরকার। যেমন, সামনে যে কোনও কাজের সুযোগ এলেই ভেবে নিতে হবে, এই মুহূর্তে এই কাজটার বিকল্প আমার কাছে আর কিছু নেই। পরে কী করবো, পরে ভাববো। আপাতত মাটি কামড়ে পড়ে থাকা। প্রতি মুহূর্তে কাজের উৎকর্ষতা বাড়িয়ে নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যে সংস্থার কর্তৃপক্ষ আপনাকে অপরিহার্য ভাবতে বাধ্য হয়।

শুধু কর্মক্ষেত্রে নয়, জীবনের সর্বত্র সবার কাছে শেখার মানসিকতা অর্জন করা জরুরি। সেটা সিনিয়র, জুনিয়র, সমবয়সী সবার কাছ থেকেই হতে পারে। শেখার ক্ষেত্রে ‘ইগো’ যেন কখনও প্রতিবন্ধক হয়ে না দাঁড়ায়। শৃঙ্খলা, সমায়ানুবর্তিতা, কাজটা গুছিয়ে করা, কাজ ফেলে না রাখা–এগুলো ছোটবেলায় ঈশপের গল্পে যেমন পড়েছিলেন, সেভাবেই মেনে চলুন। জেনে রাখুন এগুলো জীবনের চিরন্তন শিক্ষা ও চর্চার বিষয়। এর সুফল চিরকালীন।

নিজের নির্ধারিত কাজের বাইরে সংস্থার অন্যান্য কাজও যদি যথাসম্ভব শিখে নেওয়ার সুযোগ থাকে, তাহলে অবশ্যই সেটা কাজে লাগাতে পারেন। তবে, এক্ষেত্রে সংস্থার নিয়মবিরুদ্ধ যেন না হয় বিষয়টা, সেটাও খেয়াল রাখা জরুরি। এর একটা ইতিবাচক দিক হলো, বিভিন্ন ধরণের কাজ জানলে, প্রয়োজনে বিকল্প পথ খুঁজতে সুবিধা হয়। কাজের ক্ষেত্রে ‘না’, অর্থাৎ পারবো না বলাটা একটা নেতিবাচক অভ্যাস। আবার থামতে জানাটাও সুস্থভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার একটা কৌশল। মনে রাখুন, বুদ্ধিমানরা কিন্তু দুটোর মধ্যে ব্যালান্স করে চলেন।

আত্মসম্মান বজায় রাখা আর সমঝোতা করা–একই সঙ্গে সম্ভব নয় জানি। এখানে কিছুটা ডিপ্লোম্যাটিক হতে হবে। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারাটা পরিণত মানসিকতার পরিচয়। কর্মক্ষেত্রে কিন্তু ভাবাবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা একান্ত কাম্য। তার মানে এই নয়, মানবিকতা বা সামাজিক চেতনা থাকবে না। ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে সবার সঙ্গেই। কিন্তু সেটা যতটা সম্ভব কাজকে কেন্দ্র করে। খুব বেশি ব্যক্তিগত স্তরে নয়।

জীবনের কোনও ক্ষেত্রে বেহিসেবি হবার কোনও জায়গাই নেই। বিশেষত মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবীর। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হওয়ার এখনই কোনও সম্ভাবনা নেই। সুতরাং, অর্থের সঠিক ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। কোন জিনিসটা আমাদের নিত্য যাপনে সর্বাধিক জরুরি, সেই ভিত্তিতে যাবতীয় পরিকল্পনা করুন। সময় ও অর্থব্যয় সেই হিসেবেই হবে। ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা পারতপক্ষে অফিসে টেনে আনবেন না। আবার ঘরেও অফিসের সমস্যা বহন করে নিয়ে না যাওয়াই শ্রেয়। এই অভ্যাস সাংসারিক জীবনের পক্ষে ক্ষতিকারক। ঠিক এইসব মানসিক প্রস্তুতির জায়গা থেকেই টিকে থাকা এবং প্রয়োজনে বিকল্প পথ খোঁজার উপায়টা বেরিয়ে যায় বলে দেখেছি।

নিজের কথা একটু বলি এবার। প্রথমে চাকরি পেলাম বিজ্ঞাপনে। স্পেস সেলিং-এর যাবতীয় ব্যাকরণ শিখলাম কাজ করতে করতেই। সেই কাজের ফাঁকেই নিজের সামান্য যে লেখার ক্ষমতা, সেটা কাজে লাগালাম। বিজ্ঞাপনের ক্যাপশন, লে আউট, আর্ট ওয়ার্ক–অর্থাৎ যত রকম সৃজনশীল কাজ থাকতে পারে, তা যথাসম্ভব শিখলাম। কোনওটা নিজে হাতে করা। কোনওটা আবার সহকর্মীরা যখন করছেন, তখন দেখা। লেখার সুযোগ পেলেই লিখতাম। এরই পাশাপাশি কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্মার্টফোনের ব্যবহার–সবটাই শিখতে হয়েছে। যা ছাড়া আজকের পেশাদারী জগৎ অচল। বিজ্ঞাপন থেকে সম্পাদকীয় বিভাগ। সাধারণ কর্মী থেকে পাতার দায়িত্ব। পর্যায়ক্রমে সবই ঘটলো।

সংবাদপত্র থেকে টেলিভিশনে অ্যাঙ্কারিং-এ এলাম। অভিজ্ঞতা বাড়তেই একটি ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ দেবার ডাক পেলাম। গান শেখার অভিজ্ঞতা ছিল আশৈশবের। মঞ্চ বা টিভি অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম অফিসের দায়িত্ব সামলে। গানের অভিজ্ঞতা আমার কথা বলার ক্ষমতাকে উন্নত করেছে। অ্যাঙ্কারিং-এ সাহায্যকারী হয়েছে সেটা। ইনস্টিটিউটে অডিও অ্যাকটিং শেখানোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এখন সম্পূর্ণভাবে অনলাইন নির্ভর কাজকর্ম করছি। একটি ই-ম্যাগাজিনের ক্রিয়েটিভ ও এডিটোরিয়াল দেখাশোনার দায়িত্বে আছি। বিকল্প কাজ আমায় খুঁজে নিয়েছে বারবার। আমি শুধু নিজেকে প্রস্তুত রেখেছি। তাই সুযোগ এলে ‘না’ বলতে হয়নি। এই এত রকম কাজের প্রত্যেকটাই যে কেউ করতে পারেন। অভিনব কিছু নয়। শুধু কাজটা সুযোগ পেলেই শিখে রাখতে হবে। কাজের থেকে মুখ না ফেরালে, কাজ মুখ ফেরায় না, নিজের জীবন দিয়ে দেখেছি।

ছবি : প্রতীকী