বিশ্ব থিয়েটার দিবস এবং
মন্দিরা পান্ডা
থিয়েটার বললেই আমাদের মনে খুব বেশি করে যে নামটা আসে, তিনি উইলিয়াম শেক্সপিয়র। তবে, বিশ্ব থিয়েটার মানে কেবল শেক্সপিয়র নন। আছেন ব্রেখট, কনস্ট্যানটিন স্তানিলাভস্কি, লরেন্স অলিভার প্রমুখ। আমাদের আছেন শূদ্রক, কালিদাস, রবীন্দ্রনাথ, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ। পরবর্তীকালে গিরিশ ঘোষ থেকে বাদল সরকার, বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়–সকলেই এক একজন দিকপাল। আলোচনায় আসে গিরিশ কারনাড, নাসিরউদ্দিন শাহ, শাবানা আজমি প্রমুখ থিয়েটারে নিবেদিত ব্যক্তিত্বের নামও! থিয়েটারের ইতিহাসে এঁরা এক একটি অধ্যায় রচনা করেছেন। কেউ নাট্য রচনা, কেউ অভিনয় ও পরিচালনায়। এঁদের নাম বা অবদান, কোনওটাই বলে শেষ করা যাবে না।
সারা বিশ্বের এহেন নাট্যপ্রেমী গুণীজনের সার্বিক ও সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ঘিরে যে ধারাবাহিক ইতিহাস রচিত হয়েছে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের অঙ্গনে, বিশ্ব থিয়েটার দিবস যেন তারই এক অনন্য উদযাপন বলা যায়। আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইন্সটিটিউট (আইটিই) কর্তৃক ১৯৬১ সালে বিশ্ব থিয়েটার দিবসের প্রবর্তন করা হয়। বেছে নেওয়া হয় ২৭ মার্চ দিনটিকে। প্ৰথম বিশ্ব থিয়েটার দিবসের আন্তর্জাতিক বাৰ্তা ১৯৬২ সালে ফ্রান্সের জিন কোকটিয়াও লিখেছিলেন। প্ৰথমে হেলসিঙ্কি এবং তারপর ভিয়েনায় ১৯৬১ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত আইটিইর নবম আলোচনাসভায় আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইন্সটিটিউটের ফিনিশ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে অধ্যক্ষ আর্ভি কিভিমা বিশ্ব থিয়েটার দিবস উদযাপনের প্রস্তাব দেন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কেন্দ্রসমূহে তা সমৰ্থিত হওয়ার পরই দিবসটির বিশ্বব্যাপী প্রচলন শুরু হয়। আইটিআই এর বিশ্বব্যাপী ৮৫টির বেশি কেন্দ্র রয়েছে। কলেজ, স্কুল, থিয়েটার পেশাদারদের এই দিনটি উদযাপন করতে উৎসাহ প্রদান করে আইটিআই।
প্রাচীনতম ভারতীয় সাহিত্যে নাটক শব্দটির নানাবিধ প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। বিশেষত ঋগবেদের সংবাদ সূত্রে এমন কিছু কথোপকথোনের উল্লেখ রয়েছে, যা থিয়েটার বা নাটকের ইঙ্গিতবাহী। সম্ভবত এগুলিই নাটকের আদিরূপ। এক্ষেত্রে স্ত্রী-পুরুষ ভালো পোশাক পরে নাচ-গান করতেন, যা এই নাটকের পূর্বরূপ বলেই ধরা হয়। এছাড়াও বৈদিক কর্মকাণ্ডেও অনেক নাটকীয় আচরণযুক্ত চর্চা বা অভ্যাস চোখে পড়ে। গ্রিসের সংস্পর্শে আসার পর থেকেই ভারতীয় নাট্য সাহিত্য উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করে। তবে ভারতীয় স্বাতন্ত্র্যে গ্রিক ঘরানার নাটক নিজ গুণেই ভারতের একান্ত হয়ে উঠেছে। সংস্কৃত সাহিত্যে শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’, কালিদাস রচিত ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’, ভবভূতির ‘উত্তর রামচরিত’ তারই নির্দশনবাহী।
বাংলা নাটকের সূত্রপাত যতটা এই সংস্কৃত নাটক থেকে উদ্বুদ্ধ, ঠিক ততটাই অনুপ্রেরণা দিয়েছে বিদেশি থিয়েটার। তার নিজস্বতা ছাপিয়ে গিয়েছে সব উচ্চতা। আধুনিক বাংলা নাটকের সূচনা হয় ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দে। সে সময় বিদেশি নাটকের অনুবাদের পাশাপাশি মৌলিক নাটকও রচিত হতো। ১৮২২-এর উল্লেখযোগ্য অনূদিত সংস্কৃত প্রহসন ‘প্রবোধ চন্দ্রোদয়’, ‘শকুন্তলা’, ‘রত্নাবলী’ ইত্যাদি। তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’ ও জি সি গুপ্তের ‘কীর্তিবিলাস’–এই দুটি মৌলিক নাটকও প্রকাশিত হয় ১৮৫২-তেই। বিচিত্র বিষয় ভাবনা নিয়ে শেক্সপিয়রের অনুসরণে তৈরি হয় হরচন্দ্র ঘোষের ‘ভানুমতী চিত্ত বিলাস’ (১৮৫২), কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘বাবু নাটক’ (১৮৫৪), উমেশচন্দ্র মিত্রের ‘বিধবাবিবাহ নাটক’ (১৮৫৬) যা সেইসময় রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল। এ সময়ের অন্যতম সেরা নাট্যকার ছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। তিনি তাঁর নাটক ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’-তে যেভাবে সে সময়কার সমাজকে তুলে ধরেছিলেন, তা আগে দেখা যায়নি। এরপর দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ সে সময়কার নীলচাষীদের সমস্যার কথা তুলে ধরে নজির গড়ে। যদিও এই নাটক বেশ কিছুটা পরের দিকের।
যুগে যুগে, বিশ্ব থেকে আমাদের ঘরের থিয়েটার–মঞ্চে তার রূপায়নের মধ্য দিয়েই উঠে এসেছে মানব সমাজের প্রতিচ্ছবি। সেই প্রতিচ্ছবি কোথাও সমকালীন, কোথাও বা প্রাচীন বা উত্তরকালীন ভাবনার প্রতীক। নাটকের প্রকাশভঙ্গি কখনও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ছলে, কখনও বা সরাসরি। অনুবাদ বা মৌলিক নাটক, ফর্ম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মঞ্চ নিয়েও নিত্যনতুন ভাবনা–নাট্যপ্রেমী সৃজনশীল প্রতিভাবান মানুষের অভাব ঘটেনি এই শিল্পচর্চায় আজও। উঠে এসেছে তরুণ প্রজন্মের সৈনিকরা। তাদের হাতেই ব্যাটন। প্রাচীনকে সঙ্গে নিয়ে নবীনের নতুন লক্ষ্য স্থির করছে তারা। বিশ্ব থিয়েটার দিবস সার্থক তাঁদের সকলের অবদানে–অতীতে ও বর্তমানে।