Monday, May 12, 2025
অন্য সিনেমা এবংবিনোদন প্লাস স্পেশাল

ব্যাকবেঞ্চার্স একটা পুরো পৃথিবী…

সিনেমা ওঁদের প্যাশন। প্রতিভা, মেধা, দক্ষতা আর নতুন নতুন ভাবনার আলিঙ্গনে বিচিত্র পথগামী ওঁরা। কেউ পূর্ণদৈর্ঘের ছবি নির্মাণে ব্যস্ত, কেউ তথ্যচিত্র বা ছোট ছবি। কখনও স্বাধীনভাবে, কখনও সামান্য বিনিয়োগ―স্বপ্নের কারিগররা ব্যস্ত তাঁদের নিজের ভুবনে। এইসব সিনেমা পরিচালক ও তাঁদের কাজ নিয়েই এই বিভাগ। পরিচালক রাজাদিত্য বন্দোপাধ্যায়ের মুখোমুখি  অজন্তা সিনহা। ধারাবাহিক আলাপচারিতার শেষ পর্ব আজ।

## তোমার তথ্যচিত্রে ঘুরেফিরে সেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বা সেই সংক্রান্ত বিষয়গুলি আসে। তাঁদের ভাষা, শিল্প সংস্কৃতির বিপন্নতা তোমাকে ভাবায়। ভবিষ্যতে এমন আর কী কী বিষয় নিয়ে কাজ করতে চাও ?

এটা ঠিক। আমি বরাবরই রিডিং বিটুইন দ্য লাইনসে বিশ্বাসী । অর্থাৎ যেটা বলা হচ্ছে না, দেখানো হচ্ছে না সেটা জানতেই বেশি আগ্রহী। গত ২০-২২ বছর কর্মসূত্রে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে । অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষদের। এঁদের কথা আমাদের মেনস্ট্রিম মিডিয়া সেভাবে বলে না। ভারতবর্ষের ভিতরে যে কতগুলো ভারতবর্ষ লুকিয়ে আছে, তা আমরা যারা শহরে থাকি অনেক সময় কল্পনা করতে পারি না। অতিমারীর সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের দেখে যাঁরা চমকে উঠেছিলেন, তাঁরা ভারতের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই না বলা মানুষ/শিল্পীদের কথা বেশি করে তুলে ধরতে চাই আমি । এছাড়া আমরা যেভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলেছি, সে বিষয়েও আগামীতে কিছু কাজ পর্দায় দেখা যাবে আমার।

## তোমার সিনেমার টার্গেট অডিয়েন্স কারা ?

আমি বলবো, সবাই দর্শক। পুরো দুনিয়াটাই আমার সিনেমার দর্শক। দেশ, কাল, সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকবো কেন ? সিনেমা নির্মাণ করছি ভারতবর্ষে ঠিকই। কিন্তু বিষয়বস্তুগুলি আন্তর্জাতিক। সিনেমার বিষয়গুলো তো মানুষকে নিয়ে। মানুষের সংগ্রাম, বেঁচে থাকা, না থাকা নিয়ে। শিল্পের সংকট নিয়ে। সুতরাং মেদিনীপুরে যেমন মানুষ রিলেট করতে পারবেন, তেমনই ম্যানহাটানে। এই ভাষাটা আমি শিখেই  চলেছি প্রতিটি নতুন ফিল্মে। আগামীতেও এর ব্যতিক্রম হবে না। 

 ## তোমার আগামী প্রোজেক্ট, যেখানে তুমি তোমার বাবা দেবাশিস বন্দোপাধ্যায়ের লেখা গল্পের পাশাপাশি নিজের লেখা গল্পও রেখেছো। এই কাজটার পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাও।

এটি একটি ফিচার ফিল্ম। নাম, নাইন্থ ওয়ার্ল্ড। বাবার একটি গল্প ও আমার ৯টি ছোট গল্প অবলম্বনে এই চিত্রনাট্য অনেকদিন হলো লিখেছি । বেশি কিছু বলতে পারবো না এখনই। সব ডকু শুটিং শেষ করে এটার প্রস্তুতি শুরু হবে। আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি সেটা ছাড়াও আমাদের নিজস্ব একটা নবম পৃথিবী আছে। বাংলাদেশের এক অভিনেত্রীকে নিয়ে এই ছবিটা করার ইচ্ছে আছে । আমিও অভিনয় করবো। সম্পূর্ণ অন্য ধারার একটি সুররিয়াল ছবি, এটুকু বললে খুব ভুল হবে না বলে বিশ্বাস করি ।

 ## তোমার গল্প লেখার বিষয়ে জানতে চাই। কবে থেকে লেখালেখি শুরু ?

গল্প লেখা শুরু ক্লাস ফাইভে। ‘আঁটপুর রহস্য’ প্রথম গল্প। তারপর দীর্ঘদিন প্রবাস জীবনে গল্প আর লেখা হয়ে ওঠেনি। লিখতে বরাবরই ভালো লাগে। সময় সুযোগ বেশি হয় না। ফিল্ম করার পরে ইদানীং একেবারেই বসতে পারি না। তবুও, বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছি । ২০১৪-১৫ সালে লেখা বেনারসের পটভূমিকায় লেখা উপন্যাসটি প্রকাশিত হবে। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থও ছাপা হবে ২০২৩-এ। ছোটগল্প লেখার চেয়ে পড়তে আমার বেশি ভালো লাগে। হয়তো সেই কারণে বেশি ছোটগল্প লেখা হয়নি। বাবার ছোটগল্প আমার ভীষণ পছন্দের। এবারে বইমেলায় বাবা দেবাশিস বন্দোপাধ্যায়ের  ছোটগল্প সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। কি অসাধারণ সব গল্প–পেরাইদার, ডেথ সার্টিফিকেট, শিবরাত্রি, মানিক ডুবুরি, তুমি কি মার খেয়েছো ? প্রতিটা গল্প নিয়ে দারুন সব সিনেমা বানানো যায়। একটা ব্যাপার আমার ক্ষেত্রে ঘটে–গল্প লিখতে লিখতে দেখি, সেগুলো আর ছোট থাকে না। দীর্ঘ উপন্যাস হয়ে যায়। আসলে আমাদের জীবনগুলো ছোটগল্প নয়, এক একটা আস্ত অপ্রকাশিত উপন্যাস। কখনও সখনও দীর্ঘ উপন্যাস।

## তোমার থিয়েটার চর্চা অভিনয় প্রসঙ্গে জানাও।

মা অসাধারণ অভিনয় করতেন। দাদা বাপ্পাদিত্য বন্দোপাধ্যায় বিখ্যাত পরিচালক–এই পরিচয়টাই অধিকাংশ লোক জানে। উনি কিন্তু নরেন্দ্রপুরে অভিনয়ের জন্যে শ্রেষ্ট পুরস্কার পেয়েছিলেন।

ছোট মামা চুটিয়ে থিয়েটার করেছেন বীরভূমে। তাই থিয়েটার বোধহয় আমার রক্তেই ছিল। নাটক করা শুরু করি স্কুল জীবন থেকে। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় থেকেই থিয়েটার করতাম। সান্নিধ্যে এসেছিলাম বাদল সরকার, রমাপ্রসাদ বণিকের ।

বাদলদা বলতেন তোর বাবা তো সুইস ব্যাংকে ডলার, ইউরো রেখে যাবেন না । কি রাখবেন বল তো ? বলেই বলতেন, একটা আকাশ  আর একটা খালি ক্যানভাস। আকাশ আর খালি ক্যানভাসটা নিয়ে কি করতে চাস দেখ ? সমর্থন করতেন না বিদেশে গিয়ে কাজ করাকে।

সেই একটা শূন্য আকাশ আর খালি ক্যানভাস নিয়ে পাড়ি দিলাম ইউরোপ। প্রথম স্টপ জার্মানি। নোকিয়া মোবাইল ফোনে চাকরি করার পাশাপাশি মঞ্চে প্রবেশ। থিয়েটার প্রথম প্রেম বললে কম বলা হবে। অদ্ভুত এক মাদকতা। তারপর দেখতে দেখতে ৪০০র বেশি প্রোডাকশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া–সিনেমা নির্মাণ করার আগে পর্যন্ত। চাকরি ছেড়ে অভিনয়কে পেশা করে নেওয়া মোটেই সহজ ছিলোনা বিদেশ বিভুঁয়ে। বর্ণবিদ্বেষ, প্রেজুডিস পেরিয়ে নানান চরিত্রে অভিনয়, অনেক নাটক লেখা ও পরিচালনা করেছি। শুরু করেছিলাম ক্লাস ফাইভে ‘অবাক জলপান’ দিয়ে, তারপর মোহিতদার (চট্টোপাধ্যায়) ‘সুন্দর’। প্রেসিডেন্সি কলেজে বহুবার পুরস্কৃত করেছিলেন সুকৃতি লহরী। তারপর প্রবাসে সফল নাটক বিগ মুভ টু নিউ ইয়র্ক, দু উই মেক ওর মার্ (Do we make or mar ?), ডেথ অফ এ সেলসম্যান ইত্যাদি। নিজের লেখা নাটক ‘মেঘ তোমার দেশ কোথায়’ ও ‘আমি বাড়ি ফিরিনি’ খুবই জনপ্রিয় হয়। প্রিমিয়ার হয়েছিল অসলো ও নরওয়েতে। অতিমারীর পর বছর কুড়ি পরে আবার নিজের লেখা নাটক এখন এই মুহূর্তে মঞ্চস্থ করছি মুক্তাঙ্গন ও জ্ঞান মঞ্চে। সাধারণ মানুষের প্রকৃত ভালোবাসায় সর্বমহলে সমাদৃত এখন এই মুহূর্তে । ব্যাকবেঞ্চার্স কলকাতার প্রথম নিবেদন।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বেঞ্চিতে বসতাম। স্কুলে যেতে ভয় পেতাম। জেলখানা মনে হতো। সেই অনুষঙ্গেই নিজের নাটকের দলের নাম রেখেছিলাম ব্যাকবেঞ্চার্স। পিছন থেকে সামনের সারিতে এগিয়ে আসা মানুষদের নাম ব্যাকবেঞ্চার্স। পিছন থেকে পৃথিবীটাকে আলাদা ভাবে দেখা যায়, নিজের মতো করে। ইঁদুর দৌড়ে সামিল না হয়ে, শেষ অবধি ইঁদুর না হয়ে, মানুষ হয়ে কিছু একটা করা যায়। বিশ্বাস করি শিল্পীদের দেশ থাকে না। থাকা উচিত নয় বোধহয়। তাই ব্যাকবেঞ্চার্স একটা পুরো পৃথিবী বা অল্টারনেট পৃথিবী, যেখানে বহু দেশের মানুষ একসঙ্গে মিলে থিয়েটার করেন।

## একই সঙ্গে অনেক রকম কাজ। কেমন এই যাপন ? আগামীর ভাবনাই বা কী?

সিনেমা নির্মাণ করা কঠিন ও ব্যাপক পরিশ্রমের কাজ বললে কম বলা হয়। সঙ্গে বাড়ির নানান দায়িত্ব। বাবা, দাদা কেউই আজ নেই। সংসার বলতে আমি আর মা। মায়ের বয়স হয়েছে। অনেক স্যাক্রিফাইস করে মানুষ করেছেন আমাদের। সারাটা জীবন ব্যস্ত থেকেছি। অনেকগুলো বছর বিদেশে থেকেছি। সময় দিতে পারিনি মাকে। আজও সিনেমা নির্মাণে অনেকটা সময় চলে যায়। তাই বাকি যতটুকু সময় অবশিষ্ট থাকে সেটা মাকে দেবার চেষ্টা করি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, আমার লেখা নতুন নাটক যে কোনও একদিন মঞ্চস্থ করার ইচ্ছে আছে। থিয়েটার ও সিনেমা একে ওপরের পরিপূরক। কোনও বিরোধ নেই। মঞ্চে ফিরতে চাই। আজ যখন দেশে বেশ কিছুটা সময় কাটাই, তখন রমাদা ও বাদলদার কথা খুব মনে পড়ে। ওঁদের পরিচালনায় অভিনয় করা হলো না। আক্ষেপ থেকেই যাবে ।