ভাসমান যাপন ওঁদের
জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে জীবন নিজেই নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।
কম বয়সে আমাদের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে বাঙাল-ঘটির একটা জোরদার লড়াই চলতো। একেবারেই নির্দোষ মজার একটা ব্যাপার। আদতে, এই বুড়ো বয়সেও এই তর্ক উঠলে আমি ওই নির্মল শৈশবে ফিরে যাই। আমি নিজে ওপার বাংলার। কিন্তু আমার প্রচুর ঘটি বন্ধু আছে। আমার মাসির শ্বশুরবাড়ি ঘটি। মাসির ননদ আজও আমার প্রিয় বন্ধুদের অন্যতম। ওদের বাড়িতেও চিরকাল অপার ভালোবাসা পেয়েছি। আমার প্রিয় বন্ধু ছন্দা। তার পরিবারের একজন সদস্য করে নিয়েছে সে আমায় কত সহজে। পোস্ত-কলাই ডাল-মাছের ঝাল আমার প্রিয় পদের অন্যতম।
এত কিছুর পরেও ছোটবেলায় কেউ যখন মজা করেও বলতো, তোরা তো ওপার (তখনও পূর্ব পাকিস্থান) থেকে তাড়া খেয়ে এপারে এসেছিস–বুকের ভেতর কোথাও একটা খচ করে লাগতো। বাবার আমৃত্যু দেশভাগের যন্ত্রনা বুকে বয়ে বেড়ানোর অসহায় অবস্থাটা অনুভব করতে পারতাম। সেই অসহায় মুখটা আজও মাঝে মাঝে স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। শুধু আমি বা আমরাই কেন, ‘উদ্বাস্তু’ ট্যাগ নিয়ে বেঁচে থাকে সারা বিশ্বের বহু দেশের অসংখ্য মানুষ। অতিমারী শুরু হওয়ার আগে এনআরসি প্রসঙ্গে সেই অস্তিত্বের সংকট নতুন করে উত্তাল হয়েছিল। দেশ ভাগ করে মুষ্ঠিমেয় কিছু মানুষ। অভিশাপ ভোগ করে কোটি মানুষের দল।
সাম্প্রতিক করোনাকালে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা দেখে কোথাও আবার নতুন করে সেই স্মৃতিবেদনা যেন উথলে ওঠে। নিজ নিজ ভূমি থেকে পেটের তাগিদে একদা তাঁদের যেতে হয় পরবাসে। প্রতিদিনের কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে কোনও এক সময় পরবাসকেই আপন করে নিতে শিখে যান তাঁরা। মেলামেশা, মানবিক আদানপ্রদান, উৎসব-পার্বন নিয়ে ভুলে থাকেন অর্থকষ্ট এবং নিজ ভুমিকে। সেই মানুষগুলি করোনা ও লকডাউন পরিস্থিতিতে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মোকাবিলা করে ফিরেছেন আপন ঘরে। ফিরতে পারেননি এমনও বহু মানুষ আছেন। তাঁদের বিপর্যয় কাটেনি। কাটে না।
পেটের দায়ে ভিন্ন জেলা, ভিন্ন রাজ্য, ভিন্ন দেশে যেতে হয় খেটে খাওয়া মানুষকে। এই প্রক্রিয়া আবহমান কালের। কিন্তু, আজকের পরিস্থিতি তুলনায় যে অনেক বেশি কঠিন ! কারণ, সেই, একদিন ঘরে ফিরে যাব সব যুদ্ধের শেষে, সেই গ্যারান্টি আজ আর নেই। নিজের পাড়া, গ্রাম বা শহরতলী কোথাও নতুন করে আর কর্মসংস্থান হয় না তাঁদের। কাজ নেই, তাই, ভাতও নেই। কবে সব ঠিক হবে ? ভিন রাজ্যে বা ভিন দেশে পুরোনো কাজের জায়গায় আর কি ফেরা যাবে ? সেই কাজ, সেই চেনা পরিবেশ কি আর পাব ? এইসব প্রশ্নে আজও জর্জরিত মানুষগুলি।
দেশভাগ থেকে উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন সীমান্ত রচনা। রাতারাতি নিজ বাসভূমে পরদেশী হয়ে যাওয়া। রাজনৈতিক খেলায় এ বিভাজন আবহমানের। এর পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নদী ভাঙ্গনে ঘর-গেরস্থালি ডুবে যায়, ভেসে যায়। ঝড়ের তান্ডবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে জীবন। এই যাবতীয় ঘটনায় ভাসমান শ্রমজীবী মানুষের যাপন। তাঁরা গতকাল উদ্বাস্তু, আজ পরিযায়ী। কেউ ভিটেহারা, কেউ বা চাকরি। প্রাণ যায়। মান যায়। তবু, তাঁরা লড়াই চালিয়ে যান। আজন্ম। আমৃত্যু।