ভুলব না দুটি দিনের নির্জনবাস
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ পশ্চিম মেদিনীপুরের ডুলুং নিয়ে লিখেছেন লিপি চক্রবর্তী।
কোনাকুনি দুটো তোরণ। একটা নীল-সাদা গেট পেরিয়ে অগোছালো বাগানের মধ্যে দিয়ে রাস্তা গিয়ে ঠেকেছে ঘন সবুজের মধ্যে নীল বর্ডার দেওয়া দুধসাদা দোতলা বাড়ির সদরে। আর একটি তোরণের মাথায় শিবঠাকুর বিরাজ করছেন, তোরণের দুই দিকে দুই সিংহ নিয়ে। তোরণের ওপরের দিকে লেখা আছে ব্যাঘ্রেশ্বর মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা। আমরা কলকাতা থেকে স্ববাহনে চেপে, খড়গপুর হয়ে বহেরাগড়া রোড ধরে, গোপীবল্লভপুর-২ নির্দেশিত রাস্তা ধরে তোপসিয়া মোড় পৌঁছে যখন দিশেহারা, তখনই এল গেস্টহাউসের কেয়ারটেকার বকুলবাবুর ফোন–আপনারা কতদূর পৌঁছলেন? তাঁর কণ্ঠ শুনে ধরে প্রাণ এল।

এরপর তাঁর নির্দেশিত পথে পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম মুক্তিধারা ডুলুং রিভার সাইড গেস্টহাউসে। আর নিপাট সবুজের মাঝে গেস্টহাউসটি দেখেই ভালোবেসে ফেললাম। তখন বেলা প্রায় একটা। এরপর দুপুরের আহার ও ক্ষণিকের বিশ্রাম। দোতলায় তিনটে ঘর আর নিচে একটি ডরমেটরি। ঘরের জানলা দিয়ে ডুলুং নদী আর বিশাল চওড়া বারান্দা দিয়ে বাগান দেখা যাচ্ছে, সঙ্গে রাস্তাও। বিকেল হতে না হতেই আমরা ছুটলাম ব্যাঘ্রেশ্বর মন্দিরের দিকে। কোনও পাঁচিল নেই, পাহারা নেই। বড় বড় গাছ সটান দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেন কোনও ঋষির আশ্রম। একধার দিয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে ডুলুঙের জলে।


এক সময় নাকি বাঘ বাস করতো এই মন্দিরে। তাই শিব ঠাকুর ব্যাঘ্রেশ্বর নামে পরিচিত। সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম ডুলুঙের জল ছুঁতে। ওপারে কালো পাথরের টিলার পিছনে অস্তগামী সূর্যের সোনার রঙের বিচ্ছুরণ। সে যে কী অপরূপ দৃশ্য, তা বর্ণনা করার ভাষা নেই আমার। শুধু শিব ঠাকুর নন, মন্দির প্রাঙ্গণে রয়েছে মা কালীর মন্দির। এছাড়া একটি ছোট্ট কুটিরে রয়েছে রামকৃষ্ণদেব-সারদা মা ও স্বামী বিবেকানন্দের ছবি। একজন সন্ন্যাসী ঠাকুর বসে জপ করছেন। স্থানীয় একজন বললেন, সন্ন্যাসীর বয়েস একশোর বেশি। তাঁর সঙ্গে আলাপ করার লোভ সংবরণ করা গেল না। মানুষটি কথা বলতে ভালোবাসেন। স্মৃতিশক্তিও ভালো। কিন্তু, কানে কম শোনেন। তাই বললেন, “মা দাওয়ায় উঠে আয়। না হলে আমি শুনতে পাব না।”

শুনলাম গৃহত্যাগের কারণ ছাড়াও তাঁর পরিক্রমার কথা, এই মন্দিরের কাহিনি, স্বপ্নাদেশ পেয়ে মা কালীকে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি কত কী ! নিজেই বললেন, বয়স তাঁর ১০২ বছর। ইতিমধ্যে ব্যাঘ্রেশ্বর মন্দিরে আরতির ঘণ্টা বেজে উঠল। আমরা ছুটলাম সেদিকে। পুরো প্রাঙ্গণ জুড়ে গাছের গোড়ায় জমে রয়েছে অসংখ্য ত্রিশূল আর মাটির ষাঁড়। এগুলো নাকি মানতের জন্য দেওয়া। আগে লোকে জ্যান্ত ষাঁড় ছেড়ে দিয়ে যেত আর সেই ষণ্ড মহারাজ ক্ষেতের সমস্ত ফসল খেয়ে ফেলত। তাই মাটির ষাঁড় দেওয়ার নিয়ম করেছেন স্থানীয়রা। মন্দির থেকে বেরিয়ে ডুলুংয়ের বয়ে যাওয়ার রাস্তা ধরে এগোতেই শুরু হল জঙ্গল। সন্ধে নেমে এসেছে। অন্ধকারে আর এগোনোর সাহস হল না। স্বীকার করতেই হবে, জঙ্গল পেরিয়ে মন্দির ডাইনে রেখে, গেস্টহাউসে ফেরার সময় যথেষ্ট গা ছমছম করছিল।

রাতের খাওয়ার পর বাংলোর বারান্দায় বসে নির্জনতার কোলে ডুব দিলাম। চারদিকে প্রকৃতি শুধু কথা বলছে। অন্ধকার মৃদু সুর তুলছে। আমরা শ্রোতা মাত্র। ঘুমোবার আগে জানলার পর্দাগুলো টেনে দিয়েছিলাম। ওমা! ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই কাচের জানলায় সজোরে ঠকঠক শব্দ। শব্দের উৎস খুঁজতে পর্দা সরাতেই দেখি কাচের জানলার বাইরে গ্রিলে বসে অজস্র পাখি। তারা ডাকাডাকি করছে এই সুন্দর সকালটাকে চোখ ভরে দেখে নেওয়ার জন্য। ওদের সকলের পরিচয় জানি না। কিন্তু জানালাগুলো খুলে দিতেই ওরা উড়ে গিয়ে গাছে বসল আর মিষ্টি সুরে শিস দিতে লাগল। নিজেদের মধ্যে খুনসুটি ঝগড়াঝাঁটিও করছিল। ওদের তো কেউ শেখায়নি আমাদের ডেকে তুলতে। কিংবা জানলা খুলে দিতেই উড়ে গিয়ে গাছের ওপর বসতে। এই অযাচিত প্রাপ্তিতে মনটা যেন নির্মল আনন্দে ভরে গেল!

স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম রামেশ্বর আর তপোবনের উদ্দেশে। রামেশ্বরে আছে বারোটি শিবলিঙ্গ বিশিষ্ট মন্দির। গঠনে ওড়িশি স্টাইল। প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো মন্দির। ভক্তি না হোক, স্থাপত্যের জন্য এটি দর্শনীয়। আর তপোবন তো সত্যিই তপোবন। ঠান্ডা জলের এক তিরতিরে নদী বয়ে চলেছে জঙ্গল ঘিরে। শুনলাম এখানে হাতির আনাগোনা আছে বেশ। এক সাধুবাবা ধুনি জ্বালিয়ে চোখ বুজে বসে। এটা পশ্চিম মেদিনীপুরের চাঁদবিলা রেঞ্জের অন্তর্গত। ফেরার পথে বাংলা-ওড়িশা সীমান্তে হাতিবাড়ি জঙ্গলে গেলাম। কিন্তু জঙ্গলের ভিতরে যাওয়ার অনুমতি কীভাবে সংগ্রহ করতে হবে, সেটা বলার লোক নেই। রেঞ্জার তাঁর কোয়ার্টার থেকে বেরোতেই চাইলেন না। যেন মানুষে অরুচি তাঁর। ভর দুপুরে অফিসেও কেউ নেই।


যাই হোক, বাইরে থেকে যতটুকু ঘোরা যায়, সেটুকুই দেখে ফেরত আসছিলাম। পথে পড়ল ঝিল্লি পাখিরালয়। এর কথা আমাদের জানা ছিল না। যেহেতু পর্যটক প্রায় নেই, তাই, পাখির দেখা মিলল প্রচুর। বিশালাকার ঝিলের চারদিকে রাস্তার ঘের। খুব সুন্দর পরিবেশ। মন ভরে গেল। সন্ধেতে ফিরলাম মুক্তিধারায়। রাত কাটল রাতচরা পাখির ডানা ঝাপটানো আর অন্ধকারের গুঞ্জন শুনে। ওরা যেন বলছিল ‘দু দণ্ড শান্তি পেতে হলে আবার এসো’। পরদিন ফেয়ার ওয়েদার ব্রিজে খানিক টহল দিয়ে ফেরার রাস্তা ধরলাম। স্মৃতির ঝুলিতে রইল নির্জনবাসের দুটি অপরূপ দিন।

এবার কিছু জরুরি তথ্য। নিজস্ব গাড়িতে না গেলে ঝাড়গ্রাম স্টেশনে নেমে, গাড়ি ভাড়া করে নিতে পারেন। কিংবা গেস্টহাউস বুকিংয়ের সময় ওঁদের জানালে, ওঁরাও গাড়ি পাঠাতে পারেন। ওখানে থেকে ঘোরার জন্যও গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন ওঁরা। খাবারের জন্য ওখানকার কেয়ারটেকারকে বলতে হবে। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত অর্ডার অনুযায়ী রান্না করে দেবেন। গেস্ট হাউসে কিচেন আছে। তবে, জানিয়ে রাখি, খুব বেশি ভ্যারাইটি খাবার পাওয়া যাবে না। কারণ, খাদ্যপণ্য প্রাপ্তির সবটুকুই গ্রামের হাটের ওপর নির্ভরশীল।


ঘরভাড়া ১২০০-১৫০০ টাকার মধ্যে। খাওয়ার খরচ সাধ্যের মধ্যেই হবে। যদিও সব খরচই সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন সাপেক্ষ। বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ করার সময় ওঁরাই খরচাপাতি বলে দেবেন। ড্রাইভারের থাকা ও খাওয়ার আলাদা প্যাকেজ আছে।
বুকিং সহ যাবতীয় কিছুর জন্য যোগাযোগ–
সম্রাট চৌধুরী 9831948634