‘মায়ি’-র হাত ধরে সাক্ষীর জয়যাত্রা অব্যাহত
লিখেছেন মৃণালিনী ঠাকুর
সাক্ষী তানোয়ার। হিন্দি টেলিভিশনের এই চাহিতা ‘বহু’ আদতে একজন অত্যন্ত শক্তিশালী অভিনেত্রী। মেগা সিরিয়ালের যাবতীয় ফর্মূলার সীমা অতিক্রম করে নিজের অভিনয়ের দীপ্তিতে প্রতিভাত হয়েছেন তিনি বারবার। পরে বড় পর্দাতেও নিজের সহজাত অভিনয় দক্ষতার প্রমান রাখেন সাক্ষী। ‘কাহানি ঘর ঘর কি’ থেকে ‘দঙ্গল’–সাক্ষীর যাত্রাপথ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তাঁর যোগ্য সুযোগ তিনি পাননি ইন্ডাস্ট্রিতে। কিন্তু সম্মান পেয়েছেন। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সাক্ষীর ‘মায়ি’ হয়ে ওঠাটা তাই ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। আজকের অপরিহার্য বিনোদন মাধ্যম ওটিটি–একের পর এক সিরিজ দর্শক দরবারে স্থান করে নিচ্ছে মূলত কনটেন্ট নির্ভরতার জন্য। সেখানে ‘মায়ি’-র যে বলিষ্ঠ চিত্রায়ণ, সাক্ষী ছাড়া সত্যিই সম্ভব ছিল না।
এখানে একটা কথা বিশেষভাবে বলার এই কনটেন্ট প্রসঙ্গেই। ‘মায়ি’-র কাহিনি সেদিক থেকে খুব অভিনব নয়। শীল (মায়ি) এক প্রতিশোধকামী মা, চোখের সামনে যে নিজের সন্তানকে খুন হতে দেখে। প্রকাশ্য দিবালোকে শীলের মেয়ে সুপ্রিয়াকে (ওয়ামিকা গব্বি) একটি দৈত্যসম ট্রাক ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। এই দুর্ঘটনা আসলে সুপ্রিয়াকে খুন করার উদ্দেশ্যেই সাধিত–এটা এক মায়ের অনুভব, যা কখনও মিথ্যে হয় না। এরপর ভাগ্য বা আদালত নয়, শীল তার মৃত মেয়ের প্রতি চরম অন্যায়কারীদের খুঁজে বের করার ভার নিজের হাতে তুলে নেয়। আর এটা করতে গিয়েই এক বিরাট অপরাধ চক্রের মুখোমুখি হয় ‘মায়ি’। তার জন্য অপেক্ষা করে আরও খুন, বন্দুকের লড়াই, সন্ত্রাস, অসাধুতা ইত্যাদি ইত্যাদি।
শীলের পরিবার আর পাঁচটা সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার যেমন হয়। শীল পাহাড়প্রমান দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে চলার পরও পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে পারে না। মেয়ে খুন হওয়ার পর তার স্বামীও কেমন বদলে যায়। অপরিচিতের মতো ব্যবহার করে। সুপ্রিয়ার খুনিদের খুঁজতে গিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য উঠে আসে। তার যন্ত্রনা, অসহায় আকুতি পরিবার বোঝে না। মেয়ের মৃত্যু পরবর্তী যেসব আচার-বিধি পালনীয়, সেটাও যেন যান্ত্রিক অনুভূত হয় শীলের কাছে। পটভূমি লখনৌ। ধনী, মধ্যবিত্ত ও বস্তি এলাকা–এই তিন সুনির্দিষ্ট শ্রেণিতে বিভক্ত এখানকার সমাজ। একদিকে চিরন্তন আর্থসামাজিক বৈষম্য ও বিভাজন–অন্যদিকে অপরাধের জগৎ, মাঝখানে ‘মায়ি’, এতকিছুর পরও মেয়ের আত্মার শান্তির জন্য দৃঢ় সংকল্প।
যদি বলা হয়, ভারতীয় ধ্যানধারণা অনুপাতে সন্তানের প্রতি অভিভাবক বা বাবা-মায়ের দায়িত্বের নতুন সংজ্ঞা লিখছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, তাহলে একটুও ভুল হবে না। মন্দিরে-মসজিদে মাথা কুটে মরার দিন শেষ। এখন সামাজিক মানুষ বিচার চাইছে সমাজের কাছেই। এর আগে ‘তব্বর’-এর পবন মালহোত্রা বা ‘আরিয়া’-র সুস্মিতা সেনকে আমরা এভাবেই পাই। পরিবারকে রক্ষা করতে বা পরিবারের প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এই চরিত্রগুলি। ‘মায়ি’-ও এমনই এক চরিত্র। এক্ষেত্রে, ‘মায়ি’ শীলের টানাপোড়েন যেন কিছুটা বেশি। মেয়েকে পালন করার ক্ষেত্রে তার কী ভুল ছিল, কোথায় খামতি থেকে গেল যে এমন এক পরিণতি হলো তার, ভিতরে ভিতরে এই ভাবনায় ক্ষতবিক্ষত শীল। বলা বাহুল্য, সাক্ষীই পারেন এমন একান্তের অন্তর্নিহিত জ্বালাকে ফুটিয়ে তুলতে।
বলিউড তারকাদের ওটিটি প্ল্যাটফর্মে আগমন ইদানীং অতি পরিচিত ঘটনা। ‘ফেম গেম’-এর সূত্রে স্বয়ং ধকধক মাধুরী দীক্ষিত পা রেখেছেন ওয়েব দুনিয়ায়। তবে, ‘ফেম গেম’-এর মাধুরী বা ‘আরিয়া’-র সুস্মিতার থেকেও সাক্ষীর শীলকে দর্শক অনেকবেশি মেলাতে পারবেন ‘দিল্লী ক্রাইম’-এর শেফালি শায়ের সঙ্গে। মাধুরী বা সুস্মিতার ওটিটি ওপেনিং তাঁদের ফিল্মি কেরিয়ারের মতোই তারকাসম। তাঁদের কসটিউম, লুক ইত্যাদিও সেইরকমই। শেফালি বা সাক্ষী অভিনেত্রী হিসেবে অনেকবেশি শক্তিশালী। বরাবর রিয়ালিস্টিক অভিনয়ের অনুপন্থী। সুযোগ যেখানে যতটুকু পান, হৃদয় ও মস্তিষ্কের যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম উজার করে দেন। ‘মায়ি’-র হাত ধরে সাক্ষীরও ওটিটি জার্নি আর একটু এগিয়ে গেল এবং তা একেবারে ঝড়ের মতো তীব্র প্রভাব নিয়ে।
নেটফ্লিক্স-এ গত ১৫ এপ্রিল শুরু হয়েছে ৬ পর্বের সিরিজ ‘মায়ি’। এক একটি পর্বের প্রদর্শন সময় ৫০ মিনিট। গল্প অতুল মোঙ্গিয়া, অমিতা ব্যাস ও তমাল কুমার সেন। ক্রিয়েটর অতুল মোঙ্গিয়া। ডিওপি রবি কিরণ আয়াগারি। সাক্ষী ও ওয়ামিকা ছাড়াও অভিনয় করেছেন বিবেক মুশরান, রাইমা সেন, বৈভব রাজ গুপ্তা, আনন্দ শর্মা, সীমা পাওয়া প্রমুখ। পরিচালক জুটি অতুল মোঙ্গিয়া ও অনশই লাল বলিউডে পরিচিত নাম। অত্যন্ত স্মার্ট ও টানটান এই প্রযোজনা আর পাঁচটি ক্রাইম থ্রিলারের তুলনায় পৃথকভাবে নজর কেড়ে নেয়, ভাবায়। এই সিরিজের সেরা প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে সাক্ষীর অভিনয়। ‘মায়ি’-র যাবতীয় অনুভূতি বাঙময় হয়ে ওঠে তাঁর অভিব্যক্তিতে–যেখানে সংলাপ বলেন তিনি সেখানে তো বটেই। যেখানে নীরব তিনি, সেখানে আরও হৃদয়স্পর্শী তাঁর উপস্থিতি।