মেগার ধাঁচেই ‘বোধন’
হাতে হাতে স্মার্টফোন। তরুণ প্রজন্মের চোখ ইদানীং নিত্যনতুন ওয়েব সিরিজে। সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সেইসব সিরিজ নিয়েই নানাকথা এই বিভাগে। আজ হইচই চ্যানেলের ‘বোধন’। লিখেছেন অজন্তা সিনহা।
গল্পে খুব বেশি নতুনত্ব না থাকলেও প্রাসঙ্গিকতা বিচারে ‘বোধন’ এই সময়ের এক জ্বলন্ত বিষয়–তাই এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য ! দুর্গাপুজোর প্রাক মুহূর্তে এই সিরিজ বাংলার দর্শক দরবারে এনে প্রযোজকরা বিষয়ের সেই প্রাসঙ্গিকতাই রক্ষা করতে চাইলেন, নাকি, এও নিতান্তই এক বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া, সেসব বিতর্কে যাব না। কারণ, গুরুত্বের দিক থেকে নারীধর্ষণ এমন এক বিষয়, এতটাই স্পর্শকাতরতা জড়িয়ে এর সঙ্গে, সেক্ষেত্রে সস্তা বিতর্ক না তোলাই সমীচীন। একটি নারীধর্ষণের ঘটনা এবং সেই প্রেক্ষিতে আর এক প্রতিবাদী নারীর যুদ্ধের ময়দানে নামা এই মোটামুটি পটভূমি ‘বোধন’-এর। ভিকটিম কলেজছাত্রী শিঞ্জিনী এবং তার পাশে দাঁড়ানো প্রফেসর রাকা সেন–এই দুজনেই মূল চরিত্র। অভিনয়ে যথাক্রমে দিতিপ্রিয়া রায় ও সন্দীপ্তা সেন।
গণধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে প্রস্তুত এই সিরিজ। তবে, ‘দিল্লী ক্রাইম’-এর প্রথম সিজনে নির্ভয়া কাণ্ডের ওয়েব-করণ যে পরিমাণ সিরিয়াস মোডে দেখি আমরা, তেমন পথে হাঁটেনি ‘বোধন’। প্রত্যাশিত মাত্রাতেই নাটকীয় উপাদানে ভরপুর হইচই-এর এই সিরিজ। কলেজছাত্রী শিঞ্জিনীর জীবন আবর্তিত বিবাহবিচ্ছিন্না মায়ের সাহচর্য, পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব আর এক সহপাঠীকে (প্রেমিক?) নিয়ে। তার গতানুগতিক অতি সাধারণ জীবন ওলটপালট হয়ে যায় এক রাতে। ঘটনা ঘটে মধ্যরাতে। চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণ করে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় শিঞ্জিনীকে। যথারীতি লোকলজ্জার ভয়ে পুলিশের কাছে যেতে চান না শিঞ্জিনীর মা। কলেজের অধ্যাপক রাকা সেন কিন্তু বিষয়টা এখানেই থামিয়ে রাখতে রাজি নয়। শিঞ্জিনীকে উদ্বুদ্ধ করে রাকা–প্রতিবাদে, অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ায়। লড়াই শুরু হয় শিঞ্জিনীর, অনুপ্রেরণা রাকা।
একদা এই কলেজেই পড়েছে রাকা। স্বাভাবিকভাবেই কলেজকে ঘিরে তারও অনেক আবেগ আর স্মৃতি। সেইসব বহন করেই অধ্যাপকের চাকরিতে যোগ দেয় রাকা। আলাপ হয় শিঞ্জিনীর সঙ্গে। তারপরই এই ভয়ঙ্কর কাণ্ড। আত্মবিশ্বাসী, প্রতিবাদী, ব্যক্তিত্বময়ী রাকা শিঞ্জিনীর ওপর ঘটে যাওয়া অপরাধের শিকড় পর্যন্ত যেতে চায়। সমাজের বহু নগ্ন ও অপ্রিয় সত্য উঠে আসে পর্বে পর্বে। শিঞ্জিনীর লড়াই কঠিনতর হয়ে ওঠে। কিন্তু রাকা আছে পাশে। রাকা যেন তার নিজের লড়াইই লড়ছে, এতটাই ভাবাবেগ খেলা করে তার মধ্যে। কিন্তু, মনের আবেগ মনেই চেপে রেখে শক্ত হাতে, প্রায় একার জোরে উচিত কাজগুলি করে যায় সে। নারীশক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে রাকা।
সন্দীপ্তা সেনের রাকা ব্যক্তিত্বে, বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্যে বিশ্বাসযোগ্য, এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাঁর চরিত্রটি একেবারে টেলর মেড। দর্শক সন্দীপ্তাকে এর আগেও কেন্দ্রীয় চরিত্রে এমনই প্রতিবাদী ভূমিকায় দেখেছে। সেদিক থেকে তিনি প্রত্যাশার মাত্রা ছুঁয়েছেন বলা যায়। দিতিপ্রিয়া এই মুহূর্তে ছোট পর্দার জনপ্রিয় মুখ। মাঝে বড় পর্দায় প্রসেনজিতের মতো তারকার পাশে তাঁকে দেখা গেলেও, ছবি ফ্লপ। ফলত, তাঁর কেরিয়ারের জন্য এই সিরিজ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এখানে তিনিও অন্যতম মুখ্য চরিত্রে। তবে, শিঞ্জিনীর টানাপোড়েন অভিব্যক্ত করার মতো পরিণত অভিনয় এখনও দিতিপ্রিয়ার করায়ত্ত নয়। অন্যান্য অভিনেতার মধ্যে আছেন কৌশিক রায়, হানি বাফনা, শর্বরী ঘোষাল, চান্দ্রেয়ী ঘোষ প্রমুখ। চান্দ্রেয়ী ও কৌশিক যথাযথ। পরিচালক অদিতি রায়। প্রযোজনা এসভিএফ এন্টারটেনমেন্ট।
ধর্ষণকাণ্ড ঘিরে প্রস্তুত কোর্টরুম ড্রামা বাংলা বা হিন্দি ছবি মিলিয়ে এর আগেও দেখেছেন দর্শক। এই সিরিজ দেখতে দেখতে দর্শকের স্মৃতিতে উঠে আসতেই পারে–আদালত ও একটি মেয়ে, দামিনী, পিঙ্ক ইত্যাদি ছবির কথা। তবে, সিনেমা আর ওয়েব সিরিজের মধ্যে কিছু প্রাথমিক পার্থক্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে থাকে। এখানে সেটি বেশ প্রকট স্বভাবতই। এছাড়াও, তপন সিংহ পরিচালিত ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ ছবিকে একেবারে অন্য গোত্রে রাখতে হবে এই প্রেক্ষিতে। ঘটনা প্রবাহের সূক্ষ গভীরতা তাঁর মতো সংবেদনশীল পরিচালক যেভাবে পর্দায় আনেন, তা এই জাতীয় বিষয় নিয়ে ফিকশন নির্মাণের ক্ষেত্রে এক চিরকালীন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এখানে তেমন প্রত্যাশার কোনও যুক্তিই নেই জানি। প্রত্যাশা করিওনি। তবে, এই অনুষঙ্গেই ‘দিল্লী ক্রাইম’ যতটা রিয়ালিস্টিক বা হৃদয়স্পর্শী হয়ে ওঠে, ‘বোধন’ সেই মাত্রায় পৌঁছয় না। সম্ভবত, এর নির্মাতারা সেটা চানওনি। ৮ পর্বের (সিজন ১) ‘বোধন’ তাই বাংলা মেগা সিরিয়াল পরিবেশনের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারে না, সামাজিক ক্ষেত্রে এমন গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয় হওয়া সত্বেও !!