ম্যাজিক তাঁর হৃদয়ে
জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে নিজেই সে নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। আমাদের এই ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু থেকে আমরা প্রকাশ করেছি এই বিভাগ। নানাকথায় রঙিন এই বিভাগটি আপাতত শেষ করছি। আসতে চলেছে নতুন কিছু। শেষ পর্বে একজন জীবন্ত কিংবদন্তি মানুষের কথা। জাদুকর জুনিয়র পি সি সরকারকে নিয়ে লিখেছেন অজন্তা সিনহা।
ফোন বাজতেই ওপ্রান্তে আত্মীয়তার সুরে তিনি বলেন,
প্রদীপদা বলছি–
যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন–আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই মানুষটি এভাবেই সাড়া দেন সবসময়। বললাম, একটা আবদার আছে প্রদীপদা। আমাদের একটা বিশেষ কলমের জন্য আপনার বাড়িতে যাব কিন্তু বাড়ির সবাইকে একসঙ্গে চাই। কলমের নাম ‘ব্রেকফাস্ট মিটিং’। সেই সময় আমি যে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত, এটা ছিল তারই জন্য। যাই হোক, জবাবে প্রদীপদা বললেন, “এই রে, এটা তো প্রায় অসম্ভব এক আবদার। আমরা শুধু ডিনারের সময়েই একত্রিত হওয়ার সুযোগ পাই। সারাদিন সবাই ব্যস্ত। কিন্তু আপনার লেখার বিষয় তো ব্রেকফাস্ট!” আমি বললাম, ঠিক আছে হয়ে যাবে। আমাদের ফটোগ্রাফার আলো ইত্যাদি ওর মতো সেট করে ছবির বিষয়টা ম্যানেজ করবে। কী আর করা ? সবাইকে একসঙ্গে পাওয়াটাই যে সবচেয়ে জরুরি। প্রদীপদার জবাব, “আপনি তাহলে রাত দশটায় চলে আসুন। আমি সবাইকে বলে রাখছি।”
কে বলবে তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাত ম্যাজিশিয়ান ! আর খ্যাতিও তখন থেকে, যখন মিডিয়া বলতে গুটিকয়েক সংবাদপত্র। পি সি সরকার জুনিয়র। হ্যাঁ, আজও নিজেকে জুনিয়র ভাবতে ও বলতেই পছন্দ করেন তিনি। বাবা, আর এক কিংবদন্তি ম্যাজিশিয়ান প্রয়াত প্রতুল চন্দ্র সরকারের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধার প্রকাশ এভাবেই ঘটান প্রদীপদা। ওঁর অন্তহীন স্নেহ, প্রশ্রয় ও সান্নিধ্য পেয়েছি বার বার। স্বল্প পরিসরে সেই বিস্তৃত কাহিনি লেখা একান্তই অসম্ভব। সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সূত্রে তো বটেই, শহরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও ওঁর মুখোমুখি হয়েছি বেশ কয়েকবার। মনে পড়ছে প্রথমবার সামনাসামনি দেখা হওয়ার কথা। ওঁর বাড়িতে গেছি সাক্ষাৎকার নিতে। আগাম সময় নেওয়াই ছিল। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রদীপদার বালিগঞ্জ স্টেশন সংলগ্ন বাড়ির দরজায় পৌঁছে দেখি, উনি আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে বসে আছেন।
একালের শৈশবের সঙ্গে ম্যাজিকের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু আমাদের প্রজন্মের কাছে ম্যাজিক ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ এক বিষয়। আর একজন ম্যাজিশিয়ান তো প্রায় ভগবান ! সেক্ষেত্রে সেই মানুষটি যখন পি সি সরকার, তখন দেখা হওয়ার আগে উত্তেজনার পারদ কোথায় উঠতে পারে, তা সহজেই বোধগম্য। সঙ্গে দ্বিধা, অত বড়মাপের একজন মানুষ ! ঠিক মতো কথা বলতে পারবো তো ? উত্তেজনা, দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সাংবাদিক সুলভ হয়ে উঠতে অবশ্য খুব বেশি সময় লাগে না। এটা পেশার শিক্ষা বলা যায়। এছাড়া, ওঁর উষ্ণ আন্তরিক ব্যবহারও খুব তাড়াতাড়ি আমায় দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করল।
কী অসীম পান্ডিত্য ! অথচ, একটুও দেখানেপনা নেই। সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান–প্রাচীন থেকে সমসাময়িক, অগাধ পড়াশোনা ! কথা বলতে বলতে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ম্যাজিক সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আজও হয়তো জানি না। তবে, ম্যাজিক যে নিছক আমোদের বিষয় নয়, বুঝেছিলাম সেদিন প্রথম ওঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর। এটাও জানলাম, এক একটি শো, একজন ম্যাজিশিয়ানের জীবনে কি করে এক একটি অধ্যায় হয়ে ওঠে। বলেছিলেন, “সামনে অগুনতি কালো কালো মাথা। সেখানে অন্ধকার। আমি আলো ঝলমলে মঞ্চে দাঁড়িয়ে। সামনের ওই অন্ধকার অংশটাকে আমাকেই আলোকিত করতে হবে। এমন কিছু করে দেখাতে হবে যা ওদের কল্পনা, ইচ্ছে, ভাবনা এবং সর্বোপরি বিশ্বাসের প্রতিটি বিন্দুকে তৃপ্ত করতে পারে ! ম্যাজিক কিন্তু লোককে বোকা বানানো নয়। ম্যাজিক মানুষের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করা।”
‘বিশ্বাস’ শব্দটাকে খুব জোর দিয়ে বলেছিলেন, আজও মনে পড়ছে। এও বলেন, “পারফর্মিং আর্টস পুরোটাই দাঁড়িয়ে এই বিশ্বাসের উপর। মানুষ তোমাকে বিশ্বাস করে যে প্রত্যাশা করছে, তার সম্পূর্ণ মর্যাদা রক্ষা করা একজন পারফর্মারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। আমি আজও মনে করি, মানুষ আমার শিল্পকে দেখতে চায়। তাই আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে।” কী বিনয় ! কী অপরিসীম নিবেদনের ভাবনা ! বলতে দ্বিধা নেই, সারা বিশ্ব যাঁর জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ, তাঁর মধ্যেকার আসল ম্যাজিক চাক্ষুষ করি সেদিন। সে ম্যাজিক আসলে নিছক কিছু হাতের কাজ নয়, নয় শুধু মস্তিষ্কচালনা। প্রকৃত শিক্ষা, বিনয়, বোধ, চেতনা ও মননের অপূর্ব সমন্বয়।
ওঁর সঙ্গে যতবার কথা বলেছি, ঋদ্ধ হয়েছি। জন্মগত প্রতিভা ও পরিবেশ যদি হয় তাঁর পারিবারিক। বাকি সবটাই নিজের। মেধা, বোধ, শিক্ষা আর পর্যাপ্ত অনুশীলন ! বলেছিলেন, “অনুশীলন ছাড়া কোনও কাজই নিখুঁত হয় না। মঞ্চে ওঠার আগে আজও নিজেকে আমি একজন শিক্ষার্থী ভাবি।” আক্ষরিক অর্থেই সমাজকে নিজের বর্ধিত পরিবার বলে মনে করেন বলেই তাঁর সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি সকলের প্রাণের মেলবন্ধন গড়ে ওঠে ! অনুরোধ করলেই, কতবার যে টেলিফোনেই মিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, বিভিন্ন বিষয়ে মতামত জানিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। সমাজের প্রতি চেতনা, দায়বদ্ধতা, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রমান পেয়েছি বার বার।
ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, সেটা হলো, স্ত্রী জয়শ্রীর প্রতি তাঁর প্রেম, শ্রদ্ধা ও নির্ভরতার কথা। একবার এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “আমার জীবনের ম্যাজিশিয়ান কিন্তু জয়শ্রী। আমাকে সর্ব অর্থে পূর্ণ করে তুলেছে ও। আমার পরিবার, মেয়েদের পড়াশোনা, কেরিয়ার থেকে আমার সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নেওয়া–জয়শ্রী যথার্থই আমার গৃহিণী-সচিব-সখা।” ওঁদের প্রাকবিবাহ প্রেম থেকে বিবাহ পরবর্তী খুনসুটি, মধুর দাম্পত্যের কাহিনি অকপটে বলতেন তিনি। প্রদীপদা তখন একজন আদ্যন্ত রোমান্টিক মানুষ!
ওঁর বিষয়ে একটা ঘটনা খুব মনে পড়ছে। সেই সময় কলকাতার বিভিন্ন টেলিভিশন বা স্টেজ শো-তে মীরের মিমিক্রি নিয়ে বাজার পুরো গরম। আরও অনেকের মতো পি সি সরকারের কথা বলার স্টাইলকেও নকল করে দর্শকমহলে হাসির ঝড় তুলছেন মীর। সেই ‘আরও অনেকে’র বেশ কয়েকজন ক্ষুব্ধও হয়েছেন। বিতর্ক তুঙ্গে। প্রদীপদাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করতেই একগাল হেসে, “না না রাগ করবো কেন ? আমার তো বেশ মজাই লাগছে। আরে, কিছু বৈশিষ্ট্য আছে বলেই না আমার মিমিক্রি করছে মীর !” এই রকমই একজন স্পিরিটেড মানুষ তিনি।
শেষ করবো রাত দশটার সেই ব্রেকফাস্ট মিটিং দিয়ে। আমার চিত্র সাংবাদিক ভাইকে নিয়ে প্রদীপদার ডাইনিং রুমে প্রবেশ করতেই একপ্রস্থ হাসির ঝড় উঠলো। ‘ডিনার টেবিলে ব্রেকফাস্ট মিটিং’ ব্যাপারটা সবাইকেই বেশ কিছুটা বাড়তি আমোদিত করেছিল। প্রদীপদা সহাস্যে আমাদের আলোকচিত্রী ভাইটিকে বললেন, “আজকের আসল ম্যাজিক ট্রিকটা কিন্তু তুমিই করবে ভাই। আলোর খেলায় রাতকে দিন করার দায়িত্ব তোমার !” ততক্ষণে মেয়েরা টেবিলে চা, বিস্কুট, কুকি ইত্যাদি সাজিয়ে ফেলেছে। হাসি-ঠাট্টা-মজায় জমে উঠেছিল সেই রাতের ব্রেকফাস্ট আড্ডা।
মনে যত আধুনিকই হোক, ঐতিহ্য বড় প্রিয় এ পরিবারের। বিশাল কাঠের প্রাচীন প্যাটার্নের ডাইনিং টেবিল-চেয়ারের সেট থেকে ঘরের চারপাশ ঘিরে সাজানো সবেতেই সেই ছাপ। রাত গভীর হয়। আমাদের আড্ডা ফুরোয় না। প্রদীপদার সঙ্গে পাল্লা দেন জয়শ্রী ও মেয়েরা। সব মিলিয়ে সে এক অপূর্ব প্রাপ্তি ! প্রাপ্তির ঝুলি এভাবেই ভরে ছিল বহুদিন। যতদিন পেশায় থেকেছি, যোগাযোগ অক্ষুন্ন ছিল। অবসর নেওয়ার পর সব ছেড়ে চলে এসেছি অন্য এক প্রান্তে। এক অন্য জীবনের পথে। সব ছাড়লেও স্মৃতি পিছু ছাড়ে না। আর এই মানুষটিকে ঘিরে আমার যা স্মৃতি, সবটাই বড় সুন্দর, বড় প্রাণময়।
🔻ছবি সৌজন্যে গুগল