রবীন্দ্রনাথের গানের সুরসৃষ্টি নিয়ে আরও কাজ হওয়া প্রয়োজন
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মদিবস ছিল গত ৯মে। এই উপলক্ষে আজ থেকে শুরু হলো ‘তবু অনন্ত জাগে’-র বিশেষ পর্ব। বিষয় ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত : অনুধাবন ও পরিবেশন’। এই বিষয়ে এই সময়ের প্রখ্যাত শিল্পীদের ভাবনাসমৃদ্ধ প্রতিবেদন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রবুদ্ধ রাহা। আলোচনা অজন্তা সিনহা।
শিল্পী প্রবুদ্ধ রাহাকে চিনি বহু বছর। দীর্ঘদিন একনিষ্ঠ সঙ্গীত চর্চা ও সাধনায় নিজেকে নিবিষ্ট রেখেছেন তিনি। রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে বরাবর শুদ্ধতা বজায় রাখার অনুপন্থী এক মগ্ন শিল্পী। প্রবুদ্ধের পরিবেশন ভঙ্গি বাহুল্যবর্জিত, ভাবসমৃদ্ধ ও সপ্রাণ। অনেকের মাঝেও অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এই শিল্পীর গান বহুবার মঞ্চে শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রতিবারই সমমানযুক্ত পরিবেশনের ধারাবাহিকতা পেয়েছি তাঁর মধ্যে। মানুষ ও শিল্পী, দুই দিক থেকেই স্বতন্ত্র, অনুভূতিপ্রবণ প্রবুদ্ধ আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। নিজের সংগীতচর্চার প্রেক্ষিতে তো বটেই, সাংবাদিকতার সূত্রেও যতটুকু পেয়েছি তাঁকে, ঋদ্ধ হয়েছি বারবার। একইসঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে তাঁর নিরলস কর্মযজ্ঞ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়েছে।
রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে ইদানীং নানা মত। বিতর্কও প্রচুর। এর ফলে একটা সংশয়ের বাতাবরণ যে সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর এই সূত্রেই অনুধাবনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতেই বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য হয়ে ওঠে প্রবুদ্ধর সুচিন্তিত মতামত। শুধু গানের ব্যকরণ জানা বা কিছু বাহ্যিক আয়োজনে সঠিক পরিবেশন রীতি আয়ত্তে আনা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে বুঝতে তার বাইরেও বহু বিষয়ে জানা প্রয়োজন। প্রয়োজন আলোচনা, গবেষনা, কর্মশালা। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি নিয়ে আমরা যতটা আবেগতাড়িত, ততটা অনুসন্ধিৎসু নই।
“রবীন্দ্রনাথের গানের কম্পোজিশন নিয়ে এখনও সেভাবে কাজ হয়নি। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা হয়তো একজন বিদেশি বা ভিন রাজ্যের মানুষ, যিনি ভাষাটা জানেন না, কথার অর্থ বুঝতে পারেন না। তিনিও কিন্তু বিপুলভাবে তাঁর গানের প্রতি আকর্ষিত হচ্ছেন। সুরই এক্ষেত্রে মেলবন্ধনের কাজটা করছে। এই ম্যাজিকটা আসলে কী ? কোথায় লুকিয়ে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের অন্তর স্পর্শ করতে পারার রহস্য ? এই অন্বেষণেই কাজ করছি আমরা দুই বন্ধু, আমি ও সৌমিত্র সেনগুপ্ত”–প্রসঙ্গত জানান প্রবুদ্ধ।
কণ্ঠে প্রবুদ্ধ, পিয়ানোয় সৌমিত্র। তাঁদের যৌথ উদ্যোগ ‘মিউজিক মাইন্ড’। প্রসঙ্গত, সৌমিত্রকে ওয়েস্টার্ন মিউজিকের একজন অথোরিটি বলা যায়। ওঁরা দুজনে মিলে বহু বছর ধরে কাজ করছেন–রবীন্দ্রনাথের গানে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউজিকের প্রভাব নিয়ে। এখানে একটা কথা–রবীন্দ্রসংগীতে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাব বলতেই মুষ্টিমেয় কয়েকটি গান আমরা শুনি ও গাই। যদিও বিস্ময়কর এর ব্যাপ্তি। এই বিষয়কে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই দেশবিদেশের বিভিন্ন অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন ওঁরা। বিপুলভাবে সাড়াও পেয়েছেন। পণ্ডিত ও বিদগ্ধজনের মনযোগ আকর্ষণ করেছে তাঁদের নিবেদন।
প্রবুদ্ধ জানান, “২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল–মোট ১৭টা শো হয়েছে আমাদের। এরমধ্যে রয়েছে কলকাতা, ভারতের অন্যান্য শহর, বাংলাদেশ, ইজিপ্ট, আমেরিকা। অনুষ্ঠান করতে গিয়ে দেখেছি বিদেশিদের মধ্যে অনেকে জানেই না, রবীন্দ্রনাথ এতগুলো গান কম্পোজ করেছেন এবং সেগুলো এই ধরনের কম্পোজিশন। একবার কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে আমরা পারফর্ম করছি। সেখানে অধিকাংশই বিদেশি শ্রোতা। আমরা গানের কথার অনুবাদ রেখেছিলাম ব্রশিওরে। অনুষ্ঠানের শেষে ওঁদের প্রশ্ন ছিল, গান তো রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, সুর কার ? রবীন্দ্রনাথ নিজেই সুর সৃষ্টি করেছেন শুনে ওঁরা রীতিমতো চমৎকৃত !”
প্রবুদ্ধর আক্ষেপ, বিদেশে যাঁরা অনুষ্ঠান করতে গেছেন, তাঁরাও সেভাবে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির বৈচিত্র্য ও বৈভব তুলে ধরেননি। কিছু চেনা গান আর শ্যামা-চিত্রাঙ্গদার মধ্যে আটকে থেকেছেন। তাঁর কম্পোজিশনের বৈশিষ্ট্য, এই যে, না ইস্টার্ন, না ওয়েস্টার্ন–এটা এত ইউনিক। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যত ভিন্ন ভিন্ন দেশ ও জাতির কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে, তত ওঁদেরও চর্চার, জানার আগ্রহ বাড়বে। একই কথা ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। “আমাদের আগামী প্রজন্ম, যাঁরা মিউজিক নিয়ে সিরিয়াস, তাঁরাও হয়তো একইভাবে বিস্মিত হবেন, এই তথ্যগুলি জানতে পারলে–রবীন্দ্রনাথের কম্পোজিশনে কোন মাত্রার পরীক্ষা-নিরীক্ষা রয়েছে ! আজও তিনি আধুনিকতার শেষ কথা কেন ?”–মননশীল শিল্পীর বিশ্বাস ও অনুভব !
পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রসঙ্গেই প্রবুদ্ধর বক্তব্য, “রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে তথাকথিত যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তার কিন্তু কোনও দরকার নেই। যেটা উনি করে দিয়ে গেছেন, তার মধ্যেই নিজস্বতা দেখানো সম্ভব। আর একটা কথা, সেই কয়েকটি চেনা গানের মধ্যে বিচরণ সকলের। অথচ, তার বাইরেও কত ভালো ভালো গান রয়েছে। অল্পশ্রুত গান মানেই কিন্তু নিরস, শক্ত ভাব ও সুর এমন নয়। গানগুলো গেয়ে পরিচিত করাতে হবে শ্রোতার কাছে। আমি নিজে সব অনুষ্ঠানে চেনা গানের সঙ্গে তিনটে অন্তত অল্পশ্রুত গান গাই। গানগুলো সম্পর্কে বলে দিই। মনের মধ্যে এই ভাবনা থাকে, লোকজন শুনুক না শুনুক–আমি গাইবো। মজার কথা হলো, লোকে কিন্তু শোনে। বারবার করে ওই তিনটে গান যদি আমি গাইতে থাকি, ছয় মাস পর কিন্তু গানগুলো পরিচিতি পেয়ে যায়।”
সবশেষে বললেন,”রবীন্দ্রনাথের গান কোনদিন বন্ধ হবে না–এটা বলে দায়িত্ব শেষ হয় না। তার জন্য এগিয়ে এসে কিছু করা দরকার। বিদেশে গাইতে গিয়ে ওয়ার্কশপ করার সময় দেখেছি, ভালো করে বোঝাতে পারলে, ইয়ং জেনারেশন কিন্তু গ্রহণ করে। তবে, শিল্পী বা প্রশিক্ষক হিসেবে আমাকেও ঠিকঠাক গানটা গাইতে হবে। আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অন্তত ৩০-৩৫%কে দেখেছি সিরিয়াস। তারা মন দিয়ে শেখে। তারা অন্য গানও শোনে। আমি মনে করি না, এতে কোনও বাধা আছে। সব ধরনের গান শুনলেই তো বুঝবে রবীন্দ্রসংগীতের মাহাত্ম্য। বেশি মানুষের কাছে বেশি বেশি গান ছড়িয়ে দিতে হবে। উনি তো ওঁর সৃষ্টির ভান্ডার অকৃপণ উল্লাসে সমৃদ্ধ করে দিয়ে গেছেন। বাকিটুকু আমাদের করার দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পারলেই পরের প্রজন্মের হাতে ব্যাটন তুলে দেওয়ার অধিকারী হবো আমরা।”