রবীন্দ্রসংগীতের কর্মশালা
সম্প্রতি কলকাতার নেহরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম একটি রবীন্দ্রসংগীত কর্মশালার আয়োজন করে। কর্মশালার বিষয় ছিল, ‘সুরের সঙ্গ ও অনুষঙ্গ–রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান’। প্রশিক্ষক ছিলেন প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী ও শিক্ষক অগ্নিভ বন্দোপাধ্যায়। কর্মশালায় সূচনা পর্বে তিনি আলোচনা করলেন, রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান বলতে কি বোঝায়। আলোচনা প্রসঙ্গে যা উঠে এলো, তা হলো, রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর মৌলিক সংগীত চিন্তারই প্রকাশ।
সংগীতের বিশাল জগতে রয়েছে নানা সুরের ধারা আর সেই সূত্রেই বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের সংগীতের যে বিশাল ও বিচিত্র সৃষ্টি তা কোনওভাবেই শিকড়হীন নয়। রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় তথা বিশ্বসংগীত থেকে রস গ্রহণ করে তার সবটুকু আত্মস্থ করেই নিজস্বতা দিয়ে সংগীত সৃষ্টি করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান বলতে, অন্যান্য ধারার গানের সুরের চলনটি গ্রহণ করে নিজস্ব সংগীতবোধ দিয়ে নিজের গান সৃষ্টি করেছেন। এক্ষেত্রে মূল কথাটিই হলো ‘relation between the notes’। অর্থাৎ, সুরের উৎস (source) থেকে গ্রহণ (adoption) করে নতুন সৃষ্টি (creation) করেছেন।
এককথায় বলতে গেলে, রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান মূল গানের সুরের কাঠামোর ওপরে শুধু কথা নয়, সেই মূল সুরের অনুষঙ্গে, তাঁর কথা (বাণী) ও ভাব-সঙ্গ দিয়ে যথার্থ মেলবন্ধন ঘটিয়ে তাঁর নিজের সৃষ্টি হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদ, ধামার, টপ্পা, ঠুংরি, কীর্তন, প্রাদেশিক (পাঞ্জাবি, দক্ষিণী ইত্যাদি), লোকগান ও বিদেশি সুর থেকে সুরের চলন নিয়ে ২৩২টি (মতান্তরে ২৩৪টি) ভাঙা গান সৃষ্টি করেন। এমনকি, সেতার ও সরোদের গৎ থেকেও (এসো শ্যামল সুন্দর ) গানে সুরসৃষ্টি করেছেন তিনি।
এদিন অগ্নিভ বন্দোপাধ্যায় বেশ ক’টি ভাঙা গানের মূল গান ও রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট গানের উদাহরণ দিয়ে সেগুলি ছাত্রছাত্রীদের শিখিয়ে দেন। সঙ্গে সেই গানগুলোর প্রেক্ষিত ও সেই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তাও ব্যাখ্যা করেন। যেমন ধ্রুপদাঙ্গের মূল গান ‘রুদ্রদেব ত্রিনয়ন / অরুণ জটাজূট…’ আড়া চৌতালে বাঁধা মূল গানটি থেকে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করলেন, ‘শুভ্র আসনে বিরাজ অরুণ ছটা মাঝে…’। ‘মহারাজ কি বড়িয়া আঁখো সে রস কি বুঁদ পড়ে…’ মূল গানের থেকে ভাঙা গান ‘খেলার সাথী বিদায়দ্বার খোলো…’। মালকোষ রাগে শাস্ত্রীয় সংগীত ‘লাগি মোরি ঠুমকো পালাঙ্গনা / রি ননদিয়া ঘর বিরানা…’থেকে মিশ্র মালকোষে সৃষ্টি করলেন অতি পরিচিত গান ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে…’।
ছিল আরও কিছু উদাহরণ। ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকে ‘ওই দেখা যায় বাড়ি আমার, চৌদিকে মালঞ্চ বেড়া…’ এই টপ্পা রচনা করেন গোপাল উড়ে। এর থেকে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন, ‘ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে / আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে…’। অন্যদিকে দাদরা তালে গগন হরকরা রচনা করেন বাউল গান, ‘ও মন অসার মায়ায় ভুলে রবে / কতকাল এমনি ভবে’, যার থেকে রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়বো না মা…’। আবার নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘জনা’ নাটকে দাদরা তালে পুরাতনী গান ‘হামাদে পালায় পাছু ফিরে চায় / রানী পাছে তোলে কোলে’, যার থেকে ভাঙা গান ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে…’।
এছাড়া বিদেশি সংগীত দ্বারাও তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মূলত স্কটিশ, আইরিশ ও ইংলিশ গানের সুরের চলন থেকে তার বেশ কিছু ভাঙা গান সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে ‘Whats this time down to me…’, এই স্কটিশ গানটি থেকে কালমৃগয়া গীতিনাট্যের ‘সকলি ফুরাল হায়…’, আইরিশ মেলোডি ‘Go where glory waits thee…’ থেকে ‘আহা আজি এ বসন্তে…’। আর এই বিদেশি সুরের ভাঙা গানের মধ্যে ইংলিশ গান The British Grenadiers song, ‘Some talk of Alexander and some of Hercules…’, যার থেকে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেন ‘কালমৃগয়া’ গীতিনাট্যের গান ‘তুই আয়রে কাছে আয়, আমি তোর সাজিয়ে দি…’। আর প্রাদেশিক সুরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দক্ষিণী সুরে রাগ গমকক্রিয়া ও আদি তালে নিবদ্ধ ‘মীনাক্ষী মে মুদম দেহি…’, এই সুরের আধারে রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান ‘বাসন্তী, হে ভুবনমোহিনী…’।
কর্মশালায় এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মূল গান শেখানো হয়। দ্বিতীয় দিনের শেষে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের শংসাপত্র দেওয়া হয়। একটি সুন্দর মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে দুদিনের এই কর্মশালা সমাপ্ত হয়।