রাজনৈতিক দুর্যোগে উপদ্রুত শৈশবের গল্প
দুই শিশুর চোখ দিয়ে বড়দের পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রহসনের এমন অনবদ্য ইন্টারপ্রিটেশন বাংলা সিনেমার ইতিহাসে বিরল। ‘দোস্তজী’ নিয়ে লিখেছেন প্রিয়রঞ্জন কাঁড়ার।
মাস ছয়েক হল বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। উত্তাল ভারত। দু’টি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একে অপরের উপর পেশীশক্তির আস্ফালন প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা চলছে। এই বাংলার মুসলিম অধ্যুষিত একটি গ্রামের সংখ্যালঘু হিন্দুরা উপলব্ধি করে, ‘আগুনের মধ্যে জলের ভয় থাকাটা জরুরি’। নিজের উত্তাপ অক্ষুণ্ণ রেখে প্রতিপক্ষকে নিভিয়ে দেওয়ার এই প্রতিযোগিতায় একদিকে পীরজাদা হোসেনের নেতৃত্বে ছোটা বাবরি মসজিদ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। অন্যদিকে সম্মিলিত সীমিত আর্থিক সামর্থ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাম-মন্দির নির্মাণ অসম্ভব জেনেই হিন্দুরা শিবলিঙ্গের পাশে পৃথক বেদি বানিয়ে রাম-সীতার পুজো প্রচলন করার সিদ্ধান্ত নেয়। শ্রীরামচন্দ্রের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে ‘রাম-রাবণের পালা’ আয়োজিত হয়।
এমন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে দুই শিশুর সমান্তরাল শৈশবকে প্রতিষ্ঠা করেছেন পরিচালক প্রসূন চট্টোপাধ্যায়। হিন্দু পলাশ ও তার ‘দোস্তজী’ মুসলিম সোফি। অভিনয়ে আরিফ শেখ ও আশিক শেখ। দু’টি পরিবারের মাঝে ছিটেবেড়ার ফারাক। নির্মম ব্যবধানের সেই প্রাচীরটিও অজস্র ছিদ্রযুক্ত। আর সেইসব ছিদ্রপথই অমলিন শৈশবের বিপুল ভাব-তরঙ্গ প্রবাহের গোপন নদীখাত। পেশাদার অভিনেতাদের মঞ্চের বাইরের অকৃত্রিম রূপ দর্শনের মোহে দুই শিশু যাত্রাপালার সাজঘরে ঢুকে পড়ে হতবাক হয়ে যায়। মঞ্চের শত্রু রাম-রাবণ পরম হৃদ্যতায় ধূমপানে ব্যস্ত। সীতাবেশী পুরুষ অভিনেতাটিও সুখটানে নিয়োজিত। তাঁরাই দুই শিশুর কাছে ফাঁস করে দেন প্রাপ্তবয়স্কদের জীবনের আদি রহস্য, “আমরা সবাই সবার বন্ধু, পেটের টানে শত্রু সাজি।”
বড়দের উত্তপ্ত পৃথিবীই শৈশবের নিস্তরঙ্গ বন্ধুত্বকে নানা অগ্নিপরীক্ষার সামনে ফেলে দেয়। শিশুসুলভ সারল্যে তারা যখন মসজিদ তৈরির জন্য সংরক্ষিত বালি দিয়ে ঝুলন সাজানোর চেষ্টা করছে, তাদের অভিভাবকরা তখন অস্তিত্বের সংগ্রামে নানা ফন্দি-ফিকির আঁটতে ব্যস্ত! জাগতিক হিসেব-নিকেশে অনভ্যস্ত এক পাগল মসজিদের মাটিতেও পড়ে থাকে, আবার খাদ্যের লোভে যাত্রা প্রাঙ্গণেও উপস্থিত হয়।
বড়দের শেখানো জগত প্রগাঢ় ছায়া বিস্তার করে শৈশবের চেতনায়, “জাহান্নাম মেলা দূর, সে কঠিন জায়গা। আব্বা বলে, ইবলিশদের জায়গা।” জীবনের ওপার থেকে ডাক আসে পলাশের জন্য। সোফি একা হয়ে পড়ে। দুই বন্ধু মিলে যে শুঁয়াপোকাকে বন্দি বানিয়ে পুষেছিল, পলাশের মৃত্যুর পর প্রজাপতির রূপে সে মুক্তি পায় সোফির হাতে!
বাস্তবানুগ অভিনয়, বাহুল্য-বর্জিত দৃশ্যভাবনা, অনবদ্য লো-লাইট কম্পোজিশন এই ছবির সম্পদ। ছবি জুড়ে অসংখ্য সফল দৃশ্যকল্প, এবং সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে নিবিড় যোগসূত্র ছবিটিকে ভিন্ন মাত্রায় উত্তীর্ণ করেছে। মূলত দুই শিশুর চোখ দিয়ে বড়দের পৃথিবীর সমস্ত আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রহসনের এমন অনবদ্য একমেবাদ্বিতীয়ম ইন্টারপ্রিটেশন বাংলা সিনেমার ইতিহাসে বিরল।
অভিনয়ে আরিফ শেখ, আশিক শেখের কথা আগেই বলেছি। অন্যান্যদের মধ্যে আছেন জয়তী চক্রবর্তী (পলাশের মা), স্বাতীলেখা কুন্ডু (সোফির বোন), অনুজয় চট্টোপাধ্যায় (প্রাইভেট টিউটর) প্রমুখ। সিনেমাটোগ্রাফার তুহিন বিশ্বাস। সম্পাদনা সুজয় দত্ত রায় ও শান্তনু মুখার্জি। ডিআই কালারিস্ট মানস ভট্টাচার্য। ভিএফএক্স রাজীব পাল। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সাত্যকি ব্যানার্জি। সাউন্ড ডিজাইন প্রসূন চট্টোপাধ্যায় ও রোহিত সেনগুপ্ত। সাউন্ড মিক্সিং অনির্বাণ গাঙ্গুলি।