Monday, February 3, 2025
দর্পণে জীবনপ্রাণের মানুষ

রাত-ট্যাক্সির গপ্পো

লিখেছেন চয়নিকা বসু

সংবাদপত্রের জগৎ, নিত্যকাজের রুটিনে সবসময়ই চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জের সব থেকে বড় শর্ত, অফিসে ঢোকা ও বেরোনোর নির্দিষ্ট সময় না থাকাটা মেনে নেওয়া। এই মেনে নেওয়াটাও একসময় অভ্যাস হয়ে যায়। অভ্যাস ও সেইমতো যাতায়াত ব্যবস্থা করে নেওয়ার পরেও মাঝে মাঝে বেশ বিপাকে পড়তে হয়। তেমনই একদিন–নানা কারণে একটু বেশি রাত হয়ে গেছে। ফেরার জন্য ট্যাক্সি ছাড়া গতি নেই। তখনও ওলা-উবের জাঁকিয়ে অধিকার করেনি কলকাতার রাস্তা। ফলত, হলুদ ট্যাক্সির রোয়াবই আলাদা।

অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় এলাম। শুনশান রাস্তা। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায়। আমি দ্রুত এগিয়ে দরজা খুলে ট্যাক্সিতে উঠে বলি, বাঘাযতীন চলুন। ড্রাইভার ভাঙা বাংলায় জানান, যাবেন না। মানে ? মরিয়া আমি বলি, যাবেন না তো গাড়ি রাস্তায় বের করেছেন কেন ? তারপর, একটু জোর দিয়ে বলি, যেতে তো হবেই। উঠে যখন পড়েছি, তখন আর নামবো না। মনে মনে ভাবছি, একটু বেশি চাইলে না হয় দিয়ে দেব। কোথায় কি? ড্রাইভার গোঁ ধরে বসে থাকেন। ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়েছে আমাদের অফিসের গলি থেকে একটু এগিয়ে। জায়গাটা অন্ধকার। চারপাশে একটিও লোক নেই। অসহায়তা থেকেই ভীষণ একটা রাগ হয়ে যায়। আমিও গ্যাট হয়ে বসে থাকি। এবং ঘোষণা করি, ঠিক আছে। আমিও বসে রইলাম। সারারাত হলে সারারাত !

কিছুক্ষণ পর নড়েচড়ে বসেন ড্রাইভার। অনুনয়ের ভঙ্গিতে আমাকে বোঝানো শুরু করেন। রাত হয়েছে । তাই আর কোনও ভাড়া তিনি খাটবেন না। ভবানীপুরে গাড়ি গ্যারেজ করে (ওখানেই ওঁর ঘর) শুয়ে পড়বেন। একজন প্যাসেঞ্জার নামিয়েছেন এখানে একটু আগে। তারপর একটা হোটেলে খেয়ে সামান্য বিশ্রামের জন্য গাড়ি পার্ক করেছিলেন। আমি দয়া করে নেমে গেলে, ঘরে ফিরতে পারেন। দয়া ? মনে মনে ভাবছি, আমায় কে দয়া করে তার ঠিক নেই ! আদৌ বাড়ি ফিরতে পারবো কিনা, জানি না। না পারলে অফিসে থাকতে হবে। তখনও পর্যন্ত আমাদের অফিসে পৃথক লেডিজ টয়লেট ছিল না। অফিসে থাকাটা অসম্ভব ব্যাপার! সেই সকালে এসেছি। বাড়ি আমাকে ফিরতেই হবে। 

অসহায়ত্ব বোধ থেকেই বোধহয় মানুষ নিষ্ঠুর আচরণ করে। আমি কঠোর স্বরে বললাম, দেখো তুমি ( কথার শুরুটা করেছিলাম ‘আপনি’ সম্বোধনে, এখন রেগে ‘তুমি’) যদি না যাও, আমার যা হওয়ার হবে। কিন্তু তোমারও ঝামেলা আছে। এত রাত (তর্ক-ঝগড়ায় আধ ঘন্টা পার করে ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর ছুঁয়েছে)। নির্জন রাস্তা। আমার কিছু হলে পুলিশ কিন্তু তোমায় ধরবে ! লোকটা এটা ঠিক আশা করেননি। “কিঁউ ? হামে কিঁউ ? ম্যায় তো আপ কো কব সে উতরনে কে লিয়ে বোল রহা হুঁ !” উত্তেজনায় মুখ দিয়ে মাতৃভাষা বেরিয়ে আসে বেচারার।

শেষে বেজার মুখে ট্যাক্সিতে স্টার্ট দেন তিনি। পুরো রাস্তায় একটিও লোক নেই। এবার কিছুটা ভয় ভয় করতে শুরু করে। লোকটা আমার ওপর রেগে আছেন প্রবলভাবে। কিছু করলে, গায়ের জোরে পেরে উঠবো না। ছিনতাইয়ের ভয় করি না। সঙ্গে সামান্যই টাকা আছে, আর হাতের ঘড়িটা। সেলফোন তখনও অঙ্গের ভূষণ হয়নি আমাদের। ভাবতে, ভাবতেই পার হয়েছি ধর্মতলা মোড়। হঠাৎ ট্যাক্সি থামে। নাহ, অন্য কিছু নয়। সামনে পার্ক স্ট্রিট ক্রসিং। লালবাতি জ্বলে আছে। ঠিক তখনই ড্রাইভার বলে ওঠেন, রাতে খুব ট্যাক্সি ছিনতাই হয় জানেন ? ওই জন্যই ভয় পাই ওদিকটা যেতে। আমি হেসে বলি, আমাকে কি আপনার ছিনতাইবাজ মনে হলো ? এবার তিনিও হাসেন। বলেন, না। তবে আপনি খুব রাগী আছেন !

একটু সহজ হওয়ার জন্য কথা বলতে শুরু করি। জানতে পারি, ওঁর দেশ বিহারের ছাপড়ায়। ঘরে মা-বাবা, বউ-বাচ্চা। এক ছেলে, এক মেয়ে। তারপর  উদাসীন বিষণ্ন কণ্ঠে জানান, বাবুজি ক্ষেতে চাষ করে। ভুট্টা, আনাজ আর কিছু ফলের গাছও আছে। বছরে একবার বাড়ি যান। এর মধ্যে পার্ক স্ট্রিট ক্রসিং ছেড়ে ট্যাক্সি বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড ধরেছে। নিশুতি রাতকে আরও একটু নিঝুম করে কেমন এক ভেজা গলায় বলেন, জানেন দিদি, আমার মা এখনও আমি কলকাতায় আসার সময় কাঁদে। সেই প্রথমবার যেমন কেঁদেছিল। আমি তখন এইট ক্লাস পাশ করে, কাকার সাথে আসি এখানে। টাকার দরকার। সেবার বৃষ্টিতে আমাদের সব ফসল নষ্ট হয়ে গেল ! এখন বড় হয়েছি। বিয়েশাদি হয়েছে। বাচ্চারাও এখন ইস্কুলে যায়। মাকে কে বোঝায় !

চুপ করে যায় সে। আমিও চুপ। সারা পৃথিবীটাই যেন চুপ। শুধু ইঞ্জিনের শব্দ। বাড়ির দরজায় নেমে বলি, ভাই, কিছু মনে রাখবেন না। আমারও আপনাকে জোর না করে উপায় ছিল না আজ। ব্যাগে সামান্য যতটুকু বেশি টাকা ছিল, মিটার ছাড়া সেটা দিতে গেলে কিছুতেই নেবেন না । বলি, তাহলে ভাববো, আপনি রেগে আছেন আমার ওপর। এরপর হাত পেতে টাকাটা নিয়ে নমস্কার জানিয়ে চলে যান। নির্জন রাস্তায় ক্রমে মিলিয়ে যায় তার ট্যাক্সির আওয়াজ। ঘরে পৌঁছই বিষণ্নতাকে সঙ্গী করে।