রান্না নয়, ভোজনেই সুখ
জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে নিজেই সে নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে।
অজন্তা সিনহা
ফেসবুক ইউটিউবে সবাই কি সুন্দর রেসিপি দেন। আমার ফেসবুক বন্ধু রিঙ্কু মিত্রের তো দারুন হোম ডেলিভারির ব্যবসা। নিত্যনতুন রান্নার ছবি দেয় সে। আমার ঢালাও ও স্থায়ী নেমন্তন্নও আছে তার বাড়িতে। এখনও যাওয়া হয়নি। চলে যাব যে কোনও দিন। আমার ভাই, সঙ্গীতশিল্পী দেবমাল্য চট্টোপাধ্যায়ের রান্নার গুণ তো সর্বজনবিদিত। কলকাতায় গিয়ে তার বাড়িতে ওঠা এবং চর্বচোষ্য সেবন আমার ইদানীংকার প্রথাগত রুটিন। আমার প্রতিবেশী সোনিয়া, পেশায় স্কুল শিক্ষক। তারও ইউটিউবে একটি রান্নার চ্যানেল আছে। নিয়মিত লোভনীয় ডিশের লিঙ্ক পাঠায় সে আমায়। ফেসবুকে সকলেই দারুণ সব পদ বানিয়ে ছবি পোস্ট করে। দেখেই জিভে জল এসে যায়। আমারও এমন ইচ্ছে হয় না, তা নয়। তবে, রান্নার সঙ্গে আমার যোগসূত্রটা বড়ই ক্ষীণ। রোজকার ডালভাতটা চালিয়ে নিই, এই পর্যন্ত।
আমার মা ছিলেন এককথায় রন্ধনপটিয়সী। সবজি কাটতেন শিল্পচর্চার মতো। স্কুলে চাকরি করতেন। খুবই ব্যস্ত থাকতেন। বাড়িতে তখন পরিচারিকা রাখার ক্ষমতা ছিল না। মনে পড়ে, স্কুল থেকে এসে কোনও রকমে জামাকাপড় ছেড়েই রান্নাঘরে ঢুকতেন। তারপরও অমন মহার্ঘ রান্না। সবজির খোসাটা পর্যন্ত বেটে, তাকে কি যে সুস্বাদু করে তুলতেন কি বলবো ! আমার বোনও খুব ভালো রান্না করে। এখন আর মা রান্নাঘরে যান না। বয়স হয়েছে। ভাইয়ের বউই রান্না করে। সেও ভালোই রাঁধে। রান্নার ব্যাপারে আমি হলাম আমার পরিবারের নিকৃষ্টতম সদস্য।
খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি যাই। ওই ডালভাতটুকু সেখানে গিয়েই শেখা। আমার শাশুড়ি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই মাটির মানুষ। বিয়ের আগে মা হাজার চেষ্টা করেও আমাকে রান্নাঘরে আকর্ষিত করতে পারেননি। ভয় দেখাতেন, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বিপদে পড়বি। কিসের বিপদ ? আমি প্রায়ই উল্টোপাল্টা কান্ড করতাম, আর আমার শ্বাশুড়ি বলতেন, প্রথম প্রথম সবারই ওইরকম হয়। তাঁর প্রশ্রয়ে সেই প্রথমাবস্থা কাটতে অনেকদিন লেগে গেল আমার। যেদিন প্রথম সফল শুঁটকি মাছ রান্না করতে পারলাম, সেদিন আমার বিশ্বজয় ! আমি দুদিকেই কাঠ বাঙাল। তবে, শুঁটকি মাছ খেতে ও রাঁধতে শেখা শ্বশুরবাড়ি গিয়েই। একদিন, বড় ননদাই আমার রান্না বাঁধাকপির তরকারি খেয়ে বললেন, নাঃ, এবার বুলা (আমার ডাকনাম ) রান্না শিখে গেছে। রান্না বিষয়ে আমার সার্টিফিকেট পাওয়ার ঘটনা এতই কম যে, যতটুকু ঘটেছে, তা জীবনখাতার প্রতি পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা।
সাংবাদিকতায় একটু আধটু নাম হয়েছে তখন। এদিকে রবীন্দ্রসংগীতের একটা ব্যাকগ্রাউন্ডও ছিল। একটা চ্যানেলে টিভি শো হোস্ট করছি। সব মিলিয়ে কিছুটা পরিচিতি হয়েছে। সেই সময় একটি বাংলা চ্যানেলের একটি জনপ্রিয় কুকারি শো-তে আমাকে ডাকলো, অতিথি হিসেবে। চিকেনের একটা (ওই একটাই স্পেশাল ডিশ জানতাম) প্রিপারেশন করেছিলাম সেখানে। শো টেলিকাস্ট হওয়ার পর সেটা দেখে আমার মা বললো, তুই টিভিতে রান্না করছিস, আর সেটাও আমাকে দেখতে হলো ? যাকে বলে, পুরো প্রেস্টিজ পাংচার। শ্বাশুড়ি গত হয়েছেন ততদিনে। উনি বেঁচে থাকলে কিন্তু দিব্যি খুশি হতেন ! আমার প্রতি ওঁর ভালোবাসাটা ছিল ফল্গুধারার মতো। বয়েই চলতো। এটা ঠিক ওই বিশেষ আইটেমটি এরপর অনেককে করে খাওয়াতে হয়। মোটামুটি উৎরেও যাই। বারদুয়েক অফিসেও বানিয়ে নিয়ে গেছি। এটা হলো, যাকে বলে, প্রচারের মহিমা। ওই যে টিভিতে দেখিয়েছে।
আমি আদতে একজন ভোজনরসিক মানুষ। যেমন ‘টি টেস্টার’ থাকে, খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে আমি ঠিক সেই কাজটাই নিখুঁতভাবে করতে পারি। শুক্তো থেকে চাটনি, এপার ও ওপার বাংলা, এই রাজ্য, ভিন রাজ্য, ভারতীয় বা অভারতীয়, সব পদেই আমার বিলক্ষণ রুচি বর্তমান। আমি যে খেতে ভালোবাসি, তা আমার ভালোবাসার মানুষরাও জানে। তারা আমায় পাত পেড়ে খাইয়ে সুখ পায়। আমি নির্দ্বিধায় তাদের সুখী করি। আর নিজেও সুখী হই। এই ডায়েটিং বেলাতেও খুব আহামরি নিয়ম মেনে চলা ঘটে না আমার। রোজ প্রতিজ্ঞা করি, রোজ ভাঙি। দিনের শেষে নিজেকে ক্ষমা করে বলি, খেয়ে নাও দু’দিন বই তো নয় !!