শতবর্ষে মৃণাল
সৃষ্টির চালচিত্রে তাঁকে নিয়ে বাংলার তিন পরিচালক। লিখেছেন সোমনাথ লাহা।
বাংলা চলচ্চিত্র তথা ভারতীয় ছবির জীবনবোধসম্পন্ন, নান্দনিক চালচিত্রকে যিনি অনন্যতা দান করেছেন, তিনি মৃণাল সেন। পাঁচের দশক থেকেই সিনেমা পরিচালনা করতে শুরু করেন তিনি। বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের অপর দুই মহীরুহ সত্যজিৎ রায় আর ঋত্বিক ঘটকের সমসাময়িক তিনি। ১৯৬৯-এ তাঁর পরিচালিত হিন্দি ছবি ‘ভুবন সোম’ আক্ষরিক অর্থে ‘নিউ ইন্ডিয়ান সিনেমা’-র সূচনালগ্নের ছবি হিসেবে স্বীকৃত। অবশ্য তার ঢের আগেই বাঙালি দর্শক মজেছিল মৃণাল সেনের সিনেমায়। তর্ক করেছিল সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের ছবি নিয়ে। পুরনো ফিল্ম ম্যাগাজ়িনের পাতা উল্টোলে জানা যাবে, কী বিপুল আলোচনা হয়েছিল মৃণাল সেনের তৈরি ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘আকাশকুসুম’ বা ‘ইন্টারভিউ’ নিয়ে।
ছয় ও সাতের দশকে ভারতীয় সিনেমায় ‘নিউ ওয়েভ’ আসে। মৃণাল সেন ছিলেন এই ধারার জন্মদাতাদের অন্যতম। নতুন থিম, নতুন টেকনিক এবং নতুন রাজনীতির খোঁজ ছিল তাঁর ছবিগুলির অভিজ্ঞান। সেই সময়ে উঠে আসেন একঝাঁক নতুন পরিচালক। যাঁরা নিজেদের সত্যজিৎ রায়-উত্তর প্রজন্ম বলে মনে করতেন। এঁরা ভারতীয় সিনেমাকে একটা নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেই পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন আদুর গোপালকৃষ্ণন, শ্যাম বেনেগাল, কুমার সাহানি, মণি কাউলের মতো পরিচালকরা। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকা তাঁদের ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায় এই ধারার ছবিগুলি কী ভাবে প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছিল।
নিউ ওয়েভের অন্যান্য পরিচালকদের তুলনায় মৃণাল বয়সে খানিক বড় ছিলেন। তবে, তারুণ্যের দীপ্তিতে ঘাটতি ছিল না। তাঁর ছবির মধ্যে যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ছিল, ছিল পুরনো ধ্যানধারণাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার খামখেয়ালি আকস্মিকতা–সেগুলোই তাঁকে আলাদা করেছিল সত্যজিৎ রায়ের নেহরু-যুগের ইতিবাচকতা বা ঋত্বিক ঘটকের দেশভাগ-উত্তর যন্ত্রণাবোধ থেকে। বাংলা এবং হিন্দি ভাষার পাশাপাশি মৃণাল সেন ওড়িয়া ও তেলুগু ভাষায় একটি করে ছবি তৈরি করেছিলেন। প্রসঙ্গত, শুধুমাত্র বাঙালি লেখকের রচনাতেই থেমে থাকেননি তিনি। বনফুল, সমরেশ বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র বা রমাপদ চৌধুরীর গল্প নিয়ে যেমন ছবি করেছেন, তেমনই ১৯৫৮-তে তাঁর তৈরি ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’ তৈরি করেছিলেন মহাদেবী বর্মার লেখার কাহিনির উপর ভিত্তি করে। ‘মাটির মনিষ’ (ওড়িয়া, ১৯৬৬) আর ‘মৃগয়া’-র জন্য যথাক্রমে ওড়িয়া লেখক কালিন্দীচরণ পানিগ্রাহী আর ভগবতীচরণ পানিগ্রাহীর গল্প ব্যবহার করেছিলেন। ‘ওকা উরি কথা’ (তেলুগু, ১৯৭৭) তৈরি করেছিলেন মুন্সি প্রেমচাঁদের হিন্দি গল্পের ভিত্তিতে। ‘অন্তরীণ’ (১৯৯৩)-এর পিছনে ছিল সাদাত হাসান মান্টোর ছোটগল্প।
উল্লেখযোগ্য, তাঁর ছবির লোকেশন হিসেবে মৃণাল সেন বেছে নিয়েছিলেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে–গুজরাত, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের নানান ছোট শহর। তার পাশাপাশি কলকাতা তো বটেই। দীর্ঘ ফিল্মজীবনে মৃণাল সেন বানিয়েছেন মোট ২৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি, ১৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি, পাঁচটি তথ্যচিত্র। পেয়েছেন বহু পুরস্কার, সন্মান। যায় মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। রাজ্যসভায় সাম্মানিক সাংসদ মনোনীত হয়েছেন (১৯৯৮-২০০৩)। ফরাসি সরকার দিয়েছে কম্যান্দর দ্য লর্দর দেজ়ার্ত এ লেত্র (Commandeur de l’ordre des Arts et letters)। রুশ সরকার দিয়েছে অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব দ্য ফিল্ম সোসাইটিজ়-এর সভাপতি ছিলেন মৃণাল। কান, ভেনিস, বার্লিন, মস্কো, কার্লভি ভারি, টোকিও, তেহরান, মানহেইম, নিয়ন, শিকাগো, গেন্ট, টিউনিস ও ওবরহাউসেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আন্তর্জাতিক জুরির সদস্য ছিলেন।
ফিল্ম সোসাইটির সক্রিয় কর্মী ছিলেন মৃণাল সেন। ১৯৬৮ সালে ফিল্ম সোসাইটির সহকর্মী অরুণ কাউলের সঙ্গে তিনি তৈরি করেন ভারতীয় নিউ সিনেমা মুভমেন্টের ইস্তেহার। বলেছিলেন, নিউ সিনেমাকে চিন্তা-আধিপত্যের প্রতিস্পর্ধী অবস্থানের কথা বলতেই হবে। তার জন্য নতুন পদ্ধতি প্রয়োজন, পরীক্ষানিরীক্ষা প্রয়োজন। বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ার ঝুঁকিও নিতে হবে। সত্যি কথা বলতে, মূলধারার দর্শকের চোখে মৃণাল সেনের কিছু সিনেমা দুর্বোধ্য ঠেকেছে, শ্লথ মনে হয়েছে। কিন্তু, কিছু ক্ষেত্রে সমসাময়িক ইতিহাসের ওলটপালট দর্শককে টেনে এনেছে। তাঁর কলকাতা ট্রিলজি-তে (ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১ আর পদাতিক) এমন বেশ কিছু ফুটেজ ব্যবহৃত হয়েছে, মৃণাল সেন যা তুলেছিলেন একেবারে জ্বলজ্যান্ত বাস্তব প্রেক্ষিতে।
মৃণাল সেনের শিকড় বাংলায় থাকলেও, তাঁর তৈরি সিনেমা ছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির বোধে ঋদ্ধ। তাঁর ছবির সমসময়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় যে সব ঘটনা ঘটেছে—যেমন ভিয়েতনাম বা লাতিন আমেরিকায় যুদ্ধ—মৃণাল সেন নিজের ছবিতে সেই সব ঘটনার ডকুমেন্টারি ফুটেজ ব্যবহার করেছেন আশ্চর্য দক্ষতায়। তাঁর ছবিতে ভারত সব সময়ই আন্তর্জাতিক ঘটনাক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে একটা বই লিখেছিলেন মৃণাল সেন। তাঁর দীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনে মৃণালও খানিকটা চ্যাপলিনের মতোই। বেপরোয়া, কৌতুকময় এবং নিয়ম-ভাঙা এক শিল্পী।
আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩-এ এই মহান পরিচালকের জন্মশতবর্ষ। তাঁর জন্মশতবর্ষের কথা মাথায় রেখেই শুরু হয়েছে তাঁকে নিয়ে তিনটি ভিন্নরকম কাজ। দুটি সিনেমা ও একটি ওয়েব সিরিজ। গত ১৪ মে মৃণাল সেনের ৯৯তম জন্মদিনে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় ঘোষণা করেন একটি কাল্পনিক বায়োগ্রাফিক সিরিজের। যেটির নাম তিনি দিয়েছেন ‘পদাতিক’। সিরিজের পোস্টার সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে ক্যাপশনে সৃজিত লেখেন, সেই লকডাউনের সময় থেকেই আজকের দিনটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সেই দিনটা এলো। অবশেষে ওয়ার্ল্ড সিনেমার বিশ্ববরেণ্য পরিচালকের জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি আমার বিশেষ শ্রদ্ধা। সৃজিতের কথায়, কলকাতা ট্রিলজি-র স্রষ্টার জন্মশতবর্ষ আগামী বছর। আর সেই বিশেষ মুহূর্তে কলকাতা তাঁকে কিছু ফিরিয়ে দেবে না, টলিউড তাঁকে কিছু ফেরত দেবে না–এটাও কী সম্ভব ? তবে কবে থেকে শুরু হবে এই সিরিজের শুটিং আর সিরিজটিতে কারা অভিনয় করছেন, তা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি।
টলিউডের আর এক পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় তৈরি করছেন ‘পালান’ ছবিটি। ১৯৮২-তে মুক্তি পেয়েছিল মৃণাল সেন পরিচালিত ছবি ‘খারিজ’। মৃনালের সেই ‘খারিজ’ ছবির চরিত্রদের ৪০ বছর এগিয়ে নতুন মোড়কে ফিরিয়ে আনতে চলেছেন কৌশিক। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের এই ছবিটিতে রয়েছে সেই ছবির একাধিক চরিত্র।‘খারিজ’-এ যাঁরা অভিনয় করেছিলেন, তাঁরা অনেকেই একই চরিত্রে কৌশিকের ‘পালান’-এও অভিনয় করছেন। ছবির পোস্টারও করা হয়েছে ‘খারিজ’ ছবিটির আদলে। ছবিতে মুখ্য চরিত্রে রয়েছেন অঞ্জন দত্ত, শ্রীলা মজুমদার ও মমতা শঙ্কর। এছাড়াও এই ছবিতে অভিনয় করতে দেখা যাবে যীশু সেনগুপ্ত ও পাওলি দামকে। ‘খারিজ’-এ হরির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত। কৌশিকের এই নতুন ছবিতে তাঁকেও নতুনভাবে পাবেন দর্শক। ছবিটি প্রযোজনা করছে প্রমোদ ফিল্মস এবং ধর্ম বিগ ডে প্রযোজনা সংস্থা।
আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩-এ ‘পালান’। সৃজিত ও কৌশিক ছাড়াও মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে কাজ করছেন তাঁর মানসপুত্র অঞ্জন দত্ত। যাঁর সিনেমার আঙিনায় পা রাখা মৃণাল সেনের ‘চালচিত্র’ ছবির হাত ধরে। শোনা যাচ্ছে মৃণাল সেন ও অঞ্জন দত্তের ব্যক্তিগত কথোপকথনের উপর ভিত্তি করেই অঞ্জন তৈরি করছেন এই পার্সোনাল ফিচার ফিল্মটি। যদিও এই ছবিটির কাস্টিংয়ের বিষয় সহ, কবে থেকে শুরু হবে এই ছবির শুটিং, তা খোলসা করে জানাননি পরিচালক।
মৃণাল সেনের পুত্র কুণাল সেন তাঁর ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন, “একজন স্বতন্ত্র মানুষ ও পরিচালক হিসেবে বাবা সম্পুর্ণ জীবন কাটিয়েছেন। আমরা তাঁর জন্মশতবার্ষিকীর কাছাকাছি চলে এসেছি। বাবা জীবনে অনেক সম্মান পেয়েছেন। প্রশংসা পেয়েছেন। বাবার জীবন ও সিনেমার উপর নির্ভর করে টলিউডে তিনটি ছবি তৈরি হচ্ছে। আমি এই তিনটি ছবি দেখার জন্য অধীর অপেক্ষায় রয়েছি।” অসংখ্য মৃণাল সেনের অনুরাগী সহ বাঙালি সিনেপ্রেমীরাও নিঃসন্দেহে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় মৃণাল সেনের জীবন সম্পর্কিত ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে নির্মিত এই তিনটি কাহিনি দেখার জন্য।