শিমুলে রাঙানো কাজিরাঙা
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। এই সপ্তাহে কাজিরাঙার বর্ণময় প্রকৃতি নিয়ে শুরু হলো নতুন সিরিজ। লিখছেন মণিদীপা কর।
বনে বনে ফাগুন লাগার খবর তো কোন ছেলেবেলায় জানা। তবে, ফাগুন রঙে আগুন ঝরানো বনপথ–সে দেখার সাধ প্রায় ন’বছর পর পূর্ণ হল। ২০১৩ সালের মার্চে অসমের মানসে গিয়েছিলাম। অল্প কিছুদিনের সেই ট্রিপে সে সাধ পূর্ণ হয়নি। পূর্ণ হলো এবছর ফেব্রুয়ারিতে। ২১ ফেব্রুয়ারির শুভ লগ্নে রাঙাহাসিতে আমাদের স্বাগত জানাল কাজিরাঙা। এখানে আসার পরিকল্পনা হয়েছিল এগারো মাস আগে। তখন চেনাজানা সকলেই হেসেছিল। কিন্তু আমরা জানতাম, শিমুলের ক্যানোপিতে বাঘ, গন্ডার, হাতি, হরিণ, বুনো মহিষকে লেন্সবন্দী করতে দেশ-বিদেশের ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফাররা এই সময়টাকেই বেছে নেন। সেই সঙ্গে প্রথম সারির গাইড কাম জিপসি চালকদেরও। শেষ মুহূর্তে বুকিং পাওয়া তাই অসম্ভব। অগত্যা ওই এগারো মাসের আগাম পরিকল্পনা !
সেই কোন ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি, ভারতে একশৃঙ্গ গন্ডারের জন্য বিখ্যাত অসমের কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যান। বড় হয়ে জঙ্গলের নেশা যখন স্নায়ুতন্ত্রকে আচ্ছন্ন করে ফেলল, তখন দলে শুঁড়ির সাক্ষী বেশ কয়েকজন মাতালও জুটে গেল। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের পোস্ট দেখেই জানতে পারলাম শুধু একশৃঙ্গ গন্ডার নয়, এখানেই রয়েছে ভারতের একমাত্র গোল্ডেন টাইগার। এছাড়াও জীব বৈচিত্রে ভরপুর কাজিরাঙা। ব্রহ্মপুত্র প্লাবিত বিস্তীর্ণ ঘাসজমিতে বাঘ, হাতি, গণ্ডার, হরিণ, বুনো মহিষ বিচরণের ছবি আমাদের পাগল করে দিত। আর পাগল যখন হয়েই গেলাম, তখন সাঁকোও নাড়িয়ে ফেললাম। প্রবীণ ও নবীন নাগরিক মিলিয়ে দলে সদস্য সংখ্যা হলো মোট ১৩ জন। ফলে ঠিক করা হলো, জঙ্গল সাফারির জন্য দুটো গাড়ি নেওয়া হবে।
আমাদের নামার কথা ছিল জঙ্গলের সবচেয়ে কাছের স্টেশন জকলাবন্ধায়। কিন্তু প্ল্যাটফর্ম খুব নিচু হওয়ায় বয়স্কদের জন্য রিস্ক হয়ে যাচ্ছিল। তাই অন্তিম স্টেশন শিলঘাটেই নামলাম। গাড়ি আগে থেকেই বলা ছিল। এরপর গাড়িতে মালপত্র তুলে রওনা। ঘণ্টাখানেকের জার্নি। এদিকে, আগের দিন ২০ ফেব্রুয়ারি, সোমবার কলকাতা স্টেশন থেকে কাজিরাঙা এক্সপ্রেস ঠিক সময়ে ছাড়লেও, পথে লেট করল। ফলে মঙ্গলবার বিকেলের সাফারি মিস করার একটা আশঙ্কা দেখা দিলো। মনে মনে সকলেই সেই নিয়ে আন্দোলিত।
তাড়াতাড়ি যেতে হবে। কিন্তু, যাত্রাপথের ধারে জায়গায় জায়গায় গন্ডার, হরিণ, বুনো মহিষের দর্শন ! ছবি তোলার লোভ সামলানো দায়। ছবি তুলতে গিয়ে হোটেলে পৌঁছতে আরও কিছুটা বিলম্ব হলো। তাই রাস্তা থেকেই ফোন করে মধ্যাহ্ন ভোজের অর্ডার দেওয়ার পর্বটা সেরে নিলাম। এরপর হোটেলে চেক-ইন করে, ঝড়ের গতিতে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং হলের দিকে ছুটলাম। কারণ দেড়টা থেকে শুরু হবে বিকেলের সাফারি।
কাজিরাঙায় সাফারি করা যায় কোহরা (সেন্ট্রাল), বাগোরি (পশ্চিম), আগরতোলি (পূর্ব), বুড়াপাহাড় এবং পানবাড়ি (বার্ড ওয়াচিং) রেঞ্জ-এ। আমরা মোট সাতটা সাফারি করব। প্রথম বিকেলেই গেলাম আগরতোলি অর্থাৎ ইস্টার্ন জোন-এ। এন্ট্রি গেট দিয়ে ঢুকেই প্রথমে একটা গাছের নিচে গাড়ি থামাল আমাদের গাইড কাম ড্রাইভার প্রফুল্লদা (প্রফুল্ল দুয়ারা)। দ্বিতীয় গাড়ির সারথি তকিব আলি। ওই গাছের বড় একটা কোটর থেকে মুখ বের করে আছে তিনটে স্পটেড আউলেট। এরপর একটু এগোতেই পথের ধারে দেখা মিলল মা ও মেয়ে গন্ডারের। মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে মায়ের সঙ্গ ছাড়ার মুখে। তবু ভীত পদচারণায় মায়ের পিছু পিছু আমাদের সামনে দিয়েই রাস্তা পেরিয়ে অন্য পাশে ঘাস খেতে চলল।
সেই শুরু। তারপর গন্ডার দর্শনে আর বিরাম নেই। সঙ্গে হগ ডিয়ার। কয়েকটা বাচ্চা হরিণের গায়ে সাদা ছোপ দেখে ভাবলাম চিতল হরিণ। প্রফুল্লদা ভুল ভাঙাল। বলল, হগ ডিয়ারের বাচ্চার গায়ে ছোপ থাকলেও, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা মিলিয়ে যায়। সেই সঙ্গে জানাল, কাজিরাঙায় চিতল হরিণ একটিও নেই। হগ ডিয়ার, শম্বর, বারো শিঙ্গা ও বার্কিং ডিয়ার–মোট চার রকম হরিণ আছে। প্রথম দিন দেখা না মিললেও পরে বাকি তিন রকম হরিণের দেখা পেয়েছি। একই ফ্রেমে দেখা পেয়েছি, হরিণ, গণ্ডার ও বুনো মহিষের।
তবে, প্রায় ন’বছরের আরও এক প্রতীক্ষার অবসান হলো প্রথম দিনেই। এর আগে, অসমের মানস অভয়ারণ্যে গ্রেট হর্নবিলের ছবি তুলতে গিয়ে বাঘ মিস করেছিলাম। আবার বাঘের উপস্থিতি জানতে পেরে ফসকে গিয়েছিল হর্নবিল। সে আক্ষেপ বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। কিন্তু এবার আশ মিটিয়ে রাজধনেশ দেখা ও ছবি তোলা দুটোই হয়েছে। এছাড়াও উলিনেক, মদনটাক (লেসার অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক), পেলিক্যান, বার হেডেড গুজ, ইন্দো চাইনিজ রোলার (নীলকণ্ঠ)–আরও কত পাখির দেখা মিলল। তবে, একটা সাফারিতেই সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। ঠিক করলাম আর একদিন সকালে ফিরে আসব এই আগরতলী রেঞ্জ-এ।
পরিকল্পনা মতোই ষষ্ঠ সাফারি অর্থাৎ ২৪ তারিখ সকালে ছুটলাম ইস্টার্ন জোন। এদিন আমাদের স্বাগত জানাল এক গ্রে হেডেড ফিশ ঈগল। তারপর একে একে গন্ডার, বুনো মহিষ, হরিণ, পল্লাস ঈগল, এশিয়ান বারড আউল, কচ্ছপ, পায়েড কিং ফিশার, হিমালয়ান গ্রিফেন ভালচার, ওয়াইল্ড বোর দেখা দিল। মা হরিণীর সন্তানকে স্তন্যপান করানোর দৃশ্য যেমন অনাবিল আনন্দ ছড়িয়ে দিল, তেমনই মহিষশাবকের মৃতদেহ ঘিরে কাক-শকুন-বুনো শুয়োরের ভোজ-দৃশ্য বেশ কিছুক্ষণের জন্য মনটাকে ভারী করে তুলল। যদিও জানি, জঙ্গল জীবন শুধু অনিশ্চিত নয়, খাদ্য-খাদকের একত্র বাস এখানে। তবে, ধনেশ দম্পতির সুখী দাম্পত্য সত্যিই মুগ্ধ করে। সংসার জীবনে দুই-ই সমান যত্নশীল। ফল সংগ্রহ করে কখনও স্ত্রী স্বামীর মুখে ঢুকিয়ে দিচ্ছে তো কখনও স্বামী স্ত্রীর মুখে। পৌরুষের মিথ্যে আস্ফালন করতে ওরা জানে না। হগ ব্যাজারের মিলন দৃশ্য লেন্সবন্দী করতে না পেরে আবারও আমাদের মন খারাপের পালা। তবে এবার শেষ সাফারিতে রাজ দর্শনের সংকল্প নিয়ে জঙ্গল ছাড়লাম। মাথার উপর সূর্যদেব ও সহোলা লেককে পিছনে রেখে ‘অরণ্যে’র উদ্দেশ্যে গাড়ি ছোটাল প্রফুল্লদা। (চলবে)
ছবি : লেখক