Monday, February 3, 2025
গানের ভুবনদর্পণে জীবন

সংগীতের অপরূপ এক কানন

দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সুবাদে কাছে যাবার সৌভাগ্য হয়েছে সংগীত জগতের বহু গুণী মানুষের। তাঁদের নিয়েই এই প্রতিবেদন পড়ুন অজন্তা সিনহার কলমে।

সিটিভিএন চ্যানেল সবে শুরু হয়েছে তখন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি সংগীতশিল্পী হিসেবেও একটা পরিচিতি আমার ছিল। সেই সূত্রেই চ্যানেল কর্তৃপক্ষের অনুরোধ,আমি যদি তাঁদের চ্যানেলে গানভিত্তিক একটি অনুষ্ঠান করি। পেশাদারী জগতে পা রাখার পর থেকেই এমন নতুন নতুন সুযোগ বা পরিস্থিতি আমার জীবনে এসেছে। গ্রহণও করেছি সে সুযোগ। এভাবেই টিভি সঞ্চালনারও শুরু। যাই হোক, অল্পদিনের মধ্যেই আমার ভাবনা,পরিকল্পনা ও উপস্থাপনায় সিটিভিএন চ্যানেলে শুরু হলো ‘আমার গান আমার কথা’।

সামান্য দুটি কথা বলে প্রস্তাবনা পর্ব শেষ করবো। প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা না থাকায় শুরুর দিকে অনুষ্ঠান সঠিক মানে পৌঁছতে পারছিল না। তবু বাংলার দর্শক এই শো গ্রহণ করলো। জনপ্রিয়ও হলো অতি দ্রুত। তার কারণ সেই অতীব গুণী মানুষগুলি, বাংলা তথা ভারতীয় সংগীতে যাঁদের অবদান প্রভূত। কয়েকজনের নাম তো স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ও থাকবে। আমার পরম সৌভাগ্য এই অনুষ্ঠানকে ঘিরেই বেশ কয়েকজন কিংবদন্তী সংগীত ব্যক্তিত্বের সামনে বসে তাঁদের কথা ও গান শোনার অনুপম অভিজ্ঞতা প্রাপ্তি হয়। আজ এমনই একজনের কথা।

সংগীত জগতেরই বন্ধু, শিল্পী, শিক্ষক অনুভা ঘোষের কল্যাণে পৌঁছলাম সেই মানুষটির কাছে। আমার অনুরোধে সে একদিন আমায় নিয়ে গেল তাঁর গুরু পন্ডিত এ টি কানন সাহেবের কাছে। সংগীত রিসার্চ একাডেমির সীমানায় প্রবেশ করতেই রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। ওঁর বাংলোর সামনে যখন পৌঁছলাম, তখন তো উত্তেজনা আর ধরে রাখতে পারি না। সেই কবে থেকে পন্ডিত এ টি কাননের গান ও তাঁর সম্পর্কে নানা গল্প শুনে আসছি। অন্দরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করলাম, এমন এক বাড়িতেই সংগীতের দেবতা অধিষ্ঠান করেন।

ক্যামেরাম্যান, সাউন্ড রেকর্ডিস্ট, লাইটের কাজ যে করে, সেই টেকনিশিয়ানরাও পরিবেশের গুণে চুপচাপ নিজেদের কাজ করে চলছিল সেদিন। পন্ডিতজি বসে আছেন তাঁর গানের ঘরে। বিশাল আকৃতির সেই ঘরে উনি ছাড়াও স্ত্রী মালবিকা কানন এবং পন্ডিতজির কয়েকজন ছাত্রছাত্রী। মালবিকা কাননও একজন অত্যন্ত নামী শাস্ত্রীয়সংগীত শিল্পী। তবে, সেই সময়টায় তিনি খুবই অসুস্থ। লক্ষ্য করলাম, ছাত্রছাত্রীরাই সন্তানবৎ ঘিরে রেখেছে কানন সাহেব ও তাঁর স্ত্রীকে। কানন সাহেবের জন্ম মাদ্রাজে (এখন চেন্নাই)। সেখান থেকে কলকাতায় চলে এসেছেন সেই কবেই। মনেপ্রাণে এ শহরের মানুষ হয়ে গেছেন।

শুটিং শুরুর আগে কিছুটা প্রাথমিক কথাবার্তা সব সময়ই বলে নিতে হয়। সবাই ক্যামেরা ইত্যাদির সামনে স্বচ্ছন্দ হতে পারেন না। এই অনুষ্ঠানটি পুরোপুরি স্ক্রিপ্ট ছাড়াই করা হতো। শুধু প্রশ্নের লাইন আপ থাকতো আমার নিজের কাছে। সেটাও শুটিংয়ের সময় যাতে আর দেখার প্রয়োজন না হয়, সেভাবেই নিজেকে তৈরি রাখতাম। এতে বিষয়টা অনেক স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ক্যামেরায় ধরা দিত। এদিনও কথা শুরু হলো। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলেন তিনি। তবে, কথা বলার থেকেও গানেই তাঁর আগ্রহ মুহূর্তে বুঝে গেলাম। দুজন ছাত্র তানপুরা বাঁধছে, কানন সাহেবের কান সেদিকেই।

তারপর কোনও এক সময় শুটিং শুরু হলো। ওঁর কণ্ঠের আলাপ দিয়ে শুরু। আর শুরুতেই পুরো পরিবেশ বদলে গেল। কি কি রাগ গেয়েছিলেন, আজ আর সঠিক মনে নেই। সম্ভবত পুরিয়া আর মালকোষ ছিল। সন্ধ্যা নামছে তখন। ঘরে শুধু শুটিংয়ের আলো। বাকি অন্ধকার। আলাপ থেকে মূল গানে প্রবেশ করলো গুরুজীর কন্ঠ ! আহা সে যে কি অপূর্ব স্বর্গীয় অনুভূতি। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে, নাকি মেঘগর্জন ! উদাত্ত কণ্ঠে চরাচরের সব ভুলিয়ে অমৃতলোকে নিয়ে গেলেন তিনি আমাদের। খুব মনে পড়ছিল, ঋত্বিক ঘটকের বিখ্যাত ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবির সেই ‘লাগি লগন পতি সখী সঙ্গ…’ ও অন্যান্য বন্দিশ। পাঠক স্মরণ করুন,’বসন্ত বাহার’, ‘যদু ভট্ট’ ইত্যাদি ছবির গান। ঈশ্বরদত্ত কন্ঠ, অনন্ত প্রতিভা, সঙ্গে চূড়ান্ত অভিব্যক্তি। তাঁর সময়ে তিনি যে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি !

একের পর এক গান। কথা মাঝে মাঝে দু’একটি। জীবনের শুরুতে গান আর ক্রিকেট দুয়েই ছিল তাঁর প্রতিভা ও আগ্রহ । ক্রিকেটের সূত্রেই রেলে চাকরি ও মুম্বইয়ে বসবাস। কিন্তু না, খেলা নয়, গানই শেষ পর্যন্ত হলো পন্ডিত এ টি কাননের জীবনপথ। সেই পথ ধরেই কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস। আদতে এই সন্ধ্যাতেও গানেই মগ্ন হয়ে পড়ছিলেন এমন, যে, কথা বলার ইচ্ছেটাই হারিয়ে যাচ্ছিল। তার মধ্যেই মনে রাখার মতো যা বললেন, কলকাতাই এখন তাঁর নিজের শহর। এখানকার শ্রোতারা অত্যন্ত সমঝদার। কনসার্টে গান পরিবেশন করে খুব তৃপ্তি পান তিনি। আর ভালোবাসেন বাঙালি রান্না খেতে। এ প্রসঙ্গে অনুভার সংযোজন, বহুবার গুরুজীর জন্য সে-ও রান্না করে নিয়ে গেছে। খুব তৃপ্তি সহকারেই সেই রান্না খেয়েছেন তিনি।

এক সময় শুটিং পর্ব সমাপ্ত হলো। আমাদের ঘোর আর কাটে না। ক্যামেরার ছেলেটি মৃদুস্বরে জানায়, “দিদি, যা ফুটেজ পেলাম, এতে তো তিনটে এপিসোড হয়ে যাবে।” সেটাই হয়েছিল। এডিট করতে বসে, দেখি, কিছুই বাদ দেবার নয়। তিন পর্বেই দেখানো হয় সেই সাক্ষাৎকার। আজ এত বছর পরেও কানে লেগে আছে সেই সমুদ্রসম কন্ঠ। আর সেই অপূর্ব সরল হাসিমুখ। এই মহৎ প্রাপ্তির অন্যতম ভাগীদার আমার বন্ধু অনুভা। সে না থাকলে কিছুই হতো না। খুব ছোট মাপের এই স্মৃতিকথা আমার প্রাপ্তির ঝুলি অনেকটা ভরে রেখেছে। পাঠকের সঙ্গে তাকেই ভাগ করে নিলাম।