সৌরভ ও তৃণার ‘রিদমিক নেচার অ্যান্ড নস্টালজিয়া’
শিল্পকলার মধ্য দিয়ে প্রকৃতির উদযাপন। ছুঁয়ে দেখা প্রকৃতির ছন্দময়তাকে। ফিরে যাওয়া স্মৃতির আঙিনায়। দুই শিল্পী সৌরভ ঘোষ ও তৃণা চট্টোপাধ্যায়ের শিল্পকর্মে গাঁথা ‘রিদমিক নেচার অ্যান্ড নস্টালজিয়া’ সেই অনন্যতারই প্রতিফলন। গতকাল গ্যালারি চারুবাসনা : যোগেন চৌধুরী সেন্টার ফর আর্টসে শুরু হয়েছে এই দুই শিল্পীর প্রদর্শনী, চলবে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত (প্রতিদিন দুপুর ৩টে থেকে রাত ৮টা অবধি)। উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী সহ বহু বিশিষ্ট মানুষজন।
প্রদর্শনীতে সৌরভ ঘোষের শিল্পকর্মে সরায় ফুটে উঠেছে একদা বঙ্গজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা আলপনা। একসময় যে কোনও শুভানুষ্ঠানে খড়িমাটি বা চালের গুঁড়ো দিয়ে আলপনা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। আত্মবিস্মৃত বাঙালির সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেই সরায় ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। লক্ষ্মীর পা, ধানের শিষ, পদ্মফুল, পেঁচা, পশু-পাখি সহ বহু মোটিফকে ব্যবহার করে প্রায় আলপনার মতো ক্ষণস্থায়ী শিল্পকে অনন্যতা দেওয়ার কাজটি করেছেন সৌরভ। তাঁর সরা-আলপনায় প্রকৃতির সৌন্দর্যের পাশাপাশি নান্দনিকতা ও মনোরম স্নিগ্ধতার ছোঁয়া সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি বর্গাকার ম্যাসনেট বোর্ডের উপরেও আলপনার কয়েকটি কাজ ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।
অপরদিকে তৃণা চট্টোপাধ্যায়ের শিল্পকলার মধ্যে মেলে প্রকৃতির আর এক অনন্য ছোঁয়া। পেপার ম্যাসির (যা সহজেই রিসাইকেল তথা পুনর্ব্যবহার করা যায়) মধ্যে পেইন্টিং, অ্যাক্রেলিক রঙের মিশেলে একের পর এক সৃষ্টিকে মেলে ধরেছেন শিল্পী। প্রকৃতি সেখানে ধরা দিয়েছে অনন্যতায়। পাহাড়ের স্মৃতি, আশেপাশে থাকা মানুষজন, বাড়ির পোষ্যকে নিজের শৈল্পিক ছোঁয়ায় তুলে ধরেছেন তৃণা। পাশাপাশি সাদা-কালোয় মাখা পেন ও ইঙ্কের স্কেচগুলিতেও পরিবেশের প্রতিফলন লক্ষ্যনীয়।
প্রসঙ্গত, সৌরভ ঘোষ ও তৃণা চট্টোপাধ্যায় উভয়েই শান্তিনিকেতন কলাভবনে প্রিন্ট মেকিং তথা ছাপাই ছবি বিষয়টি নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এছাড়াও, নৈনিতালের শেরউড কলেজের আর্ট বিভাগের সহকর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন ২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত। দুই শিল্পীরই এটি সেই অর্থে শহরের বুকে তাঁদের শিল্পকর্মের প্রথম বড় প্রদর্শনী। ইতিপূর্বে দু’জনেই কয়েকটি গ্রুপ একজিবিশনে অংশগ্রহণ করেছেন।
সরা শিল্পী ছাড়াও সৌরভ ঘোষের আরও একটি পরিচয় হলো তিনি একজন অভিনেতা। নাট্যমঞ্চ, ছোটপর্দার পাশাপাশি বড়পর্দাতেও তিনি নিজের অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। শহরের বুকে নিজের এহেন শিল্পপ্রদর্শনী নিয়ে বেশ আপ্লুত সৌরভ। তাঁর কথায়, “আমি ভীষণই উত্তেজিত এই একজিবিশন নিয়ে। এর আগে গ্রুপ একজিবিশনে আমার কাজ প্রদর্শিত হয়েছে। তবে এবার বড় পরিসরে হচ্ছে। আমার মতো একজন সাধারণ শিল্পীকে যোগেনদার মতো একজন মানুষ নিজের কাজ প্রদর্শিত করার যে সুযোগ দিয়েছেন, তাতে আমি কৃতজ্ঞ ওঁর কাছে।” পাশাপাশি শিল্পী আরও বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে একজিবিশন নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি, তাতে আমি মুগ্ধ। আমার কাজকে সামনাসামনি দেখে মানুষজন তথা শিল্প অনুরাগীরা কীভাবে গ্রহণ করেন, সেটা জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছি।”
পাঁচ বছর ধরে সরায় আলপনা সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত সৌরভ কিভাবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হলেন সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “ছোটবেলায় বাবাকে আলপনা দিতে দেখেছি। আমার বাবা ননীগোপাল ঘোষ ছিলেন শান্তিনিকেতনের ডিজাইনিং ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক। বাবা ছাত্রাবস্থায় নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিঙ্কর বেইজের সান্নিধ্য পেয়েছেন। ২০১২-তে কলকাতায় আসার পর, বেশ কয়েক বছর গ্রিলের ডিজাইন করতাম। সেখান থেকেই আলপনার দিকে ঝুঁকলাম। কারণ, এই বিষয়টি নিয়ে সেভাবে প্রচার, প্রসার হয়নি। ২০১৭-র ২৫শে বৈশাখ জোড়াসাঁকোতে আলপনা দিই। তখন, সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ছবি দেখে বহু মানুষ প্রশংসা করেন। তাঁদের উৎসাহ ও মন্তব্যই আমাকে এই দিকে নিয়ে আসে।”
তবে, ইদানিং শহরের পুজো কিংবা কোনও উৎসবে রাস্তায় আলপনা দিয়ে, তার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার তীব্র বিরোধী সৌরভ। শিল্পীর স্পষ্ট মন্তব্য, “শান্তিনিকেতনে যে শিক্ষায় আমি বড় হয়ে উঠেছি, সেখানে আলপনার উপর দাঁড়িয়ে যাওয়া বা সেটিকে মাড়িয়ে চলে যাওয়ার রীতি নেই। সেই কারণেই আমি বিয়েবাড়ি বা উৎসববাড়িতে আলপনা দিই না।” তাঁর কাজে প্রকৃতির ছোঁয়া নিয়ে শিল্পী বলেন, “প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে আমরা নই। শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠা, পরে নৈনিতালে প্রকৃতির মাঝেই অনেকটা সময় কাটিয়েছি। শহরের কৃত্রিমতা আমাকে টানে না। গাছগাছালি ভরা পাখির কলকাকলি আমাকে এখনও আকর্ষণ করে।” তৃণার মতে, “এই একজিবিশন নিয়ে আমি খুবই আশাবাদী। আশা করি যাঁরা দেখবেন, তাঁদেরও ভালো লাগবে।” পাঁচ বছর ধরে পেপার ম্যাসির মতো শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন তিনি। মাটির কাজ শিল্পীকে বরাবরই টানত। সেখান থেকেই পেপার ম্যাসির প্রতি আকৃষ্ট হন তৃণা। এছাড়াও পেন অ্যান্ড ইঙ্ক, অ্যাক্রেলিক অন ক্যানভাস, কোলাজ, মিক্স মিডিয়া সহ অন্য আর্ট ফর্ম নিয়েও চর্চা করেছেন শিল্পী। তাঁর কাজেও প্রকৃতির ছোঁয়া সুস্পষ্ট। সেই কারণ জানাতে গিয়ে তৃণা বলেন, “আমি ছোট থেকেই শহরের বাইরে কাটিয়েছি–বলতে পারেন প্রাকৃতিক পরিবেশে। চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছি। আমি নৈনিতাল, নেপাল, আসাম, দেরাদুন ও কেনিয়াতে অনেকটা সময় কাটিয়েছি। আমার কাজের মধ্যে তাই পাহাড়ের পুরোনো দিনের স্মৃতি, আশেপাশের মানুষ, পরিবারের সদস্য, এমনকি প্রজাপতি, প্রকৃতির ছোঁয়া দেখতে পাবেন।”