হারানো দিনের গানের গল্প…
চল্লিশ পেরিয়ে আসা বাঙালি এখনও স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ে পুরনো বাংলাগান শুনে। সেইসব গানের গল্পই এই বিশেষ ধারাবাহিক প্রতিবেদনে। আজ প্রথম পর্ব। লিখছেন প্রদীপ্ত চৌধুরী।
আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শুধু গানেরই বিস্তার। যে কান্না দিয়ে জীবনের শুরু, সেই কান্নার মূলেও তো সরগমই। আবার মরাকান্নাও সুরে সুরেই ছড়িয়ে দেয় তার অতলান্ত বিষাদ। মধ্যপর্বে কত অন্তরা আর সঞ্চারির ছড়াছড়ি! আমরা বাঙালিরা এই গানের মায়াজালেই জড়িয়ে থাকি আজীবন। আমাদের স্মরণ-বরণ-উৎসব-অনুষ্ঠান, সবেতেই শুধু গান আর গান। ফাঁসির মঞ্চেও জীবনের জয়গান গাইতে আমরা ভুলি না। চল্লিশ পেরিয়ে আসা বাঙালি এখনও স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ে পুরনো বাংলা গানগুলি শুনে। সেইসব অবিস্মরণীয় গান এখনও তাকে বিবশ করে, বিহ্বল করে। ভেতরটা একেবারে তোলপাড় হয়ে যায় তার। এইসব গানের অনেকগুলির জন্মবৃত্তান্তের সঙ্গেই কিন্তু জড়িয়ে আছে নানা রঙের ঘটনা। এ লেখায় তুলে আনছি তেমনই কয়েকটি গান।
বাংলা গানের ইতিহাসে একটা গোটা অধ্যায় দাবি করতে পারেন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। চিকিৎসক সুরকার নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে তাঁর ছিল নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ঢোলা পাজামা আর লম্বা পাঞ্জাবি পরে প্রায় সকালেই তিনি গাড্ডায় (গান আর আড্ডা) যেতেন শ্যামবাজারে নচিবাবুর বাড়িতে। দেদার আড্ডা আর খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চলত নতুন নতুন গান তৈরির কাজ। একদিন এমনই এক আড্ডার মাঝে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্য গান লিখতে গিয়ে থমকে গেলেন গৌরীপ্রসন্ন। মাথাটা কিছুতেই যেন কাজ করছে না। নচিকেতাকে বললেন, “চল তো বাইরে যাই, কোথাও গিয়ে খেয়ে আসি।” কিন্তু পয়সা কোথায়? নচিকেতা তখন বাড়ির পুরনো পরিচারকের জমানো পয়সা চুরি করে গীতিকার বন্ধুকে নিয়ে হাজির হলেন শ্যামবাজারের বিখ্যাত গোলবাড়িতে। গোলবাড়ির পরোটা আর কষা মাংস খেতে খেতে গৌরীপ্রসন্ন ওয়েটারকে বললেন,“ভাই, একটু লেখার কাগজ হবে?” কাগজ পাওয়ামাত্র শুরু করে দিলেন লিখতে। লিখে গেলেন প্রায় একটানা। তারপর দু’জনে বাড়ি ফিরে সেই গানটা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই জন্ম নিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’।
অনেকটা এভাবেই আরও একটা বিখ্যাত গান প্রথম আলো দেখেছিল কলকাতার বহুল পরিচিত চাইনিজ রেস্তোরাঁ ‘চাং ওয়া’-য়। সেখানে এক বিকেলে সলিল চৌধুরীর সঙ্গী হয়েছিলেন তৎকালীন মেগাফোন কোম্পানির কর্তা কমল ঘোষ। কমলবাবুর অনুরোধে সলিল চৌধুরী মেনুকার্ডের আইটেমগুলির (পাওচিন, মান্ডারিন, গার্লিক চিকেন, রেড পিপার চিলি, সালাড) আদ্যাক্ষর নিয়ে নিমেষের মধ্যে সুর সহযোগে একটি গানের মুখরা তৈরি করে ফেলেছিলেন। লতার গাওয়া সেই মন-কেমন-করা গানটি হল ‘পা মা গা রে সা/ তার চোখের জটিল ভাষা’।
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান কোনটা? তিনি নিজে মনে করতেন ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’। গানটা তৈরি হয়েছিল গার্স্টিন প্লেস-এ আকাশবাণী ভবনের পাঁচ নম্বর স্টুডিওয়, এক অদ্ভুত ছমছমে নির্জনতার মধ্যে। তখন সন্ধ্যা নেমেছে সদ্য। বারান্দায় পায়চারি করছিলেন মানবেন্দ্র। পাশেই কবরখানা। চারপাশে ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে অন্ধকার। এমন সময় হঠাৎ যেন কার গলার আওয়াজ ভেসে এল! — “এই মানব, এখানে কী করছিস?” চমকে উঠলেন মানবেন্দ্র। প্রশ্নকর্তাকে ভালো করে দেখাও যাচ্ছে না। শুধু তাঁর চোখ দুটো দপদপ করে জ্বলছে। ভয় পেয়ে একটু জোরেই মানবেন্দ্র এবার বলে উঠলেন, “কে?” উত্তরটা দিলেন বন্ধু গীতিকার শ্যামল গুপ্ত। বললেন, “তোর খোঁজেই এলাম। একটা দুর্দান্ত গান লিখেছি। একবার শুনবি?”
বিখ্যাত গীতিকারের তখন প্রেমপর্ব চলছে বাংলার মধুকণ্ঠী গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সেই প্রেমেরই উচ্ছ্বাস গানের প্রায় প্রতিটা শব্দে। গানটার কাব্যগুণে মুহূর্তে আচ্ছন্ন হলেন মানবেন্দ্র। বন্ধু শ্যামলকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন পাঁচ নম্বর স্টুডিওর দিকে। স্টুডিওর দরজায় সেই সময় তালা ঝোলার কথা। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার। দরজাটা খোলা। ভিতরে বিশাল যে পিয়ানো, সেটাতেও কোনও চাবি দেওয়া নেই। মানবেন্দ্র বসে পড়লেন পিয়ানোর সামনে। সুরের আলোয় মুছে গেল অন্ধকার। তৈরি হল বাংলা আধুনিক গানে রোমান্টিকতার এক নতুন মাইলফলক ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’। (চলবে)