Monday, February 3, 2025
ওয়েব-Wave

সাক্সেশন : অপেক্ষা পরের সিজনের

বাংলায় যাকে আমরা বলি ‘বাপের পয়সায় ফুটুনি’, ‘সাক্সেশন’ (Succession) তেমনই একদল ছেলেমেয়ে ও তাদের বাবা শিল্পপতি লোগান রয়ের কাহিনি। এইচবিও চ্যানেলের হিট এই ব্ল্যাক কমেডি সিরিজ হটস্টার-এ দেখলাম সম্প্রতি। পর্বে পর্বে কাহিনির বিন্যাস দেখে দেশকালের প্রাচীর ভেঙে যাচ্ছিল বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। একার প্রচেষ্টায় সম্পদের এক বিশাল ইমারত গড়ে তুলেছেন বাবা। কঠোর পরিশ্রম ও প্রবল বুদ্ধির জোরে বাবার গড়ে তোলা সেই কোম্পানি, সম্পত্তি, শান-সহকত অযোগ্য ও ক্ষমতালোভী ছেলেপিলের দল উড়িয়ে দিয়েছে এক ফুঁয়ে–এমন ঘটনা এদেশেও বিরল নয়।

Images 4

লোগান রয়ের তিন ছেলে এক মেয়ে। ছেলেরা হলো কোনোর, কেন্ডাল ও রোমান–মেয়ে শিবন। শিবনের স্বামী টম, আর আছে লোগানের ভাইয়ের ঘরের নাতি গ্রেগ। অভিনয়কে কেরিয়ার করে সফল হতে চায় কোনোরের প্রেমিকা। কোনোরের থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট এই তরুণীরও রয়েছে এক অন্ধ অতীত, যার জন্য কোনোরের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকলেও পরিবারে সামাজিক স্বীকৃতি নেই তার। এরা প্রত্যেকেই নিজের মতো করে হিসেবনিকেশ করছে। অন্যদিকে লোগানের অতীত এবং বর্তমানও প্রশ্নাতীত নয়। সোজাপথে কে-ই বা কবে সম্পদের প্রাসাদ গড়েছে ? এখানেও আছে অনেক অন্ধ-আবদ্ধ রক্তপাতের ইতিহাস।

লোগানের বয়স হয়েছে। তবু, প্রবল প্রতাপশালী এখনও। কাকে তিনি কোম্পানির দায়িত্বে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করবেন, তাই নিয়ে নানান নাটক। ছেলেমেয়েরা একদিকে একে অপরের বিরুদ্ধে ছুরি শানায়। অন্যদিকে প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত জীবনযাপনও সরল নয়–উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সম্পর্কের প্রতি অসততা, শর্টকাটে বাজিমাত করার দর্শনে চরিত্রগুলি ধূসর থেকে ধূসরতর হয়ে ওঠে। প্রথম দিককার পর্বগুলি এভাবেই কেটে যায় দ্রুত। পারিবারিক চালচিত্রের বাইরেও রয়েছে কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারীবৃন্দ। এমনকী কোম্পানির শেয়ার হোল্ডাররাও গুরুত্বে কম যায় না। আছে বন্ধু, প্রেমিক-প্রেমিকা, কেন্ডালের ডিভোর্স ইচ্ছুক স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে। এখানেও রয়েছে নানা সমীকরণ।

Images 22

শিবনের স্বামী টম সাধারণ পরিবারের ছেলে। তার একটা নিজের মতো করে উচ্চাশা বা অভিজাত সমাজে স্থান পাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তুলনায় সে ধীরস্থির, পরিণতমনস্ক, মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। গ্রেগ প্রবল সুযোগসন্ধানী। লোগানের বর্তমান স্ত্রী মার্শিয়া ব্যস্ত তার প্রথম পক্ষের সন্তানদের নানা সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে। লোগানের প্রতি তার প্রেম, দায়িত্ব, কর্তব্যের সবটাই আপন স্বার্থে। তার সবসময়ই একটা চেষ্টা থাকে লোগানের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করার। লোগানের ডিভোর্সি প্রাক্তন স্ত্রী, তাঁর চার সন্তানের মা ক্যারোলিন–যে কিনা অনেকটা দূরে থাকে এইসব জটিলতা থেকে। একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানকে ঘিরে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তার পুনর্মিলন হয়। সেখানেও জড়িয়ে থাকে নানা আলো-আঁধারি ঘটনাপ্রবাহ।

মোদ্দা কথা, এই তথাকথিত পার্শচরিত্রগুলি যে কোনও মুহূর্তেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে কাহিনিতে, যা দর্শক প্রতিবারই উপলব্ধি করে একেবারে অপ্রত্যাশিত ভাবে। আর এই চমকটাই এই সিরিজের ম্যাজিক। দৃশ্য বিন্যাস থেকে ডায়ালগ–চূড়ান্ত স্মার্ট ও দক্ষ ‘সাক্সেশন’-এর লেখক তথা ক্রিয়েটিভ টিম। যার শীর্ষে রয়েছেন জেসি আর্মস্ট্রং। ‘সাক্সেশন’-এর ৩টি সিজনের ২৯টি পর্ব দেখার পর দর্শক যে পরের সিজনের অপেক্ষায় টানটান থাকবেন, তা গ্যারান্টিসহ বলা যায়। বস্তুত, সিরিজ দেখার সময় একবারের জন্যও মনে হয় না পর্দা থেকে দৃষ্টি ফেরাই। এর আর একটা বড় কারণ ‘সাক্সেশন’-এর অভিনেতারা। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরও কিছু কথা, কাহিনির প্রেক্ষিতে।

আমেরিকার বিজনেস টাইকুন লোগান রয়ের একদিকে মিডিয়া ব্যবসা, এছাড়া ক্রুজ ইত্যাদি এবং প্রচুর অন্যান্য সম্পত্তি। শুধু তাই নয়। রাজনৈতিক প্রেক্ষিতেও তিনি দারুন প্রভাবশালী। খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। কিন্তু বয়স তো থাবা বসাতেই পারে। লোগানের হঠাৎ সিভিয়ার হার্ট এটাক ও কিছুদিনের বিশ্রাম। এমন সুযোগ কে ছাড়ে ? টিভি চ্যানেল এটিএন-এর প্রধান দায়িত্ব কে পাবে, তাই নিয়ে ভাইবোনদের মধ্যে অশান্তির শুরু, যার পারদ ক্রমশ চড়তে থাকে পর্বে পর্বে।

কেন্ডাল মনে করে, সে-ই যোগ্যতম। সেই হিসেবে বাবার কাছে তার চূড়ান্ত প্রত্যাশা। কিন্তু সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। কেন্ডাল বাবার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের গুটি সাজায়। অন্যরা তা হতে দেবে কেন ? তারা বাধার সৃষ্টি করে। এদিকে খবর ঠিকই পেয়ে যান লোগান। সুস্থ হয়ে ফিরে লোগান কেন্ডালের হাত থেকে সব ক্ষমতা কেড়ে নেন। মূলত লোগানের সঙ্গে কেন্ডালের সম্পর্কের অবনতিকে ঘিরে পরবর্তী বাকি ঘটনাপ্রবাহ আবর্তিত।

আর এই টানাপোড়েনের পটভূমি আরও একটু পাকাপোক্ত হয় লোগানের ক্রুজ ব্যবসাকে ঘিরে। এই ব্যবসাকে ঘিরেই একদা ঘটে যাওয়া এক গুরুতর অপরাধ সংক্রান্ত কাগজপত্র এসে পড়ে  কেন্ডালের হাতে। সে বাবাকে প্রথমে ব্ল্যাকমেলিং, পরে ভয় দেখাতে না পেরে মিডিয়ার কাছে যায়। এটাই এই সিরিজের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট। আগাগোড়া কাহিনির মতোই ক্লাইম্যাক্স একেবারে অপ্রত্যাশিত। সবশেষে কী হয়, তা পর্দাতেই দেখে নেওয়া ভালো দর্শকের।

নানা পুরস্কার ইতিমধ্যেই ঝুলিতে পুরে নিয়েছে ‘সাক্সেশন’। সেখানে রয়েছে বাফতা, গোল্ডেন গ্লোব, এমি-র মতো গুরুত্বপূর্ণ নাম। দুরন্ত অভিনেতা টিম ছাড়া এই প্রাপ্তি সম্ভব ছিল না। ব্রায়ান কক্স ছাড়া লোগান রয় ভাবতেই পারবেন না আপনি। হলিউডের বর্ষীয়ান এই অভিনেতা প্রতি মুহূর্তে নজর ধরে রাখেন দর্শকের। তারপরই যাঁর কথা বলতে হয়, তিনি কেন্ডাল চরিত্রে জেরেমি স্ট্রং। চরিত্রের টানাপোড়েনের দিকটি নিপুণভাবে অভিব্যক্ত জেরেমির অভিনয়ে। এছাড়াও নিখুঁত হিয়াম আব্বাস, নিকোলাস ব্রাউন, কিয়েরাঁ কালকিন, পিটার ফ্রায়েডম্যান, নাটালি গোল্ড, ম্যাথিউ ম্যাকফেডেন, এলান রুক, পারকার সয়ার্স, সারা স্নুক, রব ইয়াং, ফিশার স্টিভেন্স, জাস্টিন লুপ প্রমুখ।