Monday, February 3, 2025
কৃষ্টি-Culture

দিকে দিকে প্রজ্জ্বলিত হোক অগ্নিশিখা

আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক রেডিও দিবস। সেই উপলক্ষে এই বিশেষ প্রতিবেদন। অনেক লড়াইয়ের পর নিজের স্বপ্নপূরণ সম্ভব করেছেন আর জে শিখা মাণ্ডি। তাঁর এই উত্তরণের কাহিনী পড়ুন মন্দিরা পান্ডার কলমে।

রেডিও দিবসের প্রবর্তন বড়ো বেশি পুরোনো নয়। এই তো সেদিন ২০১০-এর ২০ সেপ্টেম্বর স্প্যানিশ রেডিও অ্যাকাডেমি ইউনেস্কোর সম্মেলনে আন্তর্জাতিক রেডিও দিবস প্রবর্তনের প্রস্তাব উত্থাপন করে। নানা মতান্তর ও আলাপ আলোচনা শেষে ধার্য করা হয় ১৩ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে। কারণ হিসেবে বলা হয়, ১৯৪৬-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি ছিল ইউনাইটেড নেশনস রেডিও-র প্রতিষ্ঠা দিবস।

স্বভূমি ভারতবর্ষেও বেতারের ইতিহাস বহুল চর্চিত ও ভিন্ন স্বাদের। “ধরার আঙিনা হতে ঐ শোনো উঠিল আকাশবাণী!”–১৮৯৫-র কালপর্বে বাঙালি বৈজ্ঞানিক স্যার জগদীশচন্দ্র বসু কলকাতায় সর্বপ্রথম সফলভাবে বেতার সম্প্রচার করেন। কলকাতায় সাময়িকভাবে বেতার অনুষ্ঠানের প্রাথমিক সূচনা ঘটে ১৯২৩-এর নভেম্বরে সদ্য-গঠিত ‘রেডিয়ো ক্লাব অব বেঙ্গল’-এর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে। তারপর ১৯২৫-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজের অধ্যাপক ডঃ শিশির কুমার মিত্র পদার্থবিদ্যা বিভাগের ঘরে ট্রান্সমিটার বসিয়ে ওয়্যারলেসে কথিকা, গান, আবৃত্তি সম্প্রচার শুরু করেন।

সেই সম্প্রচারে উদ্বোধনী গান গেয়েছিলেন হীরেন্দ্রকুমার বসু– ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সংগীত ভেসে আসে…’। নানা বিবর্তনের ওঠাপড়ায় আকাশবাণীর উড়ান যখন আরও খানিক আকাশচুম্বী তখন থেমে থাকেননি মহিলারাও। ১৯৪৩-এর ১৫ আগস্ট প্রথম বাঙালি মহিলা ঘোষিকা হিসেবে কলকাতা বেতারে যোগ দেন ইন্দিরা দেবী। সেই বছরের ডিসেম্বরে আসেন

নীলিমা সান্যাল, ইন্দু সাহা, সুনীল দাশগুপ্ত। ইন্দিরা দেবী টানা ৩৭ বছর ধরে ‘শিশুমহল’ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন।

সময় পালটেছে। পরিবর্তন এসেছে দৈনন্দিন জীবনছন্দে। বেড়েছে ব্যস্ততা। প্রসঙ্গত বিনোদনের অঙ্গনেও এসেছে বর্ণময়তা। তাই সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোগেও শুরু হয়েছে এফএম পরিষেবা। সেদিনের ঘোষক-ঘোষিকা থেকে আজকের রেডিও জকি। বর্তমানে সেই পেশা ও নেশা তরুণ প্রজন্মের কাছে রীতিমত সেনসেশন বলা চলে। পরিবর্তিত হয়েছে অনুষ্ঠানের সম্ভার। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবর্তন শহরকেন্দ্রিক। লক্ষ লক্ষ শ্রোতা সেই অনুষঙ্গেই শুনছেন শহরাঞ্চলে কথিত বিশুদ্ধ উচ্চারণের ভাষা।

যে কাহিনীর অবতারণা পালটেছে প্রথাগত ধ্যানধারণা, তা আর জে শিখা মাণ্ডির গল্প। আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি রেডিও দিবসকে ঘিরে সেই শিখারই কথা জানবো আমরা। রেডিও ‘শাগুন তারাসি, জোহার ঝাড়গ্রাম’– রেডিও মিলন ৯০.৪ এফএম-এ দুপুরবেলা কান পাতলে শোনা যায় এমনটাই‌। প্রথাগত Good Afternoon নয়, অলচিকি ভাষাতেই শ্রোতাদের সম্ভাষণ করেন রেডিও জকি শিখা মাণ্ডি‌। পশ্চিমবঙ্গের বেলপাহাড়ির গজপাথর গ্রামে ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে শিখা মাণ্ডি‌। সামাজিক-রাজনৈতিক অসন্তোষের বাতাবরণে তিন বছর বয়সে খানিকটা বাধ্য হয়েই কলকাতায় আসেন তিনি।

চলার পথ অবশ্য কলকাতায় আসার পরও মসৃণ হলো না। বাধা মূলত দুটি–প্রথমত লিঙ্গগত বৈষম্য, তিনি মেয়ে এবং দ্বিতীয়ত উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার গ্রাম থেকে আসা একজন। কিন্তু, মনের গহীনে পোষিত ইচ্ছেদের মেরে ফেলতে পারেনি সমাজের তথাকথিত নিয়ম-কানুন। মেয়েবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন মাইকের সামনে কথা বলবেন। স্বপ্ন দেখতেন আর জে হওয়ার। সেইমত নিয়মিত রেডিও শুনতেন। কলকাতায় প্রথাগত পড়াশোনার শেষে নিজের স্বপ্নকে সত্যি করার এক অবর্ণণীয় সুযোগ পেলেন।

অরণ্যসুন্দরী ঝাড়গ্রামের বুকে ‘রেডিও মিলন’-এর গোড়াপত্তনের পর তারা অলচিকি ভাষায় একটি অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করেন। শিখা সেই সূত্রেই চেনা পথে কেরিয়ার না গড়ে শিকড়ের টানে ফিরলেন ঝাড়গ্রামে। প্রয়োজনীয় অডিশন শেষে ২০১৭-র ডিসেম্বরে শুরু হয় ‘জোহার ঝাড়গ্রাম’। ‘সানাম ক ইঞা জোহার আর দুলেড়ঃ…’ –বলে শুরু করেন নিজের স্বপ্ন উড়ান যার বাংলা অর্থ ‘সবাইকে আমার নমস্কার ও ভালবাসা’। জনপ্রিয়তার নিরিখে অনুষ্ঠানের সময়সীমা ক্রমে এক থেকে দুই এবং দুই থেকে তিন ঘন্টা পর্যন্ত করা হয়।

অগ্নিকন্যা শিখার লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে‌। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের প্রথম সাঁওতালি ভাষার মহিলা আর জে। লক্ষাধিক মানুষের কাছে শিখা অনুপ্রেরণা, আগামীর আশ্বাস। গর্বের একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক রেডিও দিবসের প্রাকলগ্নে শত শত শিখা ছড়িয়ে পড়ুক দিকে দিকে। যারা সামাজিক বিধিনিষেধের মিথ্যা বাতাবরণ কাটিয়ে প্রকৃত মানবতার জয়পতাকা উত্তোলন করবে। তাঁর কথায়, ‘‘আমি সবাইকে বলি মাতৃভাষায় কথা বলা গর্বের। তাই পড়াশোনা, কেরিয়ারের প্রয়োজনে অন্য ভাষা শিখতে হলেও মাতৃভাষা শিখতেই হবে। আমি যে সামান্য ক্ষেত্রে আমার শিকড়ের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করি, সেটাই আমার কাছে ভাষা দিবস উদ্‌যাপন।’’