Monday, February 3, 2025
সম্পাদকীয়

বিনোদনে বিভেদের রাজনীতি

আবার ধর্ম আর রাজনীতির কচকচি। বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি যেন ক্রমশ বিনোদন কম, রাজনীতির আখড়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর এই রাজনীতিও নিছক নিজেদের স্বার্থান্বেষী ও নেতিবাচক দলীয় প্রচারে প্রয়োগ করা নয়। বিষয়টা তার থেকেও ভয়ংকর! এদের লক্ষ্য একটাই–ভোটবাক্সের ঝনঝনানি নিশ্চিত করা। এরজন্য আম জনতার মস্তিষ্কে যত পারো একটা অসুস্থ মাত্রার সুড়সুড়ি দাও–সে সিনেমা হোক বা রাজনৈতিক প্রচারের মঞ্চ ! আলোচনায় বাজার গরম করেছে বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত, অনুপম খের ও মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’। বিবেকের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তি থেকে গত কয়েক বছরে শাসকদলের সঙ্গে অনুপমের অতিরিক্ত মাখামাখি–’দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ প্রসঙ্গে বাতাসে ঘুরছে কথাগুলি। আর একদা নকশাল মিঠুন তো প্রথমে ঘাসফুল হয়ে, পরে নিজের ছেলের অপরাধ গোপনের স্বার্থে নির্লজ্জের মতো জার্সি বদলে আজ গেরুয়া শিবিরে।

মুক্তির অনেক আগে থেকেই বিতর্কের তুঙ্গে ছবিটি। এ ছবি নির্মাণের উদ্দেশ্য যে কোনও এক সময়ের ইতিহাসকে তুলে ধরা নয়, বরং ঐতিহাসিক তথ্যকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক প্রচার, সেটা একটা শিশুও বোঝে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, আজ এত বছর পর হঠাৎ করে বিষয়টির অবতারণার মধ্য দিয়ে নির্মাতারা কোন সত্য বাজারে আনতে চাইছেন ? ছবিতে ভিডিও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে দর্শক দেখছে, শুনছে, জানছে সন্ত্রাস ও চরম অত্যাচারের শিকার প্রথম প্রজন্মের কাশ্মীরী হিন্দু পন্ডিতদের কথা ! যারা অপরাধী, তাদের অপরাধের সত্যতা নির্ধারণ করে শাস্তি প্রদান একটা প্রশাসনিক পদক্ষেপ। তাই বলে দেশের সব মুসলিম হলো নাজি আর হিন্দুরা ইহুদি ? এতো সুপরিকল্পিত ভাবে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরির চক্রান্ত ! অভিযোগটা উঠেছে এখানেই। শুধু তাই নয় জেএনইউ-কে জাতীয়তা বিরোধী সন্ত্রাসবাদের বন্ধু শিক্ষায়তন বলে অভিহিত করা হয়েছে ছবিতে ! এটাও কী আইন-প্রশাসনের ভিত্তিতে এখতিয়ার বহির্ভূত নয় ?

ইতিমধ্যেই এ ছবির মুক্তিকে ঘিরে কী কী টেনশন সৃষ্টি হতে পারে, সেই আশঙ্কায় দিল্লি সরকার প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। অনেকেই এ ছবিকে একপেশে মতাদর্শযুক্ত বলে চিহ্নিত করেছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-কে ট্যাক্স ফ্রি ঘোষণা করায় বিতর্ক আরও বেশি দানা বেঁধেছে। বহু উন্নতমানের, উৎকর্ষ ভাবনার ছবি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যায়। মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে না। সেইসব ছবি নিয়ে তো এইসব সরকারের কোনও আগ্রহ চোখে পড়ে না !

ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্য পেলেও সমালোচনার উর্দ্ধে নয়। প্রচারসর্বস্ব ছবির সব ত্রুটিই এখানে প্রকট। চিত্রনাট্যে কাঙ্খিত স্বচ্ছতা ও ঘটনার ধারাবাহিকতা মাঝে মাঝেই মেলে না। সমালোচকরা বলছেন, ছবির বক্তব্য এমন, এ যেন, ‘আমরা মানুষকে ততটাই দেখাবো, যতটা একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নথিস্বরূপ হতে পারে’। যে সমস্ত সংবাদ মাধ্যম এ ছবির ন্যূনতম সমালোচনা করেছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাদের তীব্র আক্রমন করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর মেরুকরণ নীতি আজ কোন ভয়াবহ পরিণতি-মুখী। তিনি কেন এসবের মধ্যে আসবেন ? দেশের প্রধান হিসেবে তাঁকে তো প্রকৃত নিরপেক্ষ থাকতে হবে !

সিনেমা সমাজ ও জীবনের আয়না। শিল্প বা বিনোদন, যেটাই বলি, সেখানে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, প্রকৃত সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সামগ্রিকভাবে দায়িত্ববোধ থাকা জরুরি। একটি ছবি ইতিহাসের দলিল হতে গেলেও, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখতে হয় সংশ্লিষ্ট সকলকে। তার প্রধান, কোথাও যেন ছবির বিষয়কে ঘিরে অশান্তি দানা না বাঁধে। নতুন কোনও জটিল আবর্ত যেন সৃষ্টি না হয়। দেশের অভ্যন্তরে অস্থিরতা তৈরি হয় ! ইতিহাসের দলিল দূর, এখানে প্রচুর সত্যের অপলাপ ঘটেছে।  ছবির প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতাদের সেই অর্থে কোনও পরিণতমনস্কতা ছিল বলে মনে হয় না। সস্তায় বাজিমাত ও পোষণনীতিই ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর টিআরপি। অনুপমরা এটাই চেয়েছেন।