খুশ রহনা দিদি…
চলার পথে এমন কিছু মানুষের দেখা আমরা সকলেই পাই, যাঁদের কখনও ভুলতে পারি না, ভোলা যায় না, তাঁদের নিয়েই এই সিরিজ। পড়ুন চয়নিকা বসুর কলমে।
এই মানুষটার নাম আজ আর আমার মনে নেই। থাকার কথাও নয়। একে তো একদিন, সামান্য সময়ের দেখা। তারমধ্যে সেটাও বহু আগে–দশ/পনের বছর তো হবেই। নাম ভুললেও তাকে ভুলিনি। সেসময় আমার একা একা বেড়াতে বেরিয়ে পড়াটা শুরু হয়ে গেছে। এমনই এক তপ্ত দাবদাহের দিন সেটা। আমি একটি সংবাদপত্রের সান্ধ্য বিভাগের বিনোদন অংশটি দেখাশোনা করতাম তখন। পয়লা বৈশাখে সান্ধ্য এডিশন বন্ধ থাকে। ওই ছুটির সঙ্গে মিলিয়েই আরও দুটি দিন কোনও ভাবে ম্যানেজ হয়ে গেছিল। একটা রবিবার পাই। আর একটা অন্য কিছু। মোদ্দা কথা, কাছাকাছি বেরিয়ে পড়ার সুবর্ণ সুযোগ।
সুযোগের সদ্ব্যবহারে এদিক-ওদিক খোঁজ করছি। এক চেনা ভাই বললো, “দিদি দেওঘর চলে যাও। খুব সহজে পৌঁছে যাবে। আমি থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।” রাজি হলাম, তবে, একটু কিন্তু কিন্তু করে। আমি রেজিস্টার্ড অধার্মিক মানুষ। দেওঘর মানে তো বৈদ্যনাথের মন্দির। আমার সেই ভাই বুঝতে পেরেই হেসে বললো, “আরে, মন্দির ছাড়াও আরও অনেক কিছু আছে। তুমি গিয়ে দেখো !” ঠিক আছে, গিয়েই দেখা যাক। পরে, মনে হয়েছিল, না এলে খুবই ভুল হতো। এবার মূল প্রসঙ্গে যাই। দেওঘর মাত্র দু’রাত ছিলাম। তার মধ্যেই যা ঘোরাঘুরি। এরমধ্যে দ্বিতীয়দিন সকালে বৈদ্যনাথ দর্শনে যাব, ঠিক হলো।
দেওঘরে প্রচুর হোটেল আছে। আর আছে বিভিন্ন নামী ধর্মীয় সংস্থা পরিচালিত আশ্রম ও তৎসংলগ্ন অতিথিনিবাস। এমনই এক অতিথিনিবাসে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়। বৈদ্যনাথ মন্দির সহ বাকি সমস্ত জায়গায় যাওয়ার ব্যবস্থা আশ্রমের পক্ষ থেকেই করে দেন আশ্রম সেক্রেটারি। সেই ব্যবস্থামতো আগের দিন সন্ধ্যায় তিনি জানিয়ে দেন পরদিন সকালে মন্দিরে যাওয়ার রিকশা আসবে। রিকশাচালক তাঁর চেনা ও নির্ভরযোগ্য। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। তবে, সকাল ঠিক বলা যাবে না। মন্দিরে যাওয়ার জন্য আমাকে ভোর সাড়ে চারটায় বের হতে হবে। রিকশাচালক জানে। সে ঠিক চলে আসবে। তিনি এও বললেন, “আপনি দারওয়ানকেও একটু বলে রাখুন। আমিও বলে দিচ্ছি। ও আপনাকে গেটের তালা খুলে দেবে।”
ঘড়ির এলার্ম সেট করে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিছুটা টেনশন রয়েই গেল, ভোর চারটায় ঘুমটা ঠিক ভাঙবে তো ? যদিও পরদিন এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙা থেকে আশ্রমের গেটে পৌঁছনো পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই হলো। গেটের বাইরে বেরিয়েই দেখি রিকশা দাঁড়িয়ে। চালক এক বিহারী তরুণ। আমাকে দেখেই মাথা নুইয়ে ‘নমস্তে’ জানায় সে। আমি রিকশায় উঠে বসি। অন্ধকার তখনও নিবিড়। রিকশা আশ্রমের সামনের রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তায় এলো। এখনও পর্যন্ত একটি লোক বা গাড়ির দেখা পাইনি। রিকশার প্যাডেল ঘোরাবার আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে ভাবতে বসি, আমিও তাহলে দেবতার মন্দিরে চললাম। অবুঝ মনকে বোঝালাম, আরে, আর কিছু না হোক, এই মন্দিরের তো একটা ঐতিহাসিক মূল্যও আছে।
মন্দিরের প্রায় কাছে এসে যাওয়ার পর রিকশাচালক ভাই, ধরে নেওয়া যাক তার নাম লক্ষণ, প্রথম কথা বলে সেই শুরুর ‘নমস্তে’র পর। সে যেটা বলে, তা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়,”দিদি, আপনি তো পুজো দেবেন। অনেকক্ষণ সময় লাগবে। এখানে রিকশা রাখতে দেবে না। আপনার হয়ে গেলে ফোন করে দেবেন, আমি চলে আসবো।”–বলে সে তার নম্বর দিতে যায়। আমি বলি, পুজো আমি দেব না। শুধু মন্দির দেখেই চলে আসবো। লক্ষণ প্রায় ভিরমি খেয়ে বলে, “কী বলছেন দিদি, বাবার মন্দিরে এসে পুজো দেবেন না ?” বলতে বলতে কান মলে নিজের। যেন বাবার কাছে আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নেয় সে। তারপর বলে, “পান্ডা লাগবে তো আপনার?” জবাবে আমি,”হা। সে একজনের নম্বর দিয়ে দিয়েছেন সেক্রেটারি মশাই!” লক্ষণ দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে, ফোন নাম্বার দিয়ে চলে যায়। যেন আমার ভক্তির অভাবজনিত ক্ষতিপূরণের তাগিদেই তার এই বারংবার প্রণত হওয়া।
আমি মন্দিরের সীমানায় ঢুকি। অত ভোর, তখনই প্রায় লোকে লোকারণ্য। তারপরের পর্ব নিয়ে বিস্তারে যাব না। পান্ডার সঙ্গে দেখা হওয়া ও পুজো ইত্যাদি সেরে বের হতে হতে বেশ কিছুটা সময় যায়। বাইরে বেরিয়ে ফোন করতেই লক্ষণ এসে যায়। আর দেখা হওয়ার পর তার প্রথম প্রশ্ন, “দিদি পুজো দিলেন ঠিকঠাক ?” আমি হেসে বলি, “হা রে বাবা ! শুধু পুজো নয়, পান্ডা মশাই আমার কপাল ছুঁইয়ে দিয়েছেন বাবার পায়ে।” এবার সেও হাসে। খানিকটা আমার পুণ্য সঞ্চয় সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়েই যেন। ফেরার পথে একটু সময় বেশি লাগে। রাস্তাঘাটে লোকজন, গাড়িঘোড়া। তারই মধ্যে লক্ষণ যত্নে আমায় আশ্রমের গেটে নিয়ে আসে। তারপর তার ভাড়া সংক্রান্ত টাকাপয়সা নিয়ে কিছুক্ষণ টানাটানি। কিছুতেই বলে না। অনেক কষ্টে তার মুখ থেকে বলিয়ে, আমি কিছুটা বেশিই দিই। যদিও এটা তার বিচার। আমি জানি যেটাই দিই, সেটা কম। যে আন্তরিকতা নিয়ে সে ভোররাত থেকে আমার সঙ্গে রয়েছে, তার পরিমাপ টাকায় হয় না।
বিকেলে লক্ষণ আবার এলো, আমার কথায়। নওলখা মন্দিরে যাব তার রিকশায়। সেখানকার নিয়মকানুন সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয় সে আমায়। বলে, বাবার মন্দিরের প্রসাদী প্যারা খেয়ে খুব খুশি তার বাড়ির লোক। এটা সকালের পর্ব। আমি প্রসাদের একটা আলাদা চুবড়ি নিয়েছিলাম লক্ষণের জন্য ইচ্ছে করেই। আদতে ওরই তো প্রাপ্য এই পুজোর প্রসাদ। আমি তো এখানে বেড়াতে এসে, পড়ে পাওয়া চোদ্দআনার মতো এই পুজো ইত্যাদির অংশীদার হয়েছি। আমার তো লক্ষণের মতো খাঁটি ভক্তি নেই। নওলখা মন্দির থেকে আশ্রমে যখন ফিরছি, তখন সন্ধ্যা নামছে। ঘরে ফিরছে পাখির দল। লক্ষণ ভাড়া নিয়ে হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নেয়। বলে যায়, “খুশ রহনা দিদি। ফির আনা।” দেওঘর আর যাওয়া হয়নি। এক জায়গায় দ্বিতীয়বার সচরাচর যাওয়া হয় না। কিন্তু, স্মৃতি থেকে যায়। আর সেই স্মৃতির ঘরে চিরকাল বেঁচে থাকে লক্ষণের মতো মানুষরা।