Monday, February 3, 2025
অন্য সিনেমা এবংবিনোদন প্লাস স্পেশাল

প্রকৃতির প্রতি বরাবরই অমোঘ টান অনুভব করি

সিনেমা ওঁদের প্যাশন। প্রতিভা, মেধা, দক্ষতা আর নতুন নতুন ভাবনার আলিঙ্গনে বিচিত্র পথগামী ওঁরা। কেউ পূর্ণদৈর্ঘের ছবি নির্মাণে ব্যস্ত, কেউ তথ্যচিত্র বা ছোট ছবি। কখনও স্বাধীনভাবে, কখনও সামান্য বিনিয়োগ―স্বপ্নের কারিগররা ব্যস্ত তাঁদের নিজের ভুবনে। এইসব সিনেমা পরিচালক ও তাঁদের কাজ নিয়েই এই বিভাগ। এবার অমিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপচারিতা। কথা বলেছেন অজন্তা সিনহাআজ প্রথম পর্ব।

তথ্যচিত্রই বানাবে, শুরু থেকেই এমনটা ভাবনায় ছিল ? না অন্য কোনও ঘটনা বা প্রেক্ষিত দিকনির্দেশ করে দিল ?

না, প্রথম থেকেই তথ্যচিত্র নির্মাণের কোনও পরিকল্পনা ছিল না। তবে, সৃজনধর্মী কাজ ভালো লাগতো। কলেজে পড়ার সময় থেকেই লিখতাম। প্রথমে লিটল ম্যাগাজিন, পরে বাণিজ্যিক পত্রিকায়। আমার প্রথম ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আমার কবিতা লিখে পাওয়া চেক ভাঙানোর জন্য খোলা। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করার পর আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে পরিচয় হয় চিত্রপরিচালক তরুণ মজুমদারের সঙ্গে। তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাই। অবশ্যই গিল্ডের নিয়ম অনুযায়ী ‘অবজার্ভার’ তকমা নিয়ে। বছর দেড়েক কাজ করেছি তরুণ মজুমদারের সঙ্গে। অনেক কিছু শিখেছি। সব থেকে বেশি শিখেছি কী ভাবে কাজের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলাপরায়ণ হতে হয়। কী ভাবে খুঁটিনাটি খেয়াল রাখতে হয়। তবে টালিগঞ্জের সেই সময়কার অন্য পরিচালকদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া অন্যদের কাজ ভালো লাগতো না। সার্বিক পরিবেশও ভালো লাগতো না। এদিকে শুধু তরুণ মজুমদারের সঙ্গে কাজ করলে খুব বেশি রোজগার হবে না। তাই সহকারী পরিচালকের কাজ ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতা করতে চলে যাই। তখন আবার নতুন করে সম্পর্ক গড়ে ওঠে চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে। শেষের দিকটায় অবশ্য রাজনীতি, অপরাধ ও অন্য নানা বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে। আঠেরো বছর সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সাংবাদিকতা করার পর, সব ছেড়ে তথ্যচিত্র তৈরিতে মন দিই। এই কাজে আমার শিল্পী মনকে ছাপিয়ে যায় সাংবাদিক মন। আজও যা অব্যাহত। এখন তথ্যচিত্র নির্মাণটাই একমাত্র জীবিকা। লেখক হওয়া হয়নি। লেখা অনেক পিছনে পড়ে রয়েছে।

Img 20211016 Wa0024

তথ্যচিত্র আর স্বল্পদৈর্ঘের ছবির মধ্যে পার্থক্য কী নিছক গল্প থাকা বা না থাকা ?

না, স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি আর তথ্যচিত্রে পার্থক্য শুধু গল্প থাকা না থাকা নয়। আমার বিশ্বাস, তথ্যচিত্র চাইলে একটা গল্পকে অনুসরণ করতেই পারে। তথ্যের আধারও হয়ে উঠতে পারে গল্প। তবে, তথ্য দেওয়াটাই হতে হবে মূল উদ্দেশ্য। তথ্যচিত্র সব সময় স্বল্পদৈর্ঘ্যের না-ও হতে পারে। আবার অনেক স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতে গল্প না-ও থাকতে পারে। একটা বিমূর্ত ভাবনার সিনেম্যাটিক রূপায়ণ হতেই পারে। যদিও আমি মনে করি, কাহিনিচিত্র সে স্বল্পদৈর্ঘ্যের হোক বা পূর্ণদৈর্ঘ্যের, তা কিছু না কিছু তথ্যকে তুলে ধরে। যে কোনও কাহিনিচিত্র তার কাহিনির সময়কালের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথ্য পরিবেশন করে। যদিও তার উদ্দেশ্য তথ্য পরিবেশন নয়।

প্রথম কাজের অভিজ্ঞতা জানাও।

প্রথম তথ্যচিত্রটি বানাবার সুযোগ পেয়েছিলাম আরণ্যক প্রকৃতির লীলাভূমি ঘাটশিলায়। সুবর্ণরেখা নদী, সবুজ পাহাড়, গহন অরণ্য, আদিবাসী গ্রাম ও জনজীবনের ছবি ক্যামেরায় ধরার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়েছিলাম। বরাবরই অরণ্য তথা প্রকৃতির প্রতি একটা অমোঘ টান অনুভব করি। প্রথম তথ্যচিত্রে সেই প্রকৃতিকে কাছ থেকে পেয়েছি। খুব কাছ থেকে পেয়েছি সহজ-সরল মানুষকে, যাদের বাদ দিয়ে প্রকৃতিকে কল্পনা করা যায় না। আমার প্রথম তথ্যচিত্রটি ছিল নেহাতই প্রচারমূলক একটি ছবি। অবিশ্বাস্য কম টাকায় তৈরি সেই ছবিটি ছিল ঘাটশিলার কংগ্রেস বিধায়ক প্রদীপকুমার বালমুচুর উন্নয়নমূলক কাজ নিয়ে। বিষয় যাই হোক, প্রথম ছবি প্রথম ছবিই। এই সুযোগ দেওয়ার জন্য আমি আজও প্রদীপবাবু ও ঘাটশিলার কাছে কৃতজ্ঞ।

Img 20211016 Wa0029

যাবৎ যে উল্লেখযোগ্য কাজগুলি করেছ, তার সংক্ষিপ্ত পরিচয়।

আমার কোনও তথ্যচিত্র উল্লেখযোগ্য কিনা জানি না। তবে, কিছু ছবি আছে বিশেষ পছন্দের। গত দশ বছরে প্রায় আড়াইশো তথ্যচিত্র তৈরি করেছি। তার মধ্যে বেশিরভাগ ছবিই রোজগারের জন্য করা। কিন্তু কিছু ছবি রোজগারের সঙ্গে সঙ্গে তৃপ্তিও দিয়েছে।

বিশ্বখ্যাত সারাণ্ডা অরণ্যের উপর একটি ছবি করেছিলাম ঝাড়খণ্ড সরকারের জন্য। নাম ‘সারাণ্ডা দ্য গ্রিন হেভেন’। এই ছবিটিতে সারাণ্ডা অরণ্যকে তার বৈচিত্র্য ও জাদু সহ তুলে ধরেছি।

ঝাড়খণ্ড সরকারের জন্য তৈরি ‘ছোটি সি মুলাকাত’ রাঁচির ‘ভগবান বিরসা বায়োলজিকাল পার্ক’ নিয়ে। আরণ্যক পরিবেশে তৈরি এই জৈবিক উদ্যান দেশের অন্যতম সেরা চিড়িয়াখানা।

আর একটি ছবির কথা বলি। বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ক’রে তার মাধ্যমে কীভাবে একটি অঞ্চলের কৃষি সহ জনজীবনকে স্থায়ী উন্নতির পথে পৌঁছে দেওয়া গেছে সেটাই তুলে ধরেছিলাম ‘সচ’ নামে একটা ছবিতে। ঝাড়খণ্ড সরকারের এই ছবিটি তৈরি করেছিলাম গুমলা জেলায়। বাগডোগরার চা বাগানের আদিবাসী মেয়ে রোমা এক্কা অসাধারণ অ্যাঙ্কারিং করেছিল। উরাঁও কন্যা রোমা এখন সমাজকর্মী।

Img 20211016 Wa0034

আর একটি ছবির কথা বলি। এটি দার্জিলিংয়ের ১৪২ বছরের প্রাচীন বোটানিক্যাল গার্ডেন নিয়ে। নাম ‘ইন টু দ্য গ্রিন’। উল্লেখ করবো, ভারতীয় পর্যটনের গান্ধি রাজ বসুকে নিয়ে তৈরি ছবি ‘অপ্রতিম’-এর কথা। অন্য ছবিটি পর্যটনের মাধ্যমে প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নয়ন। এই ছবিটির নাম ‘স্বপ্নের দিগন্ত।’ এই দুটি ছবিতে কিছু আর্থিক সহায়তা করেছিলেন শিলিগুড়ির ব্যবসায়ী তথা সমাজসেবী নরেশ আগরওয়াল। শেষ যে ছবিটির কথা বলব সেটির নাম ‘অন্য মানুষ’। পরিবেশ ও সমাজকর্মী রামকুমার লামাকে নিয়ে তৈরি। যে ক’টি ছবির কথা বললাম, তার সব কটি আমার নিজের প্রোডাকশন হাউস ‘আরণ্যক ক্রিয়েশনস’-এর ব্যানারে তৈরি এবং ইউটিউবে আছে। আর এই ছবিগুলির সহযোগী কিম্বা সহ পরিচালক আমার পুত্র অরণ্য মুখোপাধ্যায়। (চলবে)