মত প্রকাশ খুব সাবধানে করতে হয়
সিনেমা ওঁদের প্যাশন। প্রতিভা, মেধা, দক্ষতা আর নতুন নতুন ভাবনার আলিঙ্গনে বিচিত্র পথগামী ওঁরা। কেউ পূর্ণদৈর্ঘের ছবি নির্মাণে ব্যস্ত, কেউ তথ্যচিত্র বা ছোট ছবি। কখনও স্বাধীনভাবে, কখনও সামান্য বিনিয়োগ―স্বপ্নের কারিগররা ব্যস্ত তাঁদের নিজের ভুবনে। এইসব সিনেমা পরিচালক ও তাঁদের কাজ নিয়েই এই বিভাগ। এবার অমিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপচারিতা। কথা বলেছেন অজন্তা সিনহা । আজ দ্বিতীয় পর্ব।
◆ তথ্যচিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে গবেষণা একটি অন্যতম প্রধান দিক। এই কাজটা কীভাবে করা হয় ?
তথ্যচিত্র কেন, যে কোনও ছবি তৈরির ক্ষেত্রেই গবেষণা একটি জরুরি কাজ। না হলে ছবি অগভীর কিংবা ভুলে ভরা হবে। এর নিদর্শন আমরা অনেক যশস্বী পরিচালকের ছবিতেও দেখি। কারও ছবিতে দেশের স্বাধীনতার সময় পাহাড়ে আকেশিয়া গাছের প্ল্যান্টেশন দেখা যায়। যদিও এই গাছ ভারতে এসেছে অনেক পরে। কারও ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে ছবিতে ব্যারাকপুর ও বহরমপুরে পাহাড় দেখা যায়। তাই গবেষণা জরুরি। আর সেটা আমি নিরন্তর চালিয়ে যাই। এ পর্যন্ত এমন কোনও বিষয়কে ছবিতে ধরিনি, যাকে আমি সাংবাদিক জীবন বা পরবর্তীকালে ছুঁয়ে-ছেনে দেখিনি। আমার পথ চলা ও দিন যাপনের প্রতিটি মুহূর্ত নানা বিষয়ে অনুসন্ধানে নিবেদিত।
◆ কোনও জনজাতি বা এলাকাভিত্তিক কাজ হলে, তার প্রস্তুতি কীভাবে নিতে হয় ?
যেহেতু আমার বেশিরভাগ কাজের ক্ষেত্র ঝাড়খণ্ড, তাই জনজাতিকে নিয়ে কাজ করতেই হয়। মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশাতে জনজাতিকে নিয়ে কাজ করেছি। এমনকী এই বাংলাতেও আদিবাসী জনজীবনকে তুলে ধরেছি। এর জন্য সবার আগে দরকার, সব আদিবাসীকে সাঁওতাল বলা বন্ধ করা বা সাঁওতালদের শুধু আদিবাসী বলা বন্ধ করা। প্রতিটি জনজাতি তার উৎস ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন। সেই ভিন্নতাটা বুঝে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কোথাও সাযুজ্য থাকলে সেটাও জানতে হবে। জনজাতির প্রতি ভালোবাসা থাকাটা একান্ত প্রয়োজন। আর দরকার তাদের গণ্ডীবদ্ধ বা চিড়িয়াখানার জীব মনে না করা। আধুনিক সময়ের কোনও ছাপ তাদের জীবনে পড়লে, আদিবাসীরা উচ্ছন্নে গেল–এই ধারণাটাও অসম্পূর্ণ ও একপেশে। এই প্রস্তুতিগুলো থাকলে আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সহজ হয়। আর যদি শুটিং যে অঞ্চলে হবে, তার ভৌগোলিক ভিন্নতার কথা বলেন, তাহলে বলব, ‘ইকোলজিকাল জোন’ অনুযায়ী শুটিংয়ের পরিকল্পনাটাই বদলে যায়। তবে আমাদের দেশে অঞ্চল বদলানো মানে সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতটাই বদলে যাওয়া।
◆ স্বাধীনভাবে যে কাজগুলি করো, তার বিষয় নির্বাচনে কোন কোন দিককে গুরুত্ব দাও ?
আমার মতো গড়পড়তা মানুষ কি ‘স্বাধীন’ ভাবে কাজ করতে পারে? শুধু সোজাসাপটা ভাবে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বললেই আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের নানা স্তরের পেয়াদা এসে কান মুলে দেবে। তাই মত প্রকাশ খুব সাবধানে করতে হয়। তবে স্বাধীন ভাবে বিষয় নির্বাচনের সুযোগ থাকলে আমি প্রকৃতিনির্ভর বিষয় বাছবো। মাটির মানুষের স্পর্শ থাকা বিষয় বাছবো। মাটির কাছাকাছি থেকে কোনও কাজ করার থেকে আনন্দদায়ক আর কিছু নেই।
◆ কোনও কিংবদন্তী মানুষকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করলে, কার কথা ভাববে ও কেন ?
কিংবদন্তী কোনও ব্যক্তিত্ব নিয়ে ছবি করার সুযোগ থাকলে আমি চারজনকে নিয়ে চারটি ছবি করতে চাইবো। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু, সমরেশ বসু ও দেবব্রত বিশ্বাস । একের পরে এক। ক্রম পর্যায়ে।
◆ এঁরাই কেন ? এঁদের কোন বৈশিষ্ট্যগুলো তোমায় পৃথকভাবে ভাবিয়েছে ?
এই চারজনকে বাছাইয়ের নির্দিষ্ট কিছু কারণ আছে। আমি যাঁদের লেখা পড়ে প্রকৃতি, মানুষ ও পথকে চিনেছি, তাঁদের প্রধানতম দুই ব্যক্তি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সমরেশ বসু। দুজনেই প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে মিশে গিয়ে প্রকৃতি ও মানুষকে দেখেছেন। ওই দেখাটা আমাকে প্রভাবিত করেছে। আমাকে দেখতে ও ভাবতে শিখিয়েছে। আমার পথের প্রতি টান তৈরিতে সমরেশ বসুর অবদান সর্বাধিক। বিশেষ করে তাঁর কালকূট ছদ্মনামে লেখা উপন্যাস ‘কোথায় পাব তারে’ আমাকে পথে নামিয়েছে। আসলে বিভূতিভূষণ ও সমরেশ বসু তাঁদের দেখা ও লেখার উপর তথাকথিত আভিজাত্যের কোনও আড়াল টানেননি। তাই বাংলা সাহিত্যে তাঁরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সেই জন্য আমি এই দুজনকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরির স্বপ্ন দেখি।
আর রাজশেখর বসুর প্রতি টান অন্য কারণে। একজন বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রযুক্তিপ্রিয় মানুষ, যাঁর পেশা একটি বিজ্ঞান বিষয়ক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা– তাঁর মনের ভিতর খাঁটি বাঙালিয়ানার বাস আমাকে টানে। তাঁর ‘পরশুরাম’ ছদ্মনামে লেখা গল্পগুলির মধ্যে বাঙালি জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ দিকগুলিও কেমন অন্যমাত্রায় প্রকাশ পেত। এই মানুষই আবার ধ্রুপদী সাহিত্য মহাভারত অনুবাদ করেন। রাজশেখর বসু বাংলা সাহিত্যের এক অন্য দিগন্ত। তাই তাঁকে নিয়েও ছবি করতে চাই।
বাংলার আর এক কিংবদন্তী মানুষ দেবব্রত বিশ্বাস। তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র করতে চাই। কারণ, রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর কন্ঠে যে ভাবে প্রকাশ পেত, তাঁর সমকালে অন্য কারও কন্ঠে তা পেত না। তার পরেও পায়নি। এটা যদিও আমার নিজস্ব মত। দেবব্রতর গাওয়া বসন্তের গান বর্ষায় শুনলেও বসন্তের বাতাস বয়। ফাল্গুনে বর্ষার গান শুনলে বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় ভেসে আসে। ভিজিয়ে দেয়। অমন নিখুঁত উচ্চারণ আর কারও মুখে শুনিনি। তা ছাড়া দেবব্রত বিশ্বাসের জীবনের ঘটনাগুলিও আকর্ষণ করে। (চলবে)