কিশোরকুমার ছাড়া আর কারও গান শুনি না
চলার পথে এমন কিছু মানুষের দেখা আমরা সকলেই পাই, যাঁদের কখনও ভুলতে পারি না, ভোলা যায় না–তাঁদের নিয়েই এই সিরিজ। পড়ুন চয়নিকা বসুর কলমে।
পুজোর ছুটিতে চলেছি সিকিমের পশ্চিম দিকের এক গ্রাম ওখরে-তে। এটা জোরথাং হয়ে যেতে হয়। জোরথাং সিকিমের বেশ বড় গঞ্জ মতো একটি অঞ্চল। এখান থেকেই বিভিন্ন দিকে যাওয়ার সার্ভিস গাড়ি মেলে, যেগুলো শেয়ারে যাত্রী ও মালপত্র দুইই বহন করে। তখনও কলকাতায় থাকি। ফলে উত্তরবঙ্গ বা সিকিমের দিকটায় আসা মানে নানান ঝক্কি। সারারাত ট্রেন জার্নির পর এনজেপি স্টেশন। সেখান থেকে শিলিগুড়ি তেনজিং নোরগে বাস স্ট্যান্ড। এক ভাতের হোটেলে যতটা সম্ভব ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করে সিকিম ট্যুরিজমের বাসে যখন উঠেছি, সূর্য তখন মাথার ওপরে। আর সিকিম বর্ডারে লম্বা লাইনের চেকপোস্ট পার হয়ে যখন জোরথাং পৌঁছলাম, ততক্ষণে আমার আশঙ্কা সত্যি করে ওখরে যাওয়ার শেষ সার্ভিস গাড়িটাও চলে গেছে। মাথায় হাত ! কারণ, জোরথাং-এ রাত্রিবাসের কোনও জায়গাই নেই।
যাই হোক, কলকাতায় ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করে, পরিস্থিতি জানিয়ে একটি রিজার্ভ গাড়ির ব্যবস্থা হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক স্থানীয় তরুণ এল আমার কাছে। দ্রুত ভাড়া ইত্যাদি রফা করে নিলাম। ছেলেটি জানালো, গাড়ি ও ড্রাইভারের ব্যাবস্থা করতে আধঘন্টার মতো সময় লাগবে। এছাড়াও ড্রাইভারকে রাতের খাওয়া খেয়ে নিতে হবে। আমাকে ছেড়ে আসতে মাঝরাত্তির হয়ে যাবে তার। অতএব…! এরপর সে আমাকে কিছু দূরের এক দুর্গা মন্দিরে নিয়ে গেল। মালপত্র নিতে দিল না আমায়। নিজেই নিয়ে গেল। বললো, “এখানে বসুন। সন্ধ্যারতি হবে এখন। ভালো লাগবে আপনার।” বলে চলে গেল সে। পরে জেনেছিলাম ছেলেটি বেশ কয়েকটি গাড়ির মালিক। বিশাল ধনী। দিব্যি আমার মাল বয়ে নিয়ে গেল।
কাঁটায় কাঁটায় সাতটায় একটি ছেলেকে নিয়ে গাড়ির মালিক এল। সদ্য কৈশোর পার হওয়া এই ছেলেই নাকি গাড়ির চালক। ঘন অন্ধকারে বিপদসংকুল পাহাড়ী পথে এর ভরসাতেই নাকি যেতে হবে আমায়। আমার মুখের ভাব দেখে গাড়ির মালিক বলে, “চিন্তা করবেন না। ও দেখতে ছেলেমানুষ, কিন্তু গাড়ি খুব ভালো চালায়।” গাড়ি শহর ছাড়িয়ে যাবার একটু পরেই ড্রাইভারের থেকেও কম বয়েসী আর একটি ছেলে গাড়িতে উঠলো। ড্রাইভারের কথায়, ফেরার সময় একা একা ‘বোর’ হবে নয়তো সে। ঠিকই তো ! ততক্ষণে লোকালয় ছেড়ে গাড়ি পাহাড়ী পথে ঢুকেছে। সন্ধে হতেই সে পথ জনমানবশূন্য। ওদের ফিরতে মাঝরাত্তির, সে তো আগেই জেনেছি।
আকাশে সপ্তমীর চাঁদ। তার সঙ্গে চকমকি জ্বালিয়ে আসর সাজিয়েছে তারাদের দল। জোছনায় মাখামাখি শুক্লপক্ষের আকাশ। কিন্তু সে আলো আমাদের চলমান পৃথিবী থেকে অনেকটা ওপরে। এখানে, এই পাহাড়ী পথ নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢাকা। পথ দেখাচ্ছে গাড়ির হেডলাইট। গাড়ি ক্রমশ ওপরে উঠছে। ঠাণ্ডাও বাড়ছে সেই সঙ্গে। জনমানবশূন্য তো বটেই, পথে কোনও বাড়িঘরও নেই, যে সেখান থেকে অন্তত আলো বা শব্দের আভাষ মিলবে। শব্দ বলতে গাড়ির দুই তরুণকণ্ঠের আলাপ, যার আবহে কিশোরকুমারের গান। সে গানও বাজছে খুব মৃদু আওয়াজে। সব মিলিয়ে অনির্বচনীয় এক পরিবেশ। ওরা গলা নামিয়ে কথা বলে। যাপনের একান্তকথা। তারই মধ্যে জানতে চাই, শুধু কিশোরকুমার কেন, আর কারও গান তার গাড়িতে নেই ? জবাব স্পষ্ট, “আর কারও গান শুনি না ম্যাডাম!” পাঠককে বলার দরকার পড়ে না, এই জবাবটা ছিল চূড়ান্ত অপ্রত্যাশিত।
সেই রাতে কতটা পথ চলেছিলাম, জানি না। অন্ধকারে কিছুই বোঝা যায় না। কত যে বাঁক, তার পুরোটাই চড়াই আর অনেকটা উঁচু ! সেটা বুঝলাম তাপমাত্রার নিম্নগমনে! গাড়ির কাচ ভেদ করে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আমি সোয়েটার-চাদরে মুড়েও কাঁপছি। ওরা দিব্যি হালকা পুলওভার পরে গল্প-হাসি-মজায় চলেছে। গরম বলতে ইঞ্জিনের সামান্য অবদান। গন্তব্যে যখন পৌঁছলাম, ঘড়ির কাঁটা তখন দশটা পার হয়েছে। যে হোম স্টে-তে থাকবো, সেই পরিবারটি ঘুমিয়ে পড়েছে। হর্ন বাজিয়ে ওঠানো হলো তাদের। আমায় দেখে হোম স্টে-র মালিক অবাক হয়ে বলেন, “আমরা তো ভাবলাম আপনি আজ আর আসবেনই না।” বাইরে প্রবল ঠান্ডা। অতএব নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে, ফ্রেশ হয়ে, খেয়েদেয়ে কম্বল মুড়ে ঘুমের দেশে গমন।
পরিশেষে, তিনদিন পর ওই একই পথে ফিরছি। দিনের বেলা। কোথাও আলো ঝলমলে উপত্যকা। পাহাড়ের ধাপে ধাপে চা বাগান, ফসলের ক্ষেত। কোথাও গভীর খাদ, সেখানে আলো-আঁধারি রহস্য জমাট বেঁধেছে। অন্যদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়শ্রেণি। পথের ধারে রঙিন ফুলের বাহার। ঘরবাড়িও চোখে পড়লো। আসলে পাহাড়ে লোকজন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। সেইজন্যই সেদিন রাতে যাওয়ার পথে এসব চোখে পড়েনি। কিন্তু পথ ! সে তো আছে তার মতোই। শুধু চড়াই-উৎরাই তো নয়, প্রচুর হেয়ারপিন বেন্ড। কোথাও কোথাও রাস্তা এতটাই সরু যে হিসেবের একটু গোলমাল হলেই খাদে পড়তে হবে। সেই রাতে যে তেমন কিছু ঘটেনি, সেটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ নয়, একান্তভাবে ওই বাচ্চা ড্রাইভার ছেলেটির কৃতিত্ব ! জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, কি নিপুণ হাতে, একচুল এদিকওদিক না করে, আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছিল সে।