Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

মায়াময় ডুয়ার্স ঘিরে

সবুজের উৎসব

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। লিখছেন অজন্তা সিনহা

করোনেশন ব্রিজ পার হয়ে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে চলেছি। পথের দু’পাশে বেশ কয়েকটি চা বাগান এবং প্রাচীন গাছের সারি। এভাবেই পার হলাম মংপং জঙ্গল।  গাছেরা বৃষ্টিতে ভিজে বেজায় খুশি। বৃষ্টির কথাতেই মনে পড়লো, ভরা শরতের সেই ছুটির মরশুমে, বৃষ্টিই বদলে দিয়েছিল আমাদের যাত্রাপথের যাবতীয় রুটিন ভাবনা। আমাদের মানে–আমি, এক বান্ধবী ও তার কন্যা। তখনও পাকাপাকি ভাবে কলকাতা ছেড়ে আসিনি। পুজোর ছুটিতে বন্ধুর সঙ্গে পূর্ব পরিকল্পনা মতো এসেছি উত্তরবঙ্গে। যাওয়ার কথা ছিল কালিম্পং জেলার অন্তর্গত পেডংয়ে। অতি বৃষ্টিতে রাস্তায় ধস নামায় যাত্রার গতিপথ বদলে চলেছি ডুয়ার্স।  

একটু আগেই ঠিক হয়েছে, বাতাবাড়ি অঞ্চলের একটি রিসর্টে আপাতত চেক ইন। ব্যবস্থা করে দিয়েছে উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত হেল্প ট্যুরিজম। রিসর্টের নামটা বেশ মিষ্টি, দুয়ারসিনি। আগে ওখানে পৌঁছই, বাকি পরিকল্পনা পরে হবে। বৃষ্টির দাপট কমার নাম নেই।  ফলে গাড়ির গতি কিছুটা শ্লথ। সে হোক। প্রকৃতির সব কিছুই যাদের ভালো লাগে, আমি সেই পাগলদের দলে। যা দেখি, তাতেই খুশি হয়ে উঠি অকারণ পুলকে। ইতিমধ্যে পর পর বেশ কয়েকটি নদী পার হলাম। শুরু হয়েছে দ্য গ্রেট তিস্তার আনুকূল্যে। এবার একের পর এক নদীর সঙ্গে দেখা। যথাক্রমে লীস, ঘিস, চেল, মাল, নেওড়া, কুর্তি, মূর্তি। সবাই বেশ হৃষ্টপুষ্ট। কে বলবে এটা শরতের শেষ। সব জল থই থই। এমন ফুঁসছে, যেন সুযোগ পেলেই পথের ওপর উপচে পড়বে, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সব । কোথায় যেতাম, আর কোথায় যাচ্ছি, সব ভুলে গেলাম। নদীই  ভুলিয়ে দিল সব।

Img 9 1649216093981
মায়াময় ডুয়ার্স ঘিরে 14

চালসা মোড় থেকে আমাদের গাড়ি ডানদিকে ঘুরলো। দু’পাশে জঙ্গল আর চা বাগান রেখে চওড়া জাতীয় সড়ক সোজা চলে গেছে। কথা মতো ঠিকানা খুঁজে পৌঁছে গেলাম বাতাবাড়ির নির্দিষ্ট রিসর্টে। প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এর পরিকল্পনা ও আনুষঙ্গিক আয়োজন। মন আরও একটু ভালো হয়ে গেল রিসর্টের মালকিনের সঙ্গে দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। কলকাতার এই তরুণী এত দূরে এত সুন্দর এক পর্যটন আবাস তৈরি করেছেন, এমন নিপুণ হাতে চালাচ্ছেন, ভালো তো লাগবেই। নিয়মমতো চেক ইন, ফ্রেশ হওয়া ইত্যাদি সেরে বসলাম ওদের ডাইনিং হলে। নাহ, এটাও মোটেই চির চেনা ডাইনিং হল নয়। আধখোলা, মাথার ওপর প্যাগোডার মতো চালওয়ালা এমন ডাইনিং স্পেসের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। চা আর পকোড়ায় জমে গেল বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা।

হাইওয়ের পাশেই রিসর্ট। হেডলাইট জ্বালিয়ে চলেছে দূরদূরান্তের গাড়ি। মূলত লরি। কিছু দূরগামী লাক্সারি বাস। ছোট গাড়িও আছে। রাত যত বাড়ে, গাড়ির সংখ্যা কমে। ক্রমশ নিঃঝুম হয়ে ওঠে জঙ্গল। নির্জন রাত নামে যথা নিয়মে। ঝিঁঝিদের কনসার্টের মাঝে পাতা থেকে টুপটাপ জল ঝরার শব্দ। দূরে কোথাও শেয়াল ডাকে। ডিনারে ডাল, আলু ভাজা আর মাছের ঝোল খেলাম অতীব তৃপ্তি সহকারে। নির্ভেজাল বাঙালি রান্না। আর দারুণ সুস্বাদু। রিসর্টের মালকিন দেখলাম যথার্থই দশভূজা। রান্নার লোকটিকে নির্দেশ দেওয়া থেকে আমরা পরের তিন দিন কোথায় কোথায় যাব, সবই গুছিয়ে দিল সে।

Img 1 1647408221309
মায়াময় ডুয়ার্স ঘিরে 15

পরের দিন দ্রুত ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। চালসা মোড় থেকে বাঁদিকে কিছুটা যাওয়ার পর আর একটা মোড়। এখান থেকে আবার বাঁদিকে কোনাকুনি একটা অপেক্ষাকৃত সরু পথ। এই পথ দিয়ে একটুখানি যাওয়ার পরই হঠাৎ চোখ ধাঁধানো সবুজ। চওড়া পিচের রাস্তায় উঠলো আমাদের গাড়ি। দু’দিকে জঙ্গল, চা বাগান রেখে সোজা চলল তারপর। এই অঞ্চলটাই গরুবাথান। ওহ, চা বাগানের এমন শোভা ! উত্তরবঙ্গে বহুবার এসেছি, চা বাগানও কম দেখিনি। কিন্তু এমনটা চোখে পড়েনি। বেশ কিছু প্রাচীন গাছ ছাড়াও পথের দু’পাশে রয়েছে ইউক্যালিপটাসের শোভা। আরও কত অচেনা ছোটবড় গাছ !

একটু পরই কানে এলো জলোচ্ছ্বাসের শব্দ। বুঝতে পারলাম, চেল এসে গেছে। হাইওয়ে থেকে আবার এক সরু পথে কিছুটা এগিয়ে একটা বেশ শক্তপোক্ত লোহার সাঁকো পেরিয়ে গাড়ি থামলো। চেল এখান থেকে হাত ছোঁয়া দূরত্বে। রীতিমতো গর্জন করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে সে। পাহাড়ী নদী এমনিতেই খরস্রোতা। তার মধ্যে সদ্য বৃষ্টির জল পেয়েছে, চেল এককথায় এখন আপন বেগে পাগলপারা। কোথাও বাধাহীন তার গতি। কোথাও বিশাল বিশাল বোল্ডারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কিছুটা শ্লথ। অনেক দূরে দূরে পাহাড়শ্রেণী। ওখানেই কোথাও চেল ফেলে এসেছে তার জন্মস্থান। কাছেই এক ছোট ঝর্না। তার জলও এখন দ্রুত নিম্নগামী। কিছুক্ষণ কাটালাম চেলের পাড়ে। নদীর পাশেই এক ছোট্ট চায়ের স্টল, কেক-বিস্কুটও আছে। বাইরে রঙ্গিন ছাতার নিচে চেয়ার পাতা। সেখানে বসে চা-পান ও টুকরো বিশ্রাম সেরে আবার রওনা। এবার ঝান্ডি।

Img 2 1651897966599
মায়াময় ডুয়ার্স ঘিরে 16

চেল নদীকে ঘিরে সৃষ্ট এই পুরো অঞ্চলটাই একটা উপত্যকা। স্বাভাবিক ভাবেই চারপাশে সবুজের সমারোহ। এখান থেকে বেরিয়ে অনেকটা পথ সমতলে চললো আমাদের গাড়ি। তারপর শুরু চড়াই। রাস্তা মাঝে মাঝেই বেশ খারাপ। তা হোক, ওপর থেকে নিচের চা বাগান, গাছপালা, গ্রামের ঘরবাড়ি দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। দেখে মনে হচ্ছিল, যেন কোনও শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি। একটু একটু করে অনেকটা ওপরে উঠে এসেছি আমরা। ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকে সমতলের সেই সব অনুষঙ্গ। পাইনের ছায়া ঘন হয়। প্রাচীন গাছেরা গম্ভীর ভ্রুকুটি নিয়ে দেখে আমাদের। পাইনের রহস্যে ঘেরা ঝান্ডি বড় সুন্দর। সেই সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই মেঘ-কুয়াশার চাদর এসে ঢেকে দেয় সব। হালকা বৃষ্টিও শুরু হয়। এবার নিচে নামার পালা।

লাঞ্চে দুর্দান্ত বোরোলির মাখা মাখা ঝোল। এই মাছটা উত্তরবঙ্গেই শুধু পাওয়া যায়। সঙ্গে সবজি,ডাল, ভাজা আর দারুণ এক চাটনি । এবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম। বিকেলে কাছাকাছি ঘোরা। আকাশ এখন পরিষ্কার। মূর্তি নদীর দিকটায় গেলাম। নদীর ওপরে ব্রিজ, যা সোজা নিয়ে যাবে গরুমারা জঙ্গলের পথে। দু’পাশে ঘন সবুজের চোখ জুড়ানো ছবি রেখে এগিয়েছে পিচ বাঁধানো পথ। শেষ বিকেলের সূর্য রঙ ছড়িয়েছে আকাশ জুড়ে। মূর্তির জলে তারই ছায়া। প্রচুর লোকজন এদিক ওদিক ঘুরছে। নদীর বেশির ভাগ অংশেই চড়া পড়েছে। গভীর নয়, মোটামুটি হাঁটু জল । তার ওপর দিয়ে নিশ্চিন্তে পার হচ্ছে মানুষ, গরুর পাল। পাড়ে বসে আড্ডায় ব্যস্ত তরুণ-তরুণীর দল। বেশ একটা ছুটির আমেজ। আকাশেও গত কয়েক ঘন্টার বৃষ্টির পর সেই শরতের ছুটির আবেশ। মন ভালো করা মুহূর্ত কাটিয়ে ফিরলাম রিসর্টে।

Img 3 1651897980920
মায়াময় ডুয়ার্স ঘিরে 17

ফিরেই চমক। রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠেছে পূব আকাশে। সূর্য অস্তে গেলেও দিনের আলো মুছে যায়নি। তারই মধ্যে এই অপরূপ চন্দ্র দর্শন। এরমধ্যে আকাশের আলো একটু কমেছে। সন্ধ্যা নামছে ধীরে। পাখির দল ঘরে ফেরে। কবির ভাষায়, আক্ষরিক অর্থেই পূর্ণচাঁদের মায়া ছড়িয়ে পড়েছে আকাশের কোণে কোণে। স্তব্ধতা ভেঙে হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি যাতায়াত করে। ডিনারে রুটি আর চিকেন । ক্লান্ত চোখে ঘুম নামতে দেরি হয় না। কানে স্মৃতি হয়ে বাজে সকালে দেখা চেল নদীর কলতান। এবারের ট্রিপটা কার্যকারণে পুরো নদীরই দখলে। পাহাড়, জঙ্গল এবং চা বাগানও ছিল। তবে, মুখ্য ভূমিকায় অবশ্যই নদী। একটু আগের দেখা মূর্তিকে মনে পড়ছিল। তারপর কখন যেন ঘুম নামে চোখে। পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। পর পর যাওয়া হলো সামসিং, লালিগুরাস, সুনতালে খোলা, রকি আইল্যান্ড।

সামসিং মূলত চা বাগান। সে এক অনির্বচনীয় মায়াময় সবুজের দেশ। চালসা মোড় থেকে কিছু দূর সমতলে যাওয়ার পর পথ আবার পাহাড়মুখী। গাড়ি চলছে। শুধুই চড়াই। আর পথের ধারে ধারে প্রাচীন বৃক্ষরাজি। বিশাল মোটা মোটা গুঁড়ি তাদের। একদল বাচ্চা স্কুলে যাচ্ছে। পাশ কাটিয়ে কাজের পথে মানুষজন। সকালের ব্যস্ত জীবনের ছবি দেখতে দেখতে কখন ঢুকে পড়েছি চা বাগানের এলাকায়। দু’দিকে চা বাগান। মাঝে পথ গিয়েছে এঁকেবেঁকে। পৌছলাম লালিগুরাস ভিউ পয়েন্টে। অনেকটা ওপর থেকে নিচে বহতা মূর্তি নদীকে দেখা। জায়গাটা শান্ত, নির্জন। চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। সব মিলিয়ে না ভোলা এক ল্যান্ডস্কেপ।

Img 3 1651982926540
মায়াময় ডুয়ার্স ঘিরে 18

কিছুক্ষণ কাটিয়ে চললাম সুনতালে খোলা। খোলা অর্থাৎ নদী। বেশি চওড়া নয়, তবে খরস্রোতা। সুনতালে মানে কমলালেবু। নদীর কাছে পৌঁছনোর আগেই কমলার বাগান। অবস্থা খুবই খারাপ। গাছগুলি শীর্ণ চেহারা দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। শুনলাম দূষণ জনিত কারণে পোকা লেগে এই অবস্থা। এবার রকি আইল্যান্ড। এখানেও মূর্তি নদী। এখানে তিনি প্রায় উৎসের কাছাকাছি। অনেকটা উঁচু থেকে প্রবল গর্জনে আছড়ে পড়ছে উপচে পড়া জলরাশি। কেন যে এই জায়গাটির নামের মধ্যে আইল্যান্ড শব্দটি এল, তা কেউ বলতে পারলো না। তবে বিশাল বড় বড় বোল্ডার, তার থেকেই রকি, বোঝাই যায়। বেশ জমজমাট একটি স্পট। প্রচুর ট্যুরিস্ট। ফলে বেশ কয়েকটি দোকানপাটও গড়ে উঠেছে। ফটো সেশনের লোভ সামলানো দায়, প্রকৃতি এখানে এতটাই আকর্ষণীয়। সেই সব পাট চুকিয়ে গাড়িতে উঠে রওনা দিতে দিতে দুপুর গড়াল।

আজ লাঞ্চ টিয়াবন রিসর্টে । বাতাবাড়ি যাওয়ার আগেই পড়ে টিয়াবন রিসর্ট, জাতীয় সড়কের ওপরেই।  রিসর্টের ভিতরেই রেস্তোরাঁ, যেখানে বাইরে থেকেও খেতে যাওয়া যায়। ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। মেনুতে পাক্কা বাঙালিয়ানা। রান্নাও একেবারে চেটেপুটে খাওয়ার মতো ভালো। প্রচুর ট্যুরিস্ট এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছে দেখলাম। লাঞ্চের পর ফেরা। খুবই ক্লান্ত ছিলাম, বলাই বাহুল্য। খানিকটা আলস্যে কাটিয়ে ঘরের বাইরে আসি। আজ দেখছি রিসর্ট একেবারে ভর্তি। লোকজন ঘোরাফেরা করছে। ডাইনিং-এর জায়গাটিও খালি নেই। অতএব ঘরের লাগোয়া বারান্দায় বসে চা পান। সূর্য অস্তে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি এখান থেকেই। সূর্য গেলেন। চাঁদ উঠলেন। আমাদের নাগরিক মন এসব দৃশ্য দেখার সুযোগ সচরাচর পায় না। পাখিরা ব্যস্ত ঘরে ফেরায়। প্রকৃতির এইসব অনুষঙ্গ প্রাণ ভরে টেনে নিই বুকে। সন্ধ্যাটা এলোমেলো আড্ডায় কাটলো। কাল ভোরে জঙ্গল সাফারি। ডিনারের শেষে তাই দ্রুত ঘুমের দেশে ।

Img 4 1652596125501
মায়াময় ডুয়ার্স ঘিরে 19

উত্তরবঙ্গে এসে লোকজন নাকি রাস্তাঘাটে হাতি, লেপার্ড এসব দেখতে পায়। আমার ভাগ্যে তেমনটা কখনও ঘটেনি। দেখা যাক জঙ্গলে তেনারা দর্শন দেন কিনা। গরুমারা খুব কাছে, যেতে খুব একটা সময় লাগার কথা নয়। তবু, প্রায় রাতভোরে উঠে, তৈরি হয়ে রওনা দিলাম । কারণ সকাল সকালই নাকি দেখা মেলে জীবজন্তুদের। জঙ্গল সাফারির নিয়মকানুন সংক্রান্ত বিষয়গুলি রিসর্ট থেকেই করে দেওয়া হয়েছে। জঙ্গলের প্রবেশপথে গিয়ে গাড়ি বদলের নিয়ম। গাড়িতে আমাদের সঙ্গে একজন বনকর্মীও উঠলেন। দুঃখের বিষয়, যাদের জন্য এত ঘটাপটা, সেই জীবজন্তুরা দর্শনে অধরাই রইলো। বিশাল অঞ্চল জুড়ে আমাদের গাড়ি কয়েকবার চক্কর কাটার পর একখানি ময়ূর ছাড়া ভাগ্যে আর কিছুই দেখা জুটলো না। যদিও একেবারে কিছুই না বললে অন্যায় হবে। আমার তো গাছপালা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। এখানে প্রকৃতি অকৃপণ বিলাসে সাজিয়েছে তাদের। কত রকমের যে গাছ ! জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে সেই সব গাছেদের সঙ্গে স্বল্পায়ু সখ্যতা করে রিসর্টে ফিরি।

ব্রেকফাস্টে অতীব সুস্বাদু আলুর পরোটা খেয়ে কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যেই আড্ডা। এমন হালকা আলস্যেই দিনটা শেষ হয়। সন্ধ্যায় ডাইনিং স্পেসে বসে কফি আর পকোড়া সহযোগে আড্ডা। অন্যান্য ঘরের দু-একজন অতিথিও যোগ দেন সেখানে। রিসর্টের পরিষেবায় সবাই বেশ খুশি দেখলাম। বিশেষত, রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। স্বাভাবিক ! ভোজনরসিক বাঙালি সকলেই। চরাচর গভীর অন্ধকারে ঢেকে রাত নামে। পূর্ণিমার পরের দিন থেকেই চাঁদের ঔজ্জ্বল্য কমতে থাকে। কিছুটা ম্লান সেই আলোর ছটায় বেজে ওঠে বিদায়ের সুর। অনুভবে সেই সুর নিয়েই প্রহর গুনি। পরের দিন আমাদের ফেরার পালা ।

প্যাকিং প্রায় শেষ। একটু আগে লাঞ্চ করেছি। গাড়ি রেডি। ভালো লাগা মুহূর্তগুলি স্মৃতিতে নিয়ে রওনা দিই ঘরের পথে । জাতীয় সড়ক ধরে জঙ্গল দুপাশে রেখে চললো গাড়ি। প্রথমে এয়ারপোর্ট।সেখান থেকে কলকাতা। প্রসঙ্গত, কিছু তথ্য। ডুয়ার্স যে কোনও সময়েই আসা যায়। তবে, জঙ্গলের ভিতরে যেতে হলে বর্ষাকাল বাদ দিয়ে আসতে হবে। এমনিতে যখন খুশি আসা যায়। প্রকৃতি এখানে বৈচিত্রে, বৈভবে অসীম। ৩/৪ দিন সময় নিয়ে এলে বেশ কয়েকটি স্পট ঘুরে দেখতে পারবেন। কলকাতা বা যে কোনও বড় শহর থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন, বিমানে বাগডোগড়া বা বাসে শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতে হবে প্রথমে। তারপর গাড়িতে করে গন্তব্যে যাওয়া। খরচ আয়ত্তের মধ্যেই। থাকার জন্য প্রচুর হোটেল, রিসর্ট, গেস্ট হাউস, হোমস্টে আছে। তবে, আগাম বুকিং করে যাওয়াই ভালো। থাকার জায়গাগুলো মূলত জাতীয় সড়ক কেন্দ্রীক। রাস্তা ভালো। তাই সব বয়সের মানুষই যেতে পারেন। পা বাড়ালেই জঙ্গল। একটু দূরে গেলে নদী, পাহাড়, চা বাগান। সব মিলিয়ে অনির্বচনীয় ডুয়ার্স।

দুয়ারসিনি রিসর্টে মোট ৮টি নন এসি ডাবল বেড রুম আছে। এসির প্রয়োজন অবশ্য পড়ে না এখানে। দুরকম প্যাকেজ রয়েছে। একটা হলো, থাকা-খাওয়া ১২০০, দিন প্রতি-জন প্রতি। আরেকটি, শুধু থাকার জন্য রুম, ২ জন প্রাপ্তবয়স্ক ও ১০ বছরের নিচে বাচ্চার জন্য দৈনিক ১৩২০ টাকা। এক্ষেত্রে খাওয়ার খরচ ৫০০ টাকা দিন প্রতি, জন প্রতি। বাড়তি লোকের থাকার জন্য দিন প্রতি জন প্রতি ৩৫০ টাকা। সব ক্ষেত্রেই পাবেন বেড টি, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, সান্ধ্য স্ন্যাকস, ডিনার ও সকাল-সন্ধ্যা চা। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন, বাগডোগড়া এয়ারপোর্ট, শিলিগুড়ি তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড, ময়নাগুড়ি–সব জায়গাতেই পিক আপ ও ড্রপ রয়েছে। এছাড়া সাইট সিয়িংয়ের ব্যবস্থাও আছে।

★★ যখনই বেড়াতে যাবেন (নিয়মিত বিভাগ)

🌈 প্যাকিং ফান্ডা

🔺কি কি নিয়ে যাবেন তার একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলুন চটপট। এটা বেশ কয়েকদিন আগেই করুন। এতে জরুরি ও প্রয়োজনীয় জিনিস ভুলে যাওয়ার ভয় থাকবে না।

🔺ব্যক্তিগত জরুরি জিনিস, টাকাপয়সা, ট্রেন বা ফ্লাইটের টিকিট, হোটেলের বুকিং স্লিপ ইত্যাদি এমন জায়গায় রাখুন যা হাতের কাছে থাকবে অথচ বিশেষ যত্ন-খেয়ালও রাখা যাবে। ক্যামেরা, ল্যাপটপ ব্যাগের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য।

🔺 ফার্স্ট এড বক্স, সাধারণ জরুরি ওষুধ এবং আপনি নিয়মিত যে ওষুধ খান তা যথাযথ পরিমানে সঙ্গে রাখুন।

🔺 টর্চ-মোম-দেশলাই অবশ্যই রাখতে হবে।

🔺সানগ্লাস, ছাতা ও বর্ষাতি রাখতে পারলে ভালো।

🔺ভাঁজ নয় জামাকাপড় ফোল্ড করে প্যাক করলে কম জায়গায় বেশি পোশাক আঁটবে। আর জামাকাপড়ের ভাঁজও নষ্ট হবে না।

🔺জামাকাপড়-জুতো ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিন কোথায় যাচ্ছেন, সেই অনুসারে। যেমন, পাহাড়-জঙ্গল-সি বিচ যেখানে, সেখানে হিলতোলা  জুতো নয়, স্পোর্টস শু জাতীয় হলে ভালো। আর পোশাকও প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়। প্রসাধনী ও রূপচর্চার উপকরণও যেটা না হলে নয়, ততটুকুই। মনে রাখুন, বোঝা বাড়ালে পথে চলাফেরায় কষ্ট। শীতের জায়গায় যথেষ্ট শীতপোশাক রাখুন সঙ্গে।

 🔺গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলে সঙ্গে রাখুন কিছু শুকনো খাবার, টি ব্যাগ, কফি পাউডার, গরমজল করার ইলেকট্রিক কেটলি, কাগজের কাপ ও প্লেট, টিস্যু পেপার।

Img 60 1638186625131
মায়াময় ডুয়ার্স ঘিরে 24

🌈 যাওয়ার আগে কি কি করবেন

◾যথাসম্ভব জায়গাটা সম্পর্কে আগাম খোঁজখবর নিয়ে নিন। স্পটে গিয়ে কি কি দেখবেন, কিভাবে সময় কাটাবেন, তার একটা ধারণা থাকলে সুবিধা হবে আপনার। বাজেট করা ও প্যাকিংয়ের ক্ষেত্রেও এটা জরুরি।

◾জেনে নিন, কাছাকাছি এটিএম, প্রয়োজনে ডাক্তারের ব্যবস্থা আছে কিনা। না থাকলে সেই অনুসারে আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

◾চেষ্টা করবেন থাকা-খাওয়া-যাতায়াত-সাইট সিয়িং-শপিং ইত্যাদি খরচাপাতির জন্য একটা নির্দিষ্ট বাজেট করে নেওয়ার।

◾বেড়াতে গিয়ে যাতে অসুস্থ না হয়ে পড়েন, তার জন্য আগে থাকতেই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।

🌈 আগাম বুকিং এবং

এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত দিক। যাঁরা হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়েন, দল বেঁধে বা একা এবং বুকিংয়ের তোয়াক্কা করেন না, তাঁদের জন্য এই বিভাগ নয়। যাঁরা কিছুটা নির্ঝঞ্ঝাট বেড়ানো পছন্দ করেন, পরিবার পরিজন নিয়ে ভ্রমণ করেন, তাঁরা সচরাচর এডভান্স বুকিং না করে যান না। আমি নিজেও সেভাবেই সারা জীবন ঘুরেছি। এই বুকিংয়ের ক্ষেত্রে অনেকসময়ই এজেন্ট, পাহাড়ের ক্ষেত্রে হোমস্টে মালিক এবং সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে পর্যটকদের নানা বিষয়ে অশান্তির কথা শোনা যায়। এক্ষেত্রে যে সাবধানতা গুলি অবলম্বন করা যেতে পারে—

■ এজেন্ট সম্পর্কে ভালো করে আগে খোঁজ নিন

■পাহাড়ের হোমস্টে মালিকরা এমনিতে সৎ। কিন্তু ততটা পেশাদার এখনও নয়। কথাবার্তা, আদানপ্রদানের ক্ষেত্রেও ওদের কিছুটা সমস্যা আছে। ওদের ক্ষেত্রে বার বার জিজ্ঞেস করে, ভাষার কোনও সমস্যা থাকলে, সেটা কাটিয়ে উঠে, নিজের চাহিদা পূরণের ব্যাপারটা আগে থেকে বুঝে নিন।

■ কোনও কারণে বেড়াতে যাওয়া ক্যান্সেল হলে এডভান্স বুকিংয়ের টাকা ফেরত দেওয়া হয় না, এটাই নিয়ম। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আপনার টাকা গচ্ছিত থাকবে ওই এজেন্ট, হোমস্টে মালিকের কাছে এডভান্স হিসেবেই। সেই সময়ের মধ্যে আপনি যেতে পারবেন সেখানে। এই বিষয়টিও বুকিংয়ের সময় পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।

Img 20211013 Wa0063
মায়াময় ডুয়ার্স ঘিরে 25

🌈 কি করবেন

◾মানিয়ে চলার চেষ্টা করুন। যেখানে গেছেন, সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে যত বেশি মানিয়ে চলবেন, তত মজা-খুশি-আনন্দ অনন্য প্রাপ্তি হয়ে ধরা দেবে আপনার অভিজ্ঞতায়।

◾যথাসম্ভব পায়ে হেঁটে ঘুরুন। এতে জায়গাটির সত্যিকারের এসেন্সটা পাবেন।

◾জেনে নিন এলাকার মানুষের জীবন, তাদের শিল্প-সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও ইতিহাস।

🌈 কি করবেন না

◾যত্রতত্র প্লাস্টিক, আবর্জনা ইত্যাদি ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না।

◾লক্ষ্য রাখুন আপনার আনন্দ-উল্লাস যেন অপরের বিরক্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।