কেমন আছো কাশ্মীর?
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। নিবিড়, নান্দনিক নিসর্গের কাশ্মীর বরাবর পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রে। ভূস্বর্গ কাশ্মীর নিয়ে আমাদের যত অহংকার, তত যন্ত্রনা। স্বাধীনতার পর কেটে গেল এতগুলি বছর, বদলালো না কাশ্মীরের ভাগ্য। সুন্দর প্রকৃতির মাঝে কেমন আছেন এখানকার মানুষ ? তাঁদের যাপনও কী এমন সুন্দর ? পড়ুন ছন্দা চট্টোপাধ্যায়ের কলমে। ধারাবাহিক রচনার প্রথম পর্ব আজ।
যাত্রা শুরু শ্রীনগরে
ছোটবেলায় পড়েছি কাশ্মীরের অপর নাম ভুস্বর্গ। একটু বয়স বাড়ার পর স্বাভাবিক নিয়মেই স্বর্গ-নরকের ব্যাপারে কিছু জ্ঞান অর্জন হলো ! বরফের মুকুট-পরা শুভ্র পাহাড়-নদী-ঝর্ণা দিয়ে ঘেরা ‘স্বর্গ’ হলো দেবতাদের বাসভূমি ! স্বর্গের অপরূপ সৌন্দর্যের নাকি তুলনা নেই ! পুরান মতে মৃত্যুর পরে কিছু কিছু মানুষ স্বর্গবাসের অধিকার অর্জন করে! তারজন্য পৃথিবীতে থাকার সময় পুণ্য অর্জন করতে হয় ! যাই হোক নানা কারণে ‘ভূস্বর্গ কাশ্মীর’ সম্পর্কে মনের মধ্যে অদম্য কৌতূহল জেগেছিল ! বড়ো হবার পরে যখন বেড়াতে যাবার যোগ্যতা অর্জন করলাম, তখন বহু জায়গা ঘোরার সুযোগ হলেও, মনের কোণে ভুস্বর্গ কাশ্মীর দর্শনের ইচ্ছা হয়েই রয়েই গেল। অবশেষে সেই ইচ্ছা পূরণের দিনটাও এসে গেল একদিন।
ভারতবর্ষে কাশ্মীরের অবস্থান এমন এক জায়গায়, যেখানে চীন আর পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তের লড়াই-ঝগড়া লাগাতার চলতেই থাকে। তাছাড়াও যখন-তখন জঙ্গী হামলার আশঙ্কা। তারজন্য পর্যটক নিরাপত্তার ব্যাপারটা সবসময়ই প্রশ্নের মুখে। কার্গিল যুদ্ধের পরে বেশ কিছুদিন কাশ্মীর ভ্রমণের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। তখনই আমরা পরিবারের কয়েকজন মিলে কাশ্মীর ভ্রমণের পরিকল্পনা করি। শ্রীনগর এয়ারপোর্টে প্লেন নামার কিছুক্ষণ আগে থেকেই প্লেনের জানলা দিয়ে যে অপূর্ব দৃশ্য দেখলাম, তাতেই বুঝতে পারলাম, কেন ভূস্বর্গের খেতাব পেয়েছে কাশ্মীর !
প্লেন থেকে ফটো তোলা নিষিদ্ধ থাকায় আমরা ফটো তোলার চেষ্টা করিনি। তাছাড়া নিরাপত্তার কারণে মিলিটারির দায়িত্বে থাকা শ্রীনগরের শেখ-উল-আলম আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ বলেই প্রচুর নিষেধাজ্ঞা। আমরাও নিরাপত্তার কারণেই ‘জম্মু এন্ড কাশ্মীর ট্যুরিজম’-এর টুরিস্ট লজ ‘হোটেল হিমল’ বুক করেছিলাম। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য–সুফী সন্ত শেখ-উল-আলম কাশ্মীরের একজন প্রখ্যাত কবি ও ওই অঞ্চলে সুফিজিম-এর প্রবক্তা। এয়ারপোর্ট থেকে লাগেজ সংগ্রহ করে বেরিয়ে টুরিস্ট লজের পাঠানো গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি এয়ারপোর্ট ছেড়ে শহরের রাস্তা ধরলো।
পাহাড় পরিবেষ্টিত শ্রীনগর চমৎকার শহর। রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ভালো। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছিলো বিভিন্ন জায়গায় রাইফেল হাতে মিলিটারি সেনা এটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিলম নদীর দুপারে গড়ে উঠেছে তৎকালীন জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগরের জনবসতি। ঝিলম পেরিয়ে কিছুদুর এগোতেই চোখে পড়লো বিশাল নয়নাভিরাম এক লেক। ড্রাইভার বলল, ইয়ে হামারা ডাল লেক মাডামজি। আপলোগ ইসকে পাসই রহেঙ্গে। বহুত সুন্দর লোকেশন হ্যাঁয় টুরিস্ট লজ কা। আমরা অবশ্য লোকেশন না জেনেই বুক করেছি।
কথা বলতে বলতেই পৌঁছে গেলাম লজে। ডাল লেকের ওপরেই লজ। কড়া সিকিউরিটি। লজ বুকিং-এর কাগজপত্র দেখিয়ে প্রবেশের অধিকার পেলাম। কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। ডাল লেক আর লজের মাঝখানে শুধু পিচরাস্তার ব্যবধান। রুম লাগোয়া বারান্দা থেকে ডাললেকের অপরূপ দৃশ্য ভয়ার্ত মনকে খুশিতে ভরিয়ে দিল। এ অভিজ্ঞতা ২০১০ সালে প্রথমবার কাশ্মীর ভ্রমণের। এরপরে বারবার ছুটে গেছি কাশ্মীরের অমোঘ আকর্ষণে। এমনও ঘটেছে আমরা ফেরার জন্য রওনা হয়েছি, তখনি খবর পেলাম, অনির্দিষ্টকালের জন্য শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে। অবাক ব্যাপার হলো, ড্রাইভারের কোনও রকম হেলদোল দেখিনি। ওরা এতেই এমন অভ্যস্থ হয়ে গেছে, ওদের কিচ্ছু যায় আসেনা। আমাদের এয়ারপোর্টে নামানোর আগে হয়তো জিজ্ঞেস করেছি, কারফিউ ডিক্লেয়ার হো গয়া। আপ ক্যায়সে ঘর জায়েঙ্গে ? ড্রাইভার নিরুত্তাপ গলায় মৃদুহেসে উত্তর দিয়েছে, ডোন্ট ওয়ারি মাডামজি, হাম ম্যানেজ কর লেঙ্গে। আয়সেই ছোটা সে বড়া হো গয়া হম।
লজে পৌঁছতে আমাদের প্রায় ছটা বেজে গেল। বাইরে তখনও বেশ চড়া রোদ। শ্রীনগরে সূর্যাস্ত-সূর্যোদয় দুটোই দেরিতে হয়–কলকাতার সঙ্গে প্রায় দেড় ঘন্টার তফাৎ। আমরা ঠিক করলাম ফ্রেশ হয়ে চা-টা খেয়ে সামনেটা কিছুক্ষণ ঘুরে আসবো। পিচ রাস্তা ক্রস করে ডাল লেক ঘিরে বাঁধানো ফুটপাথে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তায় লোক চলাচল বেশি নয়। মাঝে মাঝে হুসহাস করে গাড়ি-অটো-মোটর সাইকেল ইত্যাদি আসছে যাচ্ছে। এপ্রিলের গোড়াতেও বেশ ভালোই ঠান্ডা। ডাল লেকের জলো হাওয়া হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিল। বুঝলাম আরও গরম পোশাক পরে বেরোনো উচিত ছিল। দু -চারজন স্থানীয় বাসিন্দাকে দেখলাম–জোব্বা বা আলখাল্লা টাইপের পোশাক পরে আছে, দুইহাত পোশাকের ভেতরে পেটের কাছে রাখা। পরে জেনেছিলাম ওই পোশাকটার নাম–ফিরান। প্রচন্ড ঠান্ডা থেকে বাঁচতে ওরা ফিরান ব্যবহার করে। ফিরানের ভেতরে পেটের কাছে একটা পাত্রে আগুন রাখা থাকে। হাতদুটো সেইকারণে ঢুকিয়ে রাখে। সাড়ে সাতটায় সূর্যাস্ত হলো এবং ঠান্ডার কামড় আরো বেড়ে যাওয়ায় আমরা ঘরে ফিরে এলাম। ততক্ষণে আলোয় ঝলমল করে সেজে উঠেছে ডাল লেক। চিকচিক করছে লেকের ছোটো ছোটো ঢেউ।
ঘরে ফিরেই রুম হিটার চালু করতে হলো। ঘর থেকেই দেওয়াল জোড়া কাঁচের জানলা দিয়ে দেখলাম একদিকে আলোয় সাজানো হরি পর্বত, আরেকদিকে বিখ্যাত হজরতবাল মসজিদ। মনে পড়ে গেল, কিছুদিন আগেই জঙ্গিরা লুকিয়েছিল এই মসজিদে। ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের পর মিলিটারি সেনা দখলমুক্ত করেছিল হজরতবাল মসজিদ। ভাবছিলাম, অকৃপণ প্রকৃতি এমন নিপুণহাতে সাজিয়েছে এই উপত্যকা, যেদিকে তাকাই , অসামান্য সৌন্দর্যের ডালি, চোখ ফেরানো যায় না! অথচ ক্ষমতার লড়াই বারবার রক্তাক্ত করেছে এই উপত্যকা।
অবিভক্ত ভারতে কাশ্মীর উপত্যকায় ছিল স্বাধীন হিন্দু রাজত্ব। শুধু তাই নয়, কাশ্মীর ছিল হিন্দুধর্ম চৰ্চার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এরপরে সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয় কাশ্মীর পর্যন্ত। বৌদ্ধধর্ম প্রাধান্য লাভ করে। পরবর্তীকালে কুশান সাম্রাজ্য ক্ষমতা দখল করে এবং তখনও বৌদ্ধধর্মের প্রাধান্য অব্যাহত থাকে। এরপরে উদয় হয় কাকোদা বংশ–শৈবধর্ম প্রভাব বিস্তার করে কাশ্মীরে। তারপরে ক্ষমতা চলে যায় মুসলিমদের হাতে। সূচনা হয় শাহ মীর বংশের। ইসলাম ধর্মের প্রতিপত্তি শুরু হয় এরপর থেকেই। এরপরে দীর্ঘদিন মুসলিম শাসনে ছিল কাশ্মীর। শাহ মীর বংশের পরে ক্ষমতা চলে যায় মুঘলদের হাতে। দীর্ঘদিন মুঘলদের শাসনে থাকার পরে পাঞ্জাব কেশরী রঞ্জিত সিং কাশ্মীর উপত্যকা দখল করেন। আবার শুরু হয় হিন্দু রাজত্ব। এরপরে আসে ডোগরা বংশ। রাজা গুলাব সিংয়ের নেতৃত্বে হিন্দুরাজ্য কায়েম হয়। ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি করে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে থেকে যায় কাশ্মীর। শেষে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভ দেশভাগের শর্তে এবং এখান থেকেই এক জটিল সমস্যার শুরু। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কাশ্মীর আক্রমণ করে বসে পাকিস্তান। কাশ্মীরের শেষ রাজা হরি সিং ভারতের সাহায্য চাইলেন। ভারতীয় সেনার কাছে পরাজিত হয়ে পিছু হঠলো পাকিস্তান। কিন্তু পুরোপুরি হঠাতে না পারায় ‘পাক অধিকৃত কাশ্মীর’ আর ‘গিলগিট বালতিস্তান’ রয়ে গেল বিরাট সমস্যা হয়ে। ১৯৫২ সালে রাজতন্ত্র বাতিল হবার পর কাশ্মীর চলে আসে ভারতের অধীনে এবং জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এরপরে বহু জল বয়ে গেছে ঝিলমের বুক দিয়ে। হাজারো সমস্যায় জর্জরিত দরিদ্র উপত্যকা অসীম সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে চলেছে আজও। আশ্চর্য এটাই, এত ঘটনার পরেও প্রকৃতির উজ্জ্বল মুখছবি এখনও সমান উজ্জ্বল কাশ্মীরে ! (চলবে)
ছবি : লেখক