কেমন আছো কাশ্মীর?
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম।
নিবিড়, নান্দনিক নিসর্গের কাশ্মীর বরাবর পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রে। ভূস্বর্গ কাশ্মীর নিয়ে আমাদের যত অহংকার, তত যন্ত্রনা। স্বাধীনতার পর কেটে গেল এতগুলি বছর, বদলালো না কাশ্মীরের ভাগ্য। সুন্দর প্রকৃতির মাঝে কেমন আছেন এখানকার মানুষ ? তাঁদের যাপনও কী এমন সুন্দর ? পড়ছেন ছন্দা চট্টোপাধ্যায়ের কলমে। ধারাবাহিক রচনার চতুর্থ পর্ব আজ।
শিকারা ভ্রমণের অতুলনীয় অভিজ্ঞতা স্মৃতির ঝুলিতে পুরে গত রাতে ঘুমের দেশে গেছি। আজ গন্তব্য গুলমার্গ। গুলমার্গ শব্দের অর্থ–ফুলে ভরা মাঠ (meadow of flowers )। বসন্ত এবং গ্রীষ্মে নানান রঙের দেশি-বিদেশি ফুলে সেজে ওঠে গুলমার্গ। তবে, গুলমার্গ বিখ্যাত এশিয়ার অন্যতম সেরা স্কি-পয়েন্টের জন্য। এশিয়ার সপ্তম শ্রেষ্ঠ স্কি-পয়েন্ট গুলমার্গে। আর পৃথিবীর সর্বোচ্চ গল্ফ-কোর্সও গুলমার্গে। দুটো ক্ষেত্রেই অবদান অবশ্যই ব্রিটিশদের। ব্রিটিশ রাজত্বকালে জম্মু-কাশ্মীর স্বাধীন হলেও ব্রিটিশদের সঙ্গে সমঝোতা ছিল। তাদের অন্যতম গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের প্ৰিয় ঠিকানা ছিল গুলমার্গ।
ব্রিটিশদের উদ্যোগেই শীতকালীন খেলাধূলার সূচনা হয় গুলমার্গে। নিজেদের বিনোদনের স্বার্থেই ওরা গল্ফক্লাবও গঠন করেছিল। সর্বোচ্চ স্কি-পয়েন্ট এবং গল্ফ কোর্স পরবর্তীকালে ভারতীয় সেনাদের যুদ্ধের ট্রেনিং সেন্টার হয়। ভারত স্বাধীন হবার পরে যখন পাকিস্তানী সেনা কাশ্মীর আক্রমণ করে, প্রথমে ওরা গুলমার্গ দখল করে নেয়। পরে ভারতীয় সেনাবাহিলীর কাছে পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হঠে পাকিস্তানী সেনা, দখলমুক্ত হয় গুলমার্গ। প্রসঙ্গত, LOC (লাইন অফ কন্ট্রোল) মাত্র এগারো কিমি দূরে গুলমার্গ থেকে। গুলমার্গ বারামুলা জেলার পাহাড়ী জনপদ। বারামুলা বেশ পরিচিত নাম। কারণ এখনও মাঝে-মাঝেই বারামুলা হেডলাইন হয়ে যায় জঙ্গি-উপদ্রুত এলাকা হিসেবে।
শ্রীনগর থেকে গুলমার্গের দূরত্ব ৪৯ কিমি। গাড়িতে সময় লাগে প্রায় দু ঘন্টা। কিন্তু উচ্চতায় অনেকটা বেশি গুলমার্গ। শ্রীনগরের উচ্চতা ১৫৮৫ মি.–গুলমার্গের উচ্চতা ২৫৬০ মি.। জানা যায় গুলমার্গের একসময়ে নাম ছিল গৌরীমার্গ। মুসলিম শাসন কালে সুলতান ইউসুফ শাহ চাক গৌরীমার্গের নাম বদল করে গুলমার্গ রাখেন। মেহরাজ যথাসময়ে হোটেলে পৌঁছে আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। সে জানালো, এখনও কিছু বরফ আছে গুলমার্গে। ফুল নেই। সাতদিন দেরিতে এলে আর বরফ পাওয়া যেত না। তবে খিলেনমার্গে সবসময় বরফ পাওয়া যায়। ডাল লেকের পাশ দিয়ে কিছুদুর চলার পরে গাড়ি ঢুকে পড়লো শ্রীনগর শহরের পুরনো এলাকায়। গায়ে গায়ে লাগা ঘরবাড়ি, ঘিঞ্জি বাজার এসব পার করে গাড়ি ছুটে চলল শহর ছাড়িয়ে।
দুপাশে ঢেউ খেলানো হলুদ সর্ষের ক্ষেত। অদূরে পাইন,পপলারে ছাওয়া ছোট বড়ো পাহাড়, মাঝে মাঝে খেলনা বাড়ির মত সাজানো ছোটো ছোটো গ্রাম। দুর থেকে উঁকি দিচ্ছে বরফ ঢাকা রুপোলি পাহাড়ের চুড়া । ঘন্টাখানেক এভাবে চলার পরে শুরু হলো ওপরে ওঠা। মিনিট দশেক পরে মেহরাজ বললো, কাছেই ঠান্ডা হাওয়া আটকানোর জন্য ওভারকোট আর বরফে হাঁটার উপযোগী বুটজুতো পাওয়া যাবে ভাড়ায়। ওপরে অতিরিক্ত ঠান্ডা হাওয়ায় সমস্যা হতে পারে। সমস্যা হলো কতজনের ব্যবহার করা ওভারকোট ! কিন্তু শীতে কাবু হবার চেয়ে তো ভালো–একথা ভেবে আমরা ওভারকোট আর জুতো নেব, বলে দিলাম মেহরাজকে।
পরপর তিনটে দোকান। বেশ ভিড়। মাপের কোনো ব্যাপার নেই। কাস্টমারকে খপ করে ধরে নিয়ে গিয়ে বেঞ্চে বসাচ্ছে। তারপরে যত্ন করে ওভারকোট-জুতো পরিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। বুটের রং দেখে খুব হাসি পেয়ে গেল-লাল নীল হলুদ সবুজ বেগুনি বিচিত্র সব রঙ। আমরা ছবি তুলে রাখলাম। ফারের কোট পরে কিন্তূ বেশ আরামবোধ হলো। আঙুলগুলো ঠান্ডায় অবশ হয়ে যাচ্ছিল । সবাই গ্লাভস পরে নিলেও আমি গ্লাভস পরতে পারলাম না। কারণ গ্লাভস নিয়ে ক্যামেরা ধরা মুস্কিল। বাংলায় কথোপকথন চলছিল আমাদের। মেহরাজ কি বুঝলো কে জানে! গাড়ির ড্যাশবোর্ড খুলে দুটো হাতেবোনা উলের গ্লাভস বের করে এনে আমাকে দিয়ে বলল, এগুলো পরে নিন। আমি লক্ষ করলাম গ্লাভস দুটো বেশ মজার। আঙুলের ডগার জায়গাগুলো ফাঁকা। মেহরাজের স্টিয়ারিং ধরার সুবিধার জন্য সম্ভবত বানিয়েছে। ক্যামেরা ধরতেও কোনও অসুবিধা হলো না। জিজ্ঞেস করলাম, এত সুন্দর গ্লাভস কে বানিয়েছে ? যথারীতি মেহরাজের সংক্ষিপ্ত উত্তর, বাড়িতে বানিয়েছে।
আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। চড়াই ভেঙে ক্রমশ ওপরে উঠছে গাড়ি। কিছুদূর এগনোর পরে দেখা গেল রাস্তার পাশে পাশে জমে আছে শক্ত সাদা বরফ। এরপরে বরফও বাড়তে শুরু করল, সেইসঙ্গে ঠান্ডাও। বন্ধ গাড়ির ভেতরে বসেও ঠান্ডায় শরীর কাঁপছে। সময়ের হুঁশ নেই। দুপাশে নয়নাভিরাম দৃশ্য। মেহরাজের কথায় ঘোর কাটলো–ওই দেখুন কত বরফ! এটাই আমাদের গুলমার্গ । গাড়ি থামলো। ছোট্ট জনপদ। প্রচুর খাবারের স্টল, বাস, গাড়ি এবং মানুষের ভিড়। গাড়ি থেকে নামতেই হিমেল হাওয়ায় বুকে কাঁপন ধরে গেল। অনবরত মেঘ আর রোদের লুকোচুরি চলছে পাহাড়ে পাহাড়ে। ঝিরঝিরিয়ে এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেল। মিনিট কুড়ি হেঁটে আমরা গন্ডোলা স্টেশনে পৌঁছলাম। দুটো ফেজে গন্ডোলা রাইড হয়। প্রথম ফেজে ১০০০০ ফুট ওপরে কন্ডোরি, দ্বিতীয় ফেজে ১৩৪০০ ফুট ওপরে আফারহাট পিক পর্যন্ত।
উল্লেখযোগ্য, পৃথিবীর সর্বোচ্চ গন্ডোলা রাইডগুলোর অন্যতম গুলমার্গের গন্ডোলা। গন্ডোলার রক্ষণাবেক্ষণ বেশ উচ্চমানের। কারণটা পরে জেনেছি। ভারত-ফ্রান্সের যৌথ প্রোজেক্ট গুলমার্গের গন্ডোলা রোপ-ওয়ে। সেই কারণে, ভরসাও করা যায়। শুনলাম কন্ডোরি থেকে দেড় ঘন্টা হেঁটে বা পনিতে চেপে খিলেনমার্গ যাওয়া যাবে। রিপেয়ারের কাজ চলছে বলে সেকেন্ড ফেজের রাইড বন্ধ আছে। সেইজন্য ফার্স্ট ফেজে আমরা কন্ডোরি পর্যন্ত গিয়ে, ওখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরে এলাম। ওখানেও যথেষ্ট বরফ ছিল। অনেকেই স্কি করছে। স্লেজ গাড়িও চলছে। বরফে যাতে স্কিড না করে, সেটা সামলানোর লোক আছে। আমাদের কোনওরকম এডভেঞ্চারের আগ্রহ না থাকায় আমরা মনোমত জায়গা দেখে বসলাম। (চলবে)
ছবি : লেখক