কোহিনূরের রোমাঞ্চকর যাত্রাপথ ‘সিক্রেটস অফ কোহিনূর’
হাতে হাতে স্মার্টফোন। তরুণ প্রজন্মের চোখ ইদানীং নিত্যনতুন ওয়েব সিরিজে। সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সেইসব সিরিজ নিয়েই নানাকথা এই বিভাগে। আজ তথ্যচিত্র ‘সিক্রেটস অফ কোহিনূর’ নিয়ে লিখেছেন সোমনাথ লাহা।
‘কোহ-ই-নূর’ বা ‘কোহিনূর’ নামটি শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। আজও অমূল্য জিনিসকে কোহিনূর হিরার সঙ্গে তুলনা করা হয়। ১০৫.৬ ক্যারেটের এই হিরার ইতিহাস কিন্তু বহু আগের। নানা ঘটনা জড়িত রয়েছে এর সঙ্গে। লর্ড ডালহৌসি ১৮৫০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে মহারানী ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেন হিরাটি। সেই থেকে কোহিনূর শোভা পাচ্ছে রানীর মুকুটে। টাওয়ার অফ লন্ডনে দেখানোর জন্য মুকুটটি রয়েছে। ১৯৩৭-এ আরও ২৮০০টি হিরার সঙ্গে কোহিনূর ব্রিটিশ রাজমুকুটে যুক্ত করা হয়। বর্তমানে লন্ডন টাওয়ারে জনসাধারণের সামনে প্রদর্শনীর জন্য অন্যান্য বিখ্যাত হিরা ও রত্ন-পাথরের সঙ্গে কোহিনূর রাখা আছে।
এহেন কোহিনূরের অজানা কাহিনিকেই তথ্যচিত্রের আকারে মেলে ধরেছেন প্রযোজক-পরিচালক নীরজ পান্ডে, তাঁর নির্মিত তথ্যচিত্র ‘সিক্রেটস অফ কোহিনূর’-এর মধ্যে দিয়ে। দুটি পর্বে (এক একটির সময়সীমা ৪৫ মিনিট) তৈরি এই তথ্যচিত্রে কথকের ভূমিকায় রয়েছেন বলিউডের সেরা অভিনেতাদের অন্যতম মনোজ বাজপেয়ী। ডিসকভারি প্লাস অরিজিনালে স্ট্রিমিং হয়েছে এই তথ্যচিত্র। এখানে পুরো বিষয়টিকে খুবই আকর্ষণীয় এবং এন্টারটেনিং ভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ইতিপূর্বে নীরজ ও মনোজের যুগলবন্দি ‘সিক্রেটস অফ সিনৌলি’-র মতো তথ্যচিত্র দর্শকদের সামনে নিয়ে এসেছিল। যার রেটিংও বেশ ভালো ছিল। ‘সিক্রেটস অফ কোহিনূর’ তথ্যচিত্রটি পরিচালনা করছেন রাঘব মোহন জয়রথ। চিত্রনাট্য লিখেছেন বৈভব মুথা।
কোহিনূরের অজানা দিকগুলি তুলে ধরার জন্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। সেই তালিকায় রয়েছেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ফারহাত নাসরিন, ইরফান হাবিব এবং শশি থারুর। ‘সিক্রেটস অফ কোহিনূর’ নির্মাণের ক্ষেত্রে গবেষণার কাজটি অত্যন্ত যত্ন সহকারে করা হয়েছে। কোহিনূর পাওয়া গিয়েছিল গোলকোন্ডার কোল্লুর খনিতে খননের ফলে। সেখান থেকে কোহিনূরের যাত্রাপথ মেলে ধরা হয়েছে। কীভাবে, কার কার হাত বদল হয়েছে এই হিরা, তার একের পর এক পরত খুলেছে তথ্যচিত্রটি। মুঘলদের হাত থেকে হাত ঘুরতে ঘুরতে পারস্যের নাদির শাহ-র কাছে পৌঁছে যায় কোহিনূর। সেখান থেকে আফগান জেনারেল আহমেদ শাহ আবদালির হাতে। তারপর মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের হাতে পৌঁছায় কোহিনূর। এই চমকপ্রদ বিষয়টিকে ভিস্যুয়াল প্রেজেন্টেশন তথা অ্যানিমেশনের সাহায্য নিয়ে সুন্দর করে মেলে ধরা হয়েছে। সঙ্গত কারণেই ইতিহাসের সেই সময়কে তুলে ধরার জন্য পরিচালক অ্যানিমেশনের সাহায্য নিয়েছেন।
ভারতের মাটিতে রঞ্জিত সিংয়ের পুত্র পাঁচ বছর বয়সী যুবরাজ দিলীপ সিংয়ের হাতে ১৮৪৩ পর্যন্ত ছিল কোহিনূর। তখনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ঝামেলাটা শুরু হয়নি। তারপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তাদের দখল বাড়ায়, সেটা ১৮৪৯ সাল, পাঞ্জাবে তখন কোম্পানির শাসন অধিষ্ঠিত হলো। কোম্পানির সঙ্গে ঝামেলা বাঁধলো দিলীপ সিংয়ের। সেই সময়, ১১ বছর বয়সী দিলীপ সিংকে লাহোরের শেষ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয় এবং হস্তান্তরের শর্ত স্বরূপ তিনি কোহিনূর কোম্পানিকে দিতে বাধ্য হন। সেখান থেকে, কোহিনূর তার নিজস্ব পথ তৈরি করেছিল। কোহিনূরের ওজনে পরিবর্তনের পাশাপাশি আর একটি বিষয়ও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। ভারতের মাটিতে এই হিরা আর কখনও পৌঁছায়নি।
তথ্যচিত্রটিকে এতটাই আকর্ষণীয় ভাবে মেলে ধরেছেন নির্মাতারা, তাতে সকল শ্রেণীর দর্শকদের কাছে এটি সমানভাবে মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে। ক্ল্যাসিক্যাল ডকুমেন্টারি ফরম্যাট ভেঙে বেরিয়ে এসে সিনেম্যাটিক অ্যাপ্রোচে এইভাবে তথ্যচিত্র নির্মাণ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। কোহিনূরের জার্নির পাশাপাশি সেই সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন এবং এই মহামূল্যবান হিরার ওজন কেন কমে যাচ্ছে (প্রথমে হিরাটি ৭৯৩ ক্যারেটের ছিল, বর্তমানে ১০৫.৬ ক্যারেটে নেমে এসেছে), সেটিও খুব সুন্দরভাবে মেলে ধরা হয়েছে। এমনকী সেই সময় শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই খনি থেকে হিরা বের করার প্রচলন যে ছিল, এই তথ্যচিত্রে সেই বিষয়টিরও উল্লেখ রয়েছে।
তথ্যচিত্র মানেই শুধুমাত্র তথ্যে ঠাসা বিষয় নয়। বরং সেটিও যে হয়ে উঠতে পারে বিনোদনের বিষয়বস্তু, ‘সিক্রেটস অফ কোহিনূর’ তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ও ইন্টারনেটের ভাল দিকগুলো নিয়ে খুব কম কথা বলা হয়ে থাকে। দর্শকরা যদি এ ধরণের তথ্যচিত্র দেখার প্রতি আগ্রহ বাড়ান, তাহলে, ওটিটি এবং ইন্টারনেটের পরিভাষাও আগামী দিনে পরিবর্তিত হবে। নিঃসন্দেহে পুরো কাজটিতে অনন্য মাত্রা যোগ করেছেন মনোজ বাজপেয়ী। তাঁর চমৎকার উপস্থাপন ভঙ্গি ও কন্ঠস্বর ‘সিক্রেটস অফ কোহিনূর’-কে দর্শকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার পাশাপাশি এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে।