Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

স্বেচ্ছামৃত্যুকে আলিঙ্গন

চলে গেলেন ফরাসি সিনেমার শেষ পাণ্ডব

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। আন্তর্জাতিক খ্যাত কিংবদন্তি সিনেমা ব্যক্তিত্ব প্রয়াত জঁ লুক গোদারকে নিয়ে লিখেছেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সাংবাদিক নির্মল ধর

প্রথম জন অর্থাৎ যুধিষ্ঠির ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো চিরঘুমের দেশে চলে গিয়েছিলেন ১৯৮৪-তে। যাঁর হাত ধরে এই তৃতীয় পাণ্ডব জঁ লুক গোদারের সিনেমায় আগমন! ত্রুফোর গল্প নিয়েই গোদারের প্রথম ফিচার ‘ব্রেথলেস’ ছয়ের দশকের ফরাসি সিনেমার এক মহীরুহ ! দু’বছর আগেই আমেরিকার আগাপাশতলা ঘুরে এসেছেন গোদার। আর তারপরেই আমেরিকান এক সুইন্ডলারকে (বেলমন্দ) নিয়ে হলিউডি সিনেমার পিছনে লাথি !! সিনেমার ব্যাকরণ ভাঙার শুরু সেই প্রথম চেষ্টা থেকেই। তাও শোনা যায়, ওই ছবির জন্য তিনি ক্যাহিয়ে ড্যু সিনেমা পত্রিকার ক্যাশবক্স ভেঙে টাকা নিয়েছিলেন। আবার এই পত্রিকাটিতেও তখনকার বাজারি ফরাসি সিনেমার মুন্ডুপাত করতো এই পঞ্চপাণ্ডব।

00Godard Toppix Mobilemasterat3X
স্বেচ্ছামৃত্যুকে আলিঙ্গন 6

দ্বিতীয় ও তৃতীয়জন অর্থাৎ এরিখ রোহমার ও ক্লদ শ্যব্রল চলে গেলেন না ফেরার দেশে একই বছর, ২০১০-এ। বাকি ছিলেন গোদার। একানব্বই ছুঁয়ে তিনিও স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন গত ১৩ সেপ্টেম্বর লেক জেনেভার পারে সুইস শহর রোলির বাড়িতে। তখন তাঁকে ঘিরে রয়েছেন তৃতীয় স্ত্রী ও অভিনেত্রী অ্যান মেরি মিভিলে এবং ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয়স্বজন। ডাক্তার একদিন আগেই মৃত্যুর পরোয়ানা শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন (সুইজারল্যান্ডে ইছামৃত্যু সরকার স্বীকৃত) ! তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের মতোই গোদার ছিলেন অকুতোভয়, সাহসী, বিদ্রোহী, প্রচন্ড জেদী এবং পরম্পরা ভাঙায় অগ্রণী !! ফরাসি সিনেমাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক মানচিত্রে ঠাঁই দিতে গোদারের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়েছিলেন বাকি চারজনও। না, তাঁর সিনেমা কখনও কোনও গল্প বলেনি। তিনি নিজে বলতেন “গল্পের আদি, মধ্য ও অন্ত থাকবে। কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট ধারায় বা ক্রমানুসরে নয়। সেটা ঠিক করবো আমি।”

Images 2 2
স্বেচ্ছামৃত্যুকে আলিঙ্গন 7

প্রথম ছবি ‘ব্রেথলেস’ থেকে শেষ ছবি ‘ইমেজ বুক’ পর্যন্ত সেই ব্যাকরণ ভাঙার ধারাটি গোদার বজায় রেখেছেন। তাঁর ছবি অধিকাংশ দর্শকের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকেছে। কেউ বলেছেন সুপার ইন্টেলেকচুয়াল, কেউ বা ভেবেছেন সুপার শিক্ষিতের আত্মরমন! কিন্তু তাঁর ছবিকে ফেলে দিতে পারেননি কেউই ! ‘লা মেপ্রিস’ থেকে ‘আলফাভিল’, ‘লা চিনোয়েজ’ থেকে ‘সোস্যালিজম’–সব ছবিই বিতর্কের ভান্ডার। শুরুতে অনেকেই মনে করতেন গোদার কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন। আবার বিশ শতকে এসে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভয়ঙ্কর কমিউনিস্ট বিরোধী। যে মানুষটি ১৯৬৮ সালের ফরাসি ছাত্র আন্দোলনের শরিক হয়ে কান ফিল্ম উৎসবের প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে সিনেমার পর্দা ছিঁড়ে বিক্ষোভ দেখান, সেই তিনিই ২০১৪-য় কান উৎসবের মঞ্চে উঠে পুরস্কার গ্রহণ করেন!

আবার এই মানুষটাকেই যখন অস্কার কমিটি ২০১০ সালে সাম্মানিক অস্কার দেবার জন্য ডেকে পাঠান, তাঁর সটান উত্তর ছিল “অস্কার তো একটা ধাতুর মূর্তি। ওটা দিয়ে আমি কী করবো ! তাছাড়া অস্কারের লোকজন আমার ক’টা ছবি দেখেছে শুনি!” অর্থাৎ তিনি যাননি অনুষ্ঠানে! সেই অনুষ্ঠানেই সাম্মানিক অস্কার নিয়েছেন ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা, এলি ওয়ালাচ ও  সিনেমা গবেষক কেভিন বার্ন! আজীবন আমেরিকান ব্যবসায়িক ছবির ঘোর বিরোধী ছিলেন গোদার কিন্তু কোয়ানটিন তারান্টিন থেকে ব্রায়ান দি পালমা ছিলেন যাকে বলে গোদারের মন্ত্রশিষ্য!

Images 2 3
স্বেচ্ছামৃত্যুকে আলিঙ্গন 8

১৯৩০ সালের ৩ ডিসেম্বর প্যারিসে জন্ম গোদারের। নিয়ন শহরে তাঁর ছাত্রজীবন। কলেজ জীবন সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এথনোলজি নিয়ে পড়াশুনো করলেও তাঁর ঝোঁক ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতির দিকেই। তবে, বাঁধাধরা ভাবনায় তিনি কখনওই বিশ্বাসী ছিলেন না। সাহিত্যিক কবি জ্যাক রিভেট ও এরিখ রোহমারের সঙ্গে সহকারী হয়ে কাজ করার সময় থেকেই তিনি সার্ত্র এবং দালির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ভিতরে ভিতরে জন্ম নিতে থাকে এক বিদ্রোহী শিল্পীর, যিনি চলতি সিনেমার সংজ্ঞা ভেঙ্গে নতুন কিছু গড়তে চান। গোদার অবশ্যই সেটা করে দেখিয়েছেন! তাঁর ছবি ব্যবসায়িক সফল না অসফল, তার চাইতে বড় কথা ছবিটা তর্ক সৃষ্টি করেছে কিনা ! তিনি সব সময়েই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু! তাঁর ছবির কথাই ধরা যাক, ‘এ ম্যান অ্যান্ড ওম্যান’ হোক, বা ‘সোস্যালিজম’–আলোচনা, বিতর্ক তুঙ্গে!

তাঁর যৌবন বয়সের জীবনটাও ছিল ছবির মতোই রঙিন ও তর্কময়। নায়িকা ব্রিজিত বার্ডটের সঙ্গে কাজ করেছেন, প্রেমও। কিন্তু বিয়ে করেছেন অ্যানা কারিনাকে। আবার ‘লা চিনয়েস ‘ করার সময় অ্যানি উইজামস্কির প্রেমে পড়ে বিয়ে করেছেন তাঁকেও। তবে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তৃতীয় স্ত্রী অ্যান মারি ছিলেন সঙ্গী! শোনা যায়, তাঁকেই তিনি প্রথম স্বেচ্ছামৃত্যু সম্পর্কে জানান। প্রথমটায় চমকে গেলেও অ্যান বুঝতে পারছিলেন গোদার নিজের মৃত্যুটাও চান নিজের শর্তে, যা তিনি সারাটা জীবন সিনেমার ক্ষেত্রেও করে এসেছেন। দ্বিতীয়বার আর ভাবেননি অ্যান, স্বামীর ইচ্ছাপূরণের সঙ্গী হয়েছেন !

Images 2 4
স্বেচ্ছামৃত্যুকে আলিঙ্গন 9

তিনি বলতেন, “ফিল্ম ইজ আ ফিল্ম ফিল্ম ফিল্ম …” সাহিত্য নয়, কবিতা নয়, চিত্রশিল্প নয়, শুধুই ফিল্ম !” সেই ফিল্মের সাধনাতেই তিনি মগ্ন ছিলেন জীবনের সত্তরটি বছর। তবুও বলতেন “সিনেমা আর করতে পারলাম কোথায় ! ভালো ছবি করতে আমি অপারগ। কিছু দৃশ্য তৈরি করেছি মাত্র। সিনেমা তৈরি এখনও শিখছি!” এমন কথা বিশ্বের ক’জন পরিচালক বলতে পারেন !! আমাদের এখানকার পরিচালকরা দুটো বাণিজ্য সফল ছবি বানানোর পরই নিজেদের কী না কী ভাবতে শুরু করেন ! কী ভাগ্যি, গোদার তেমন ভাবতেই শেখেননি !! তাহলে আর তিনি পাণ্ডব ভাইদের তৃতীয় পাণ্ডব হবেন কি করে !!!

অবশেষে ফরাসি সিনেমার পঞ্চপাণ্ডবের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটলো! এবার কি তাহলে নতুন কোনও ‘মহাভারত’ লেখার ভূমিকা তৈরি হবে ফরাসি সিনেমায় ? হতেই পারে। কিন্তু জঁ লুক গোদারকে ছাড়িয়ে যাওয়া তো দূরের স্বপ্ন, তাঁর কাঁধের উচ্চতায় ওঠাও কি সম্ভব কারও পক্ষে ?! এই জিজ্ঞাসা দিয়েই এই প্রতিবেদন শেষ করলাম।