বিরলতম এক দম্পতির কাহিনি
জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে নিজেই সে নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।
গত বেশ কয়েকটি দিন আমদের রাজ্য জুড়ে চললো উৎসবের সমারোহ। সমারোহ আছে। আছে বর্ণাঢ্য আয়োজন। তবে, কতজন মানুষ সেই সমারোহে শামিল, প্রশ্ন সেখানেই। সর্বজনীন দুর্গোৎসব এখন কিছু ক্লাবের উদ্দাম উল্লাসের প্রক্রিয়ায় পরিণত। অন্য দিকে দেশ তথা রাজ্যের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি এমন, বহু মানুষ কর্মহীন। দারিদ্র্যসীমার নিচে যাঁরা, তাঁরা তো বটেই–মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনেও সংকটের কালো মেঘ। একদিকে এই নেতিবাচক পরিস্থিতি। অন্যদিকে আমরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি সামাজিক মূল্যবোধ, সহমর্মিতা, সহানুভূতির মতো মানবিক গুণগুলি। স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অথচ সাধারণ মানুষের সমস্যা, সংকট সব যুগেই ছিল। আর সব যুগেই ছিলেন এমন কিছু মানুষ, যাঁরা যাবতীয় নেতিবাচক অবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অসহায় মানুষের জন্য কাজ করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন এবং অনুপ্রাণিত করেছেন আমাদের। আজ দর্পণে তেমনই এক দম্পতির কথা।


১৯৪৬ সালে জন্ম মেদিনীপুরের মীরগোদা গ্রামে। আর প্রবল সংবেদনশীল মনটিরও জন্ম তখনই। অতি শৈশবেই শুরু অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পালা। কল্যাণব্রত নামকে আক্ষরিক অর্থে পরিণত করে মাত্র দশ বছর বয়সেই সমাজের জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছিল সেই বালক। আজ কল্যাণব্রত দাস নামের সেই বিরল মানুষটির গল্প। সঙ্গে থাকবেন কল্যাণব্রতর স্ত্রী শিবানী। আসলে ওঁদের কথা বলতে গেলে, দুজনের সম্পর্কেই জানাতে হবে। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই কল্যাণব্রতর কাজ ছিল–গ্রামের অন্ত্যজ ছেলেমেয়েদের জুটিয়ে পড়ানো, পিটি করানো, কার বাড়িতে ভাত রান্না হচ্ছে না জেনে নিজেদের বাড়ি থেকে চাল চুরি করে নিয়ে গিয়ে বিলিয়ে দেওয়া ইত্যাদি।
১৯৭২ সালে মীরগোদা গ্রাম থেকে কলকাতায় আসেন কল্যাণব্রত। এসে ওঠেন নারকেলডাঙা মেন রোড নিকটস্থ এক হরিজন বস্তিতে। আসার পর সেখানকার দুই বয়স্ক সজ্জন ব্যাক্তি লালচাঁদ ও ফুলচাঁদ হরিজনের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। সে এক ঘোর অন্ধকার সময়। আর্থ সামাজিক অবনতির প্রভাব পড়েছে সমাজ ও জীবনের সব ক্ষেত্রে। স্বাভাবিক ভাবেই এই অঞ্চলটিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। অশিক্ষা ও অজ্ঞানতার অন্ধকার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল বস্তির মানুষজনের জীবন। শিক্ষা দেয় স্বাস্থ্য সচেতনতা। শিক্ষার সুযোগ নেই। ফলে, সেই সময় স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব প্রকট ছিল এখানে। ভেজে,পুড়িয়ে, খাদ্যগুণ নষ্ট করে, রান্না হতো। ঘরে ঘরে কলেরা। জ্বর হলে বাঁচতো খুব কম মানুষ। কারণ চিকিৎসা বলতে ঝাড়ফুঁক দ্বারা সুস্থ করার পদ্ধতি বা একেবারে কিছুই না করে ঘরে ফেলে রাখা।


বস্তির পরিস্থিতি বদলের লক্ষ্যে ময়দানে নামলেন কল্যাণব্রত। সঙ্গে তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী শিবানী। একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে শুরু হলো কাজ। বাচ্চাদের জন্য স্কুল, হোস্টেল। সেখানে এমন ব্যবস্থা, যেখানে গৃহ সহায়িকার কাজ করেন যে মায়েরা,তাঁদের সন্তানেরা থাকতে পারবে। সেই শিশুদের লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ-গান-আবৃত্তি শেখাবার বন্দোবস্তও করা হয়েছিল সেই স্কুলে। শুধু সেখানকার পরিবারের শিশুরা নয়, হারিয়ে গেছে এমন এবং অনাথ বাচ্চারাও স্থান পেত কল্যাণব্রতর স্কুলে। নিজে ছড়ায় সুর দিয়ে, গান বানিয়ে, স্কুলের বাচ্চাদের শেখাতেন। পাশাপাশি ছবি আঁকা, সেলাই ইত্যাদিও শেখানো হতো।
স্ত্রী শিবানী ছিলেন ছায়াসঙ্গিনী। সেকালের পক্ষে যথেষ্ট বৈপ্লবিক ছিল কল্যাণব্রতকে শিবানীর বিয়ে করার সিদ্ধান্ত। ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ে হয়ে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন কায়স্থ বাড়ির ছেলে কল্যাণব্রতকে। তীব্র অভাব-অনটন, অপ্রাপ্তি সব মেনে নিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে গেছেন স্বামীর সঙ্গে, একেবারে মাঠে-ময়দানে নেমে। শিবানী নিজে ব্রতচারী শিখেছিলেন। ব্রতচারীর আদর্শ বোধ বাচ্চাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে তাদেরও ট্রেনিং দিতেন। এছাড়াও ছিল, মনীষীদের জন্মদিন পালন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম প্রমুখ মনীষীকে নিয়ে আলাপ, আলোচনা, সভা হতো। এছাড়া অনুষ্ঠানও করিয়েছেন বাচ্চাদের নিয়ে।


দুজনেরই মূল ভাবনা ছিল, সচেতন ও অনুভবী মানুষ গড়া–যারা প্রকৃতি সচেতন ও মানবিক গুণসম্পন্ন হবে। ওঁরা ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। ওঁদের প্রেম ও দাম্পত্য সবটাই নিবেদিত ছিল সমাজের অসহায় মানুষের প্রতি। সমাজই ছিল তাঁদের বৃহত্তর সংসার। এমন নয় যে নিজেরা আর্থিকভাবে খুব স্বচ্ছল ছিলেন। সংসারে টানাটানি লেগেই থাকতো। তবু, ওঁরা কোনওদিন শুধু নিজের জন্য বাঁচেননি। ২০১৮-র জুন মাসে চলে যান শিবানী। বেশিদিন একা থাকেননি কল্যাণব্রত। তাঁর মৃত্যু হয় ২০১৯-এর ডিসেম্বর। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দুজনেই যত দূর পেরেছেন, কাজ করে গেছেন। আশপাশের মানুষ ঈশ্বর মানতেন ওঁদের। সত্যিই তো, মানুষের মধ্যেই তো বাস করেন ঈশ্বর। আক্ষেপ, এমন মানুষ আজ বিরলতম। সান্ত্বনা, এই বিরলতম চলে যাওয়া মানুষগুলো আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।
** তথ্য ও ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা : প্রতিশ্রুতি ভট্টাচার্য (কল্যাণব্রত–শিবানীর কন্যা)