ওয়েব গপ্পে গুপ্তচর
হাতে হাতে স্মার্টফোন। তরুণ প্রজন্মের চোখ ইদানীং নিত্যনতুন ওয়েব সিরিজে। সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সেইসব সিরিজ নিয়েই নানাকথা এই বিভাগে। আজ এক গুপ্তচরের কথা। লিখেছেন মৃণালিনী ঠাকুর।
বরাবরই ফিকশন নির্মাতাদের প্রিয় বিষয় কাশ্মীর। একেবারে সেই দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় থেকেই সিনেমা, সাহিত্যে কাশ্মীর উঠে এসেছে। কোথাও পটভূমি কাশ্মীর। কোথাও কাশ্মীর নিজেই এক চরিত্র। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই গত ১৫ আগস্ট ভারতের ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসে ঘোষিত হয় ‘মুখবির–দ্য স্টোরি অফ আ স্পাই’ শিরোনামের স্পাই থ্রিলারের কথা। ঘোষণা মতোই গত ১১ নভেম্বর জিফাইভ-এ শুরু হয়েছে ৮ পর্বের এই সিরিজ। বিষয়ের গুরুত্বের হিসেবেই হিন্দি ছাড়াও আরও তিনটি ভাষায় দেখানো হচ্ছে ‘মুখবির–দ্য স্টোরি অফ আ স্পাই’–পাঞ্জাবি, তেলুগু ও তামিল। লেখক, সাংবাদিক মলয় কৃষ্ণ ধরের লেখা উপন্যাস ‘মিশন টু পাকিস্তান : অ্যান ইন্টেলিজেন্স ইন পাকিস্তান’ অবলম্বনে লেখা হয়েছে এই সিরিজের গল্প ও চিত্রনাট্য।

স্পাই থ্রিলারের গল্প ইদানীংকার এক অতি চর্চিত বিষয়। বলিউড ছেয়ে আছে এহেন কাহিনিতে। তবে, ‘মুখবির–দ্য স্টোরি অফ আ স্পাই’ ঠিক সেই গোত্রের নয় বলে দাবি এর নির্মাতা টিমের। প্রেক্ষাপট ১৯৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ইতিবৃত্ত প্রায় সকলেরই ঐতিহাসিক সূত্রে জানা। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে অধিকার বিস্তারের সেই যুদ্ধ দুই দেশেরই প্রচুর মানুষের মৃত্যু ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধকে ঘিরেই বৃহত্তর দুই রাষ্ট্র আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়া উপ মহাদেশে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের একটা পথ করে নেয়। আন্তর্জাতিক সেইসব রাজনৈতিক ও ভৌগলিক সমীকরণ তো ছিল-আছে-থাকবে। যেটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও আক্ষেপের বিষয় কাশ্মীর নিয়ে জটিলতা আজও অব্যাহত। বলা যায়, সেখানেই এই জাতীয় ফিকশনের প্রাসঙ্গিকতা।
যুদ্ধ বা আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে গুপ্তচর বৃত্তির সম্পর্ক ইতিহাস প্রসিদ্ধ। এঁদের কর্মকুশলতা প্রশ্নাতীত। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, গুপ্তচর বা সিক্রেট এজেন্টদের মেধা, বুদ্ধি, কৌশল, তৎপরতা, উপস্থিত বুদ্ধি একটি গোটা সেনা বাহিনীর পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সর্বোপরি মাতৃভূমির প্রতি এঁদের আনুগত্য ও প্রয়োজনে আত্মবলিদান এক অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে। এমনই একজন সিক্রেট এজেন্ট, শত্রুদেশের (পড়ুন পাকিস্থান) যাবতীয় পরিকল্পনার খবর আগাম হাসিল করে, কীভাবে দেশকে জয়যাত্রায় এগিয়ে নিয়ে যায়, তাই নিয়েই তৈরি ‘মুখবির–দ্য স্টোরি অফ আ স্পাই’। বলা হয়, চরম শত্রু ভাবাপন্ন দুই দেশের মধ্যে শেষ পর্যন্ত যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তার কৃতিত্বের অনেকটাই এই এজেন্টের।

পরিচালনা শিভম নায়ার ও জয়প্রদ দেশাই। প্রযোজনা বৈভব মোদি ও তবাসুম মোদি। ভিক্টর ট্যাংগো এন্টারটেনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড-এর ব্যানারে নির্মিত হয়েছে এই সিরিজ। গল্প ও চিত্রনাট্য আরশাদ সঈদ ও বৈভব মোদি। চিত্রনাট্য লেখায় সঙ্গী হয়েছেন করণ ওবেরয়। সিনেমাটোগ্রাফি ডিমো পপোভ। মিউজিক অভিষেক নৈলওয়াল। অভিনয়ে আছেন প্রকাশ রাজ, জৈন খান দুরানি, আদিল হুসেন, হর্ষ ছায়া, সত্যদীপ মিশ্র, বরখা বিস্ত, দিলীপ শংকর, জোয়া আফরোজ, অতুল কুমার, করণ ওবেরয়, সুশীল পান্ডে, সুনীল শনবাগ প্রমুখের মতো শক্তিশালী অভিনেতা। ভারতীয় বিনোদনে আজ অপরিহার্য এঁরা সকলেই। কাহিনি ও পটভূমি বিচারে নিজেদের নতুন অবতারে হাজির করতে সিদ্ধহস্ত এঁরা। ‘মুখবির–দ্য স্টোরি অফ আ স্পাই’-কে অভিনয় গুণে জীবন্ত করে তুলেছেন এর দুর্দান্ত অভিনয় টিম। স্মার্ট প্রেজেন্টেশন, দ্রুতগতির চিত্রনাট্য, চোখা সংলাপ টানটান উত্তেজনায় উপভোগ্য করে তুলেছে এই সিরিজকে। আপাতত প্রথম সিজন।

সবশেষে দুটি সংযোজন। ভারতবর্ষের এই মুহুর্তের অন্যতম সেরা অভিনেতাদের একজন হলেন প্রকাশ রাজ। বিনোদনের যাবতীয় ম্যাজিক তাঁর দখলে। মশালা ছবিতে সেই কামাল দেখিয়েছেন তিনি বারবার। আবার এরই পাশাপাশি সিরিয়াস চরিত্রেও সমান দক্ষ প্রকাশ। পর্দার বাইরেও অত্যন্ত ব্যক্তিত্বপূর্ণ, দৃঢ়চেতা মানুষ রূপে গণ্য তিনি। দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে কোনও বৈষম্য নজরে এলেই প্রতিবাদে মুখর হন তিনি। এই সিরিজের মাধ্যমে ওয়েব দুনিয়ায় পা রাখলেন প্রকাশ, যা নিঃসন্দেহে বড় খবর। আর একটি তথ্য হলো মুখ্য ভূমিকাভিনেতা জৈন খান দুরানি সম্পর্কে। দুরানি নিজেও একজন কাশ্মীরী। সংবাদে প্রকাশ, শ্রীনগরে এই সিরিজের প্রমোশনে গিয়ে স্পষ্টতই নষ্টালজিক হয়ে পড়েন তিনি। কাশ্মীর এখন ফিল্ম, মেগা এবং ওয়েব সিরিজ নির্মাণের ক্ষেত্রে আরও গুরুত্ব পাচ্ছে, এটা অত্যন্ত ইতিবাচক, বার বার একথার উল্লেখও করেন দুরানি। সব মিলিয়ে এই সিরিজ যে এক ভিন্ন মাত্রায় আপামর ওয়েব দর্শকের মাস্ট ওয়াচ তালিকায় স্থান পেতে চলেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।