মায়া যখন জীবনের জঞ্জাল
নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী পরিচালিত ‘মায়ার জঞ্জাল’ নিয়ে লিখেছেন নির্মল ধর।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটের স্নাতক এই তরুণ প্রথম ফিচার ছবি ‘ফড়িং’ থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি টলিউডে বাণিজ্যিক মাল সরবারাহের সাপ্লায়ার হতে আসেননি। তাঁর ছবি বানানোর পেছনে একটি জীবনদর্শন আছে। সামাজিক চেতনা রয়েছে। দায়বোধও কাজ করে। সিনেমা তাঁর কাছে নিজের শিল্পচিন্তা, বোধ, রাজনীতি, দর্শন ও দর্শকের সঙ্গে সেইসব ভাগ করে নেওয়ার এক জরুরি ও কার্যকর মাধ্যম। অনেকটা বিরতির পর প্রায় ৩/৪ বছর ধরে দুই বাংলার প্রযোজনায় ইন্দ্রনীল বানিয়েছেন এই ‘মায়ার জঞ্জাল’ ! মানুষের জীবনে মায়া-মমতা, ভালোবাসা বেঁচে থাকার একটি বড় রসদ। এগুলো ছাড়া মানুষ বাঁচে না, বাঁচতে পারে না !
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন ইন্দ্রনীল। সেই চিত্রনাট্যে খুবই সাবলীল ভঙ্গিতে ঢুকে পড়েছে আজকের জীবনের জঞ্জালও। বেকার, অর্ধশিক্ষিত, পরশ্রায়ী তরুণ সত্য, ওপার বাংলা থেকে এপারে পাচার হয়ে আসা তরুণী বিউটি, কারখানার চাকরি খুইয়ে ফ্ল্যাটবাড়ির গার্ডের চাকরি করা মাঝবয়সী তরুণ চাঁদু বা তাঁর স্ত্রী–সকলেই এখনকার কলকাতার তলপেটের নিচে থাকা মানুষ। এরা তথাকথিত ভাবে সমাজের জঞ্জাল ! কিন্তু, এদের বুকের পাঁজরের মধ্যে এখনও জমা রয়েছে পারস্পরিক মায়া, প্রেম, সহানুভূতিবোধ। কিন্তু, একটু দূরেই চল্লিশতলার বিলাসী তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটে সেই মায়া-প্রেম অনুপস্থিত! পাশেই বস্তি মানুষের জীবন তাঁদের কাছে আবার ‘সমাজের জঞ্জাল’। ইন্দ্রনীল চরিত্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের জটিলতার মধ্যে সেই মায়াকে আবিষ্কার করেও স্যাটায়ার ফর্মে বলতে চেয়েছেন, আজকের জীবনে ওগুলো ‘জঞ্জাল’ মনে হলেও, সেইসব নিয়েই বাঁচতে হয়, অন্যকে বাঁচাতে হয়।
যেমন চাঁদুকে বাঁচায় তাঁর স্ত্রী। সত্য যদিও শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেনি প্রেমিকা বিউটিকে। কিন্তু তাঁকে নেশার খাবার খাইয়ে মারতে তো চায়নি–ওটা ছিল দুর্ঘটনা! তার সাজা সে পেয়েছে। আর চাঁদু যে চোরাই ড্রাগ চালানের কাজ শুরু করেছিল, সেটাও স্ত্রীকে অন্যের বাড়িতে ‘ঝি-গিরি’ করতে দেবে না বলেই! অর্থাৎ মায়া এবং ভালোবাসার আরও একটি উদাহরণ ! কিন্তু, এখন এমন একটা সময়, যখন জীবনের ন্যূনতম এইসব মূল্যবোধগুলি জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। আমরা এখন এক হৃদয়হীন, কুটিল, স্বার্থপর, জঞ্জালের জঙ্গলে বাস করছি। ইন্দ্রনীল সেই জগতটারই নির্মম, নির্মোহ ছবি এঁকেছেন।
আজকের বেশিরভাগ বাংলা ছবি করিয়ে যখন কঠিন বাস্তব ও রাজনীতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে তৃতীয় শ্রেণীর বিনোদন সরবরাহে ব্যস্ত, ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী দেখিয়ে দিলেন জীবনঋদ্ধ ছবি বানাতে কব্জির জোর ও বুকের পাটা একটু চওড়া করে নিতে হয়! আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাট বাড়ি আর মার্সিডিজ বেনজের স্বপ্ন থাকলে, জীবন আঙুলের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবেই। হ্যাঁ, আরও একটা কথা–ঋত্বিক চক্রবর্তী কেমন অভিনয় করেন সেটা আমরা জানি। ক্যামেরার সামনে নিশ্চুপ বসে থাকলেও তাঁর ওপর থেকে দৃষ্টি সরানো যায় না। এখানেও যায়নি। তবে, অবাক করেছেন দুজন–সত্য চরিত্রে ওপার বাংলার সোহেল খান এবং বিউটির চরিত্রে চেনামুখ চান্দ্রেয়ী ঘোষ। চেনা চান্দ্রেয়ী একেবারেই অচেনা এবং দারুন! সোহেল ভাইকেও কুর্নিশ !