বহু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে চুনার দুর্গ
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। ইতিহাস প্রসিদ্ধ লখনউ-এলাহাবাদ-বেনারস ঘিরে চলছে এই ভ্রমণ ধারাবাহিক। লিখছেন লিপি চক্রবর্তী। আজ পঞ্চম ও শেষ পর্ব।
গত সপ্তাহেই বলেছি বিন্ধ্যাবাসিনী মন্দির ও সীতাকুণ্ডের কথা। পাহাড়ের ওপর সীতাকুণ্ড। এখান থেকে অনেকগুলি সিঁড়ি নামলে আছে আর এক দেবী দুর্গার মন্দির, অষ্টভুজি মন্দির। সিঁড়ির দুপাশে সারি সারি দোকান, পুজোর উপকরণ সহ বিভিন্ন জিনিসের। আমরা অষ্টভুজির দুয়ারে এসে দাঁড়ালাম। যা লাইনের অবস্থা, তাতে বাইরে থেকে দেখে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। ইতিমধ্যে এক ভক্তের উদয় হলো। তিনি জনপ্রতি দুশো টাকার বিনিময়ে দর্শনের সুযোগ করে দেবেন বলে জানালেন। এই মন্দিরটার গঠন নিয়ে অনেক কথা শুনেছিলাম। সেই কৌতূহল দুশো টাকার বিনিময়ে নিবৃত্ত করার ইচ্ছে হলো।
অষ্টভুজি মা দুর্গার মন্দিরে প্রবেশ করতে হয় ফুট তিনেক লম্বা ও চওড়া একটি পাহাড়ের গর্তের মধ্যে দিয়ে। সেই গর্তের সামনে গিয়ে মনে হলো, আমি কিছুতেই এইটুকু জায়গা দিয়ে ভিতরে যেতে পারব না। কিন্তু সামনে পিছনে অনেক মানুষের উৎসাহে কীভাবে যেন গলে গেলাম। এখানেই শেষ নয়। ভিতরে ঢুকে সোজা হয়ে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। একদম উল্টো ‘এল’ অক্ষর হয়ে এগোতে হবে মাথার ওপর ঝুলে থাকা পাহাড়ের পাথরের নিচ দিয়ে। বেশ রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছিল। কিন্তু বিধি বাম। মায়ের থালায় কুড়ি টাকা দক্ষিণা দিতেই ভক্তগণ তেড়ে এলেন–’মা’কে শৃঙ্গার কে লিয়ে বিশ রুপিয়া! ভাগ ভাগ হিয়াসে…বাঙ্গালি লোগ এইসাই হ্যায়। কী করে যে বুঝে যায় আমরা বাঙালি! ঠাকুর দেবতাকে কম টাকা দিলেই এবারের ভ্রমণে বাঙালি বলে গালাগাল শুনতে হয়েছে। এটা বেদনাদায়ক তো বটেই, সেইসঙ্গে অপমানজনক বেশি। যাই হোক, আমার কৌতূহল নিরসন হয়েছে, আর জার্নিটা ভালো লেগেছে।
এবার আমাদের দৌড় চুনার কেল্লার দিকে। চন্দ্রকান্তা চুনারগড় বা চরণাদ্রি বা আধুনিক নাম চুনার দুর্গটি বহুযুগের অনেক যুদ্ধ, অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। খ্রিস্টপূর্ব ৫৬ সাল থেকে চুনারের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সেটা রাজা বিক্রমাদিত্যের সময়। লিখিত ইতিহাসের খোঁজ পাওয়া যায় পনের শতকে শের শাহ সুরির সময় থেকে। তাঁর লক্ষ্য ছিল দিল্লির সিংহাসন। সেই কারণে তাঁর প্রথমেই চোখ পড়ে চুনারের দিকে। চুনারের মৃত শাসকের সন্তানহীন বিধবা এক স্ত্রীকে এই পাঠান মানুষটি বিবাহ করেন। তারপর বাকি স্ত্রীদেরও বিবাহ করে সম্পূর্ণ সম্পত্তি দখল করেন। এরপর মোগলরা আসে। তারা যুদ্ধ করে রাজত্ব দখল করে। তারপর চুনার দখল করতে আসে মারাঠারা। তার পিছে ইংরেজরা। অবশেষে ভারতের স্বাধীনতা আসে। বহু ইতিহাসের কাহিনি বুকে করে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে চুনার দুর্গ। কথিত আছে, সারা ভারতবর্ষ যদি দখল করতে কেউ চায়, তবে তাকে প্রথমেই চুনার দুর্গ দখল করতে হবে।
পুরান বলে, সত্যযুগে শ্রীবিষ্ণু বামন অবতার রূপে বলি রাজার রাজধানীতে পদার্পণ করেছিলেন বলে চুনারের এক নাম চরণাদ্রি। অদ্ভুত সুন্দর নীল জলের রূপ এখানে গঙ্গার। একটা সময় নাকি চুনার দুর্গ গঙ্গার ভিতরে অবস্থিত ছিল। এখন মা গঙ্গা একপাশ দিয়ে প্রবাহিত। দুর্গর ভিতরে একটি গভীর কুয়ো আছে, যেখানে রানিরা স্নান করতেন। এখন সেটি লোহার জাল দিয়ে ঘেরা থাকা সত্বেও আমাদের মতো উৎসাহী পর্যটকরা প্লাস্টিকের বোতলে ভর্তি করে দিয়েছি। দুর্গের একদিকে আছে তৎকালীন কোনও একজন মানুষের সমাধি, যাঁকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল। দুর্গের ঠিকঠাক রক্ষণাবেক্ষণ পর্যটন আকর্ষণ বাড়িয়েছে। দেখলাম, স্টাডি ট্যুরে অনেকগুলি স্কুলের ছেলেমেয়ে এসেছে তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে। ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাসচর্চার জন্য এই দুর্গের গুরুত্ব অসীম নিঃসন্দেহে। যখন নেমে এলাম, তখন উপলব্ধি করলাম, অনেকটা সময় আমরা, আজ থেকে প্রায় সাত-আটশো বছর আগে ভ্রমণ করে এসেছি। তার রেশ কাটতে সময় লাগবে অনেকদিন।
বারাণসী বাসের শেষ দিনে গেলাম সারনাথ। যে বোধিবৃক্ষের তলায় বুদ্ধদেব সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, সেই গাছের বর্তমানকে দেখলাম প্রাণ ভরে। সঙ্গের বৌদ্ধ মন্দিরটি নতুন। আফগানিস্তানের বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের পর, তারই অনুকরণে এখানে একটি বুদ্ধমূর্তি স্থাপিত হয়েছে। যেখানে গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিল, মূল ভামেক স্তূপটি সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বেশ খানিকটা রাস্তা। আমরা যখন পৌঁছলাম, সারানোর কাজ চলছিল বলে ভিতরে ঢুকতে পারিনি। ভাগ্য সহায়তা না করায় মিউজিয়ামেও ঢুকতে পারিনি। প্রবেশমূল্য মাত্র পাঁচ টাকা। কিন্তু সেটি অনলাইনে পে করে ভিতরে যাওয়ার অনুমতি মেলে। আমাদের তিনবারের চেষ্টায় টাকা কেটে নেওয়া সত্বেও টিকিট এলো না। ফলে দুঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে মিউজিয়ামের দরজার এপ্রান্ত থেকে চলে আসতে বাধ্য হলাম।
আসার সময় বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি এবং সংলগ্ন বিড়লা মন্দিরটি দেখে এলাম। বিকেলে বেরিয়ে বাবা বিশ্বনাথ মন্দিরের চত্বর পেরিয়ে রামভাণ্ডারের লাল প্যারা কিনে আনতে ভুল হয়নি আমাদের। এবারের মতো বারাণসী দর্শন শেষ। অনেককিছু দেখা হলো। তবু, যেন রয়ে গেল বহু কিছু বাকি ! পরদিন বিভূতি এক্সপ্রেসের জন্য অপেক্ষা, উদ্দেশ্য কলকাতা।
ছবি : লেখক