অনুপ্রাণিত করে ‘নাছিময়’
নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। এই বিভাগে মাঝে মাঝে আমরা ভিন্ন ভাষার ছবি নিয়েও আলোচনা রাখছি। আজ তেমনই একটি ছবি। পরিচালক হীরেন বোরার রাভা ভাষায় নির্মিত ছবি ‘নাছিময়’ নিয়ে লিখেছেন নির্মল ধর।
নিম্ন আসামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভাষা রাভা। রাভা উপজাতিদের কথ্য ভাষা হচ্ছে রাভা। শুধু আসামেই নয়, উত্তর বাংলার আলিপুরদুয়ার এবং ডুয়ার্স অঞ্চলেও রাভা উপজাতির মানুষ বসবাস করেন। ভারতীয় সংবিধানেও রাভা একটি স্বীকৃত ভাষা। সাকুল্যে প্রায় চার লক্ষ মানুষের মাতৃভাষা হচ্ছে রাভা। কিন্তু এই ভাষায় সিনেমা খুব একটা হয় না। উত্তরবঙ্গে তো নয়ই। আসামের হাতে গোনা তিন চারজন মানুষ রাভা ভাষায় কখনও সখনও সিনেমা বানান। হীরেন বোরা তেমনই একজন অসমীয়া পরিচালক। তাঁর সদ্য নির্দেশিত ছবিটির নাম ‘নাছিময়’ (ডার্লিং) দেখার সুযোগ ঘটলো সম্প্রতি কলকাতা ফিল্ম উৎসবে। প্রায় প্রতি বছরই দিল্লির তরুণ ফিল্ম কিউরেটর শান্তনু গাঙ্গুলি বিরল সব ভারতীয় ভাষায় তোলা ছবি নিয়ে কলকাতায় আসেন। তাঁরই দৌলতে দেখার সুযোগ পেলাম রাভা ভাষার ছবি ‘নাছিময়’।
রাভা জনজাতির সংস্কৃতি ও শিল্পভাবনা এবং ঐতিহ্য অসমিয়া বা বাংলার চাইতে কোন অংশেই খাটো নয়। পরিচালক হীরেন বোরা এই ছবিতে নাছিময় নামের এক গরীব ঘরের রাভা তরুণীর একান্ত নিজস্ব উদ্যোগে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার গল্প বলেছেন। হ্যাঁ, সেটা করতে গিয়ে তিনি ব্যবসায়িক ফর্মুলার সাহায্য নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু রাভা উপজাতির নিজস্ব নৃত্য এবং আচার অনুষ্ঠানের প্রতিও নজর রেখেছেন। রাভা উপজাতির অন্তর্গত হুচাং গোষ্ঠীর তরুণী নাছিময়। ওই গোষ্ঠীর মধ্যে একটি লোককাহিনি রয়েছে। পাহাড়ের গুহাবাসী এক অজগর সাপকে প্রতি বছর একটি বা দুটি করে মেয়ে উপহার দিতে হয় তার ভক্ষ হিসেবে। এভাবে একটা সময় মেয়ের সংখ্যা কমতে কমতে শূন্যে দাঁড়ায়। তখন একজোড়া যমজ মেয়েকে সাপের গর্তে পাঠালে, তারা সেই অজগরটিকে মারে। সেই বিশেষ দিনটি রাভাদের কাছে এক উৎসবের দিন। ছবির শুরু সেই উৎসব সন্ধ্যার নাচ-গান দিয়ে।
এই সিনেমায় আমরা আসামের প্রত্যন্ত গ্রামে রাভা উপজাতিদের বাড়ি-ঘর-সংসারের একটা পরিচ্ছন্ন ছবি দেখতে পাই। শান্ত, সরল জীবন তাদের। কিন্তু সব সমাজেই ভালো লোকের পাশাপাশি খারাপ লোকও থাকে। হীরেনের গল্পেও তাই নাছিময় যেমন সহজ সরল তরুণী, তেমনি রয়েছে বিকাশ নামের এক ভিলেন। আবার তার মুখোশের আড়ালে কিন্তু একটি সৎ হৃদয়ের দেখাও মেলে। একই সঙ্গে পরিচালক রেখেছেন নাছিময়ের সুন্দর চেহারার এক প্রেমিককে, যে আসলে একজন নারী নির্যাতনকারী sadist ! নাছিময় চেয়েছিল গ্রামের দরিদ্র তরুণ-তরুণীদের উন্নয়নের জন্য একটি স্বশাসিত সংস্থা তৈরি করতে। কিন্তু তার সেই প্রেমিক/স্বামীই সাহায্যের অজুহাতে গ্রামের তরুণীদের পাচারের কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। ছবির বাকিটা অবশ্যই নাছিময়ের উদ্যোগে সব বাধা অতিক্রম করে তাঁদের দলের সাফল্যের কাহিনি।
হীরেন বোরা গল্প বলেছেন স্ট্রেট ন্যারেটিভে। চিত্রনাট্যের গতি ও চলনে কোথাও বাঁক নেই। ছবি দেখতে দেখতে নাছিময়ের লড়াই কোথাও যেন আমাদের অনুভবে এ দেশের সব বঞ্চিত, অবহেলিত জনজাতির মেয়েদের অস্তিত্বরক্ষার যুদ্ধে পরিণত হয়। ভালো লেগেছে, গোয়ালপাড়া অঞ্চলের প্রাকৃতিক লোকেশনের সুন্দর ব্যবহার। জিন্তু বরদলইয়ের আবহ রাভা লোক সঙ্গীতের অনুসারী। হিতেন ঠাকুরিয়ার ক্যামেরা বেশ রঙিন করেই দেখিয়েছে রাভা গ্রামের সৌন্দর্য। আসলে এইসব বিরল ভাষার ছবিতে সেখানকার মাটি, জল ও হাওয়ার এক গন্ধ ও আবেশ জড়ানো থাকে, সেটাই এই সব ছবির গুণ। আঞ্চলিক ভাষার ছবির সৌন্দর্য সেখানেই লুকানো।