Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

আপ্যায়নে রেড করিডর

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। পড়ছেন কাজিরাঙার বর্ণময় কাহিনি। আজ চতুর্থ পর্ব। লিখছেন মণিদীপা কর

না, বাঘের গল্প এখনও শেষ হয়নি। যদিও জঙ্গল মানেই কেবল বাঘ নয়। নানা রকম পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, সরীসৃপ ও সর্বোপরি বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদকুল নিয়ে সৃষ্ট এক সৌন্দর্য, মাধুর্য, যৌবন, অনিশ্চয়তা, রহস্য ও সংগ্রামের নাম অরণ্য। তবু বলতে দ্বিধা নেই, বাঘের জঙ্গলে যতই রেয়ার সাইটিং হোক, আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে বাঘই থাকে। তাই তো সে জাতীয় পশু। আমাদের পরের বাঘ দর্শনের গল্পও টান টান উত্তেজনায় মোড়া। তবে, তার আগে জেনে নেওয়া যাক পশ্চিমী বা বাগোরি রেঞ্জের গল্প।

Deers
আপ্যায়নে রেড করিডর 9

সফরের তৃতীয়দিন সকালে ইচ্ছা ছিল গিবন পয়েন্ট হয়ে ওয়েস্টার্ন জোন-এ যাব। কিন্তু তার আগের রাত থেকে দফায় দফায় বৃষ্টি হচ্ছে। তাই সেই পরিকল্পনা বদলে আমরা রওনা হলাম বাগোরি রেঞ্জ-এর দিকে। বৃষ্টির জন্য এদিন শুরু থেকেই আমাদের জিপসিতে হুড তোলা। পথে ধাবায় নাস্তা করতে নেমে বৃষ্টিতে দীর্ঘক্ষণ আটকে পড়লাম। ফলে আমাদের সাফারি শুরু করতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই মন-মেজাজ খারাপ। তার উপর হুড তোলা। দৃষ্টিপথ একটা নির্দিষ্ট অংশেই সীমাবদ্ধ। বৃষ্টির ছাটে জামাকাপড় ভিজছে। সঙ্গে ঠাণ্ডা হাওয়া। কোনও ক্রমে ক্যামেরা বাঁচাচ্ছি। এইভাবেই পৌঁছে গেলাম ডোঙ্গা বিল। এ এক অন্য অভিজ্ঞতা ! বিলের জলে খেলা করে চলেছে চিতল মাছ। না একটা আধটা নয়, ঝাঁকে ঝাঁকে। যাঁরা চিল্কা হ্রদে ডলফিনের লাফিয়ে চলা দেখেছেন, তাঁরা সহজেই অনুমান করতে পারবেন দৃশ্যটি। বিলের জলে অন্যান্য প্রজাতির মাছ ও কচ্ছপকেও সাঁতার কাটতে দেখলাম। যদিও তার ছবি তোলা সম্ভব হলো না।

Kaziranga Canon 252
আপ্যায়নে রেড করিডর 10

কিছুক্ষণ ডোঙ্গা ওয়াচ টাওয়ারে কাটিয়ে আবার জঙ্গলের পথ ধরলাম। মনের মেঘ তবু কাটছে না। এত প্রতিকূলতার মধ্যেই মনে হলো, বাইরের বনানী আমাদের জন্য রঙিন পর্দা টাঙিয়ে অপেক্ষা করছে। আমাদের মনের কথা যেন কোনও অদৃশ্য তরঙ্গে পৌঁছে গেল প্রফুল্লদার কানে। সরু কাদা-পথেই গাড়ি থামিয়ে হুড খুলে ফেলল সে। হঠাৎই চোখের সামনে লাল, হালকা সবুজ, গাঢ় সবুজ, কমলা, বেগুনী ও নীলের দিগন্ত খুলে গেল। সব মন-খারাপ এক নিমেষে উধাও। মনে হলো আমাদের জন্য রেড করিডোর বানিয়ে অপেক্ষা করছে বাগোরি।

Madantak
আপ্যায়নে রেড করিডর 11

নানা রঙ-বেরঙের পাখি, গণ্ডার, হরিণ, এশিয়াটিক ওয়াটার বাফেলোর দেখা পেলেও লাল চাঁদোয়ার নিচে বাঘ দর্শন হল না। এক বনকর্মীর থেকে জানা গেল, সকাল সাড়ে আটটায় মুশলধারা বৃষ্টিতে রাস্তা ধরে কিছুটা পথ হেঁটে, ঘাসের বনে নেমে গিয়েছে এক পুরুষ বাঘ। আবার আক্ষেপের পালা। কারণ, ওই সময় বৃষ্টির জন্য আমরা ধাবায় আটকে ছিলাম। আবারও প্রমাণ হলো, প্রকৃতির ইচ্ছার কাছে আমাদের সব হিসেব কত মূল্যহীন ! তবু, হাল ছাড়তে রাজি নয় প্রফুল্লদা ও তকিব। ঘড়ি বলছে, আরও কিছুটা সময় আছে। তাই জঙ্গলের একটা জায়গা, যেখানে পর্যটকদের আনা-গোনা কম হওয়ার ফলে বনচরদের চলাচল বেশি, সেখানে জিপসি দুটো থামিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ অপেক্ষা করলাম। প্রত্যাশা, যদি কেউ আসে। কেউ এল না বটে, কিন্তু পুরো সময়টাই সঙ্গ দিল বাগোরির অনির্বচনীয় নিসর্গ। বনক্ষ্যাপাদের কাছে তাই বা কম কী? এবার ধীরে ধীরে ফেরার পালা। 

এদিন বিকেলেও আমাদের গন্তব্য কোহরা বা সেন্ট্রাল রেঞ্জ। বলা ভাল, সফরের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দিন বিকেলে আমাদের নজর ছিল জঙ্গলের কেন্দ্র অর্থাৎ সেন্ট্রাল রেঞ্জ-এ। ঘটনাচক্রে তিনদিনই আমরা বাঘ পেয়েছিলাম। দ্বিতীয় দিন দূরে গোল্ডেন টাইগার। তৃতীয় দিন ওই একই জায়গায়, তবে, ঘাসের মধ্যে অন্য এক বাঘ। ক্যমেরার লেন্স-এ ঝাপসা এলেও খালি চোখে তাকে বিন্দু ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। ফলে চতুর্থ দিন বিকেল, অর্থাৎ শেষ সাফারিতে আমাদের ব্যাকুলতা কিছুটা বেশি ছিল। তৃতীয় দিন বিকেলে বাঘ দেখে আশ না মিটলেও জঙ্গলে অন্য এক রোমাঞ্চ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। এবার সেই গল্প !

Western
আপ্যায়নে রেড করিডর 12

জঙ্গল চষে তখন ফেরার পথ ধরেছি। টুকিটাকি ছবি উঠছে। হঠাৎ পথের বাঁ পাশের কিছুটা খালি জায়গায় দুই গণ্ডারের দেখা মিলল। প্রফুল্লদা বলল, মেটিং হবে। আমাদের প্রফুল্লদার অভিজ্ঞতার উপর পুরো বিশ্বাস রয়েছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেই বিশ্বাস বাস্তবে রূপ পেতে শুরু করল। আমরাও গাড়ির সিটের উপর দাঁড়িয়ে ক্যামেরা রেডি করে প্রস্তুত। কেউ ভিডিও নেব, কেউ স্টিল ছবি। আমাদের জিপসিটা ছাড়াও অন্য একটি জিপসিও দাঁড়িয়ে রয়েছে। কারুর মুখে কোনও শব্দ নেই। শেষ মুহূর্তে মিলনাতুর দুই গণ্ডারের আবেগকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অন্য জিপসির এক সওয়ারি মহিলা জানালেন, তিনি এই দৃশ্য দেখতে চান না। তাঁর আজ্ঞা মেনে চালক জিপসিতে বিকট শব্দ করে স্টার্ট দিল। ব্যাস, তাতেই প্রচন্ড চটে মাটিতে খুর ঠুকে, ধুলো উড়িয়ে, ছুটে এল পুরুষ গণ্ডারটি। আগের গাড়ি তো স্টার্ট নিয়ে উধাও। এবার গণ্ডারের লক্ষ্য আমরা। ঝড়ের বেগে আমাদের ধাওয়া করল ওই প্রকাণ্ড খড়্গধারী। আমরা তখন ক্যামেরা সামলাব না নিজেদের ! ওদিকে প্রফুল্লদা রাতভর বৃষ্টিতে কাদা হয়ে যাওয়া মাটির রাস্তায় আপ্রাণ গাড়ি ছোটাচ্ছে। কোনওক্রমে গণ্ডারের নিশানার বাইরে এসে, আগের গাড়ির মহিলাকে শাপ-শাপান্ত করতে করতে, খেয়াল হলো, আমাদের অন্য গাড়িটাও তো ওই পথে ফিরবে। ফোন করে জানলাম, ওদেরও প্রায় ৫-৭ মিনিট গণ্ডারের তাড়া খেতে হয়েছে। বলা বাহুল্য, আগের দিনের মতো এদিনও মনের কোণে খানিক তিক্ততা নিয়েই জঙ্গল ছাড়লাম। পরের, অর্থাৎ শেষ পর্বে থাকবে কাজিরাঙার জঙ্গলে বাঘ দেখা ও না-দেখার গল্প । সঙ্গে বলব সফরের জন্য জরুরি কিছু অতি প্রয়োজনীয় তথ্য। (চলবে)

ছবি : লেখক