একটু মানবিকতা প্রত্যাশিত
জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে জীবন নিজেই নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।
ডেলিভারি বয়দের অপমান এবং সেই অপরাধে কাঠগড়ায় রান্নাঘরের হোস্ট সুদীপা চ্যাটার্জি। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে বয়কটের ডাক এবং চ্যানেল কর্তৃপক্ষের সুদীপাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত–আপাতত এই নিয়ে বাজার বেশ গরম। যাবতীয় নিন্দা, বিতর্কের উর্দ্ধে উঠে বলা যায়, একা সুদীপা নন, ডেলিভারি বয়দের প্রতি আমরা অনেকেই যে সব সময় মানবিক হতে পারি না, সেই সত্যটাও স্বীকার করে নেওয়া জরুরি। তবে, বিষয়টা একতরফা বিচার করাও সমীচীন নয়। ডেলিভারি বয়দের নিয়ে অনেক আগেই আমি একটি দৈনিকে কলম ধরি। তাঁদের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি রেখেই লিখেছিলাম সেই প্রতিবেদন। এবারও তাঁদের পক্ষেই কথা বলবো। কিন্তু তার আগে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
কমিউনিকেশন স্কিল আজকের যাপন সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যদি বলি, এর ওপরেই এখন সারা বিশ্বের যাবতীয় কর্মকাণ্ড চলছে, তাহলে বাড়িয়ে বলা হবে না। বলা বাহুল্য, ডেলিভারি বয়ের কাজে এই বিশেষ গুণটি একান্ত প্রয়োজন। তারই সঙ্গে একটু ভালো করে কথা বলতে জানা (বিশেষত টেলিফোনে), সাধারণ কিছু বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতনতা–এই সবই হলো গ্রাহক পরিষেবার শর্ত। সমস্যাটা হয়ে যায় এখানেই। বেশিরভাগ ডেলিভারি বয় এমন এক আর্থসামাজিক স্তর থেকে উঠে আসে, যে, তাদের পক্ষে এই বিষয়গুলি মাথায় রাখার পরিস্থিতিই সবসময় থাকে না। তারা কী পরিমাণ প্রতিকূলতার মধ্যে কাজটা করে জেনেও কথাগুলি বলছি। কারণ, এটাই হলো চরম বাস্তব–যখন আপনি টাকা খরচ করবেন, তখন একটা যথাযথ পরিষেবা প্রাপ্তির প্রত্যাশা আপনার মধ্যে স্বাভাবিক নিয়মেই গড়ে উঠবে। তখন অপরপক্ষের কষ্টের কথা মাথায় থাকবে না আপনার !
এবার ওদের কথা। বেকারত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাকরিদাতা সংস্থাগুলির কর্মীদের প্রতি অন্যায় সুযোগ নেওয়ার ব্যাপারটা বেড়ে যায়, এটা সকলেরই জানা। এ হলো চিরকালীন সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব। ডেলিভারি বয়দের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত প্রকটভাবে চোখে পড়ে। কিছুদিন আগের কথা, একটি খাবার ডেলিভারি সংস্থার মাধ্যমে অর্ডার করে, সেটা ডেলিভারি পেতে অনেকটা বেশি সময় লেগে যাওয়ায় ডেলিভারি বয়ের কাছে এর কারণ জানতে চাই। তার জবাব, আমাদের এরিয়াটা আগের তুলনায় অনেকটা বেড়ে গেছে ম্যাডাম এখন। তাই সামাল দিতে পারছি না। এরই সঙ্গে সে বলে, লোকজন ছাঁটাই চলছে। মাথা ঠিক রাখতে পারি না আর আজকাল। এরপর যেতে যেতে ছেলেটি বলে যায়, ফিডব্যাক রিপোর্টে লিখবেন না প্লিজ। তাহলে চাকরিটা খোয়াবো। বলা বাহুল্য, আমি কোনও নেগেটিভ ফিডব্যাক সেদিন কেন, কোনও দিনই দিই না। এমন নয়, আমি খুব মহান একজন মানুষ। কিন্তু, এটা বুঝি, অন্তত এটুকু মানবিক না হলে, নিজেরই রাতের ঘুমটা মাটি করবো !
সত্যি কথা বলতে কী, এই যে নামকরা (কোথাও কোথাও বহুজাতিক) সংস্থাগুলি ঘরে ঘরে নিত্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় বস্তু পৌঁছে দেবার পরিষেবাটা দিচ্ছে, সেটা যাদের মাধ্যমে, আমরা কতটুকু জানি, কেমন আছে, কেমন থাকে সেই ডেলিভারি বয় বা এজেন্টরা ? আক্ষেপের বিষয়, পুরো সিস্টেমটাই যাদের ওপর নির্ভর করে চলে, তারা কেমন থাকে, তাই নিয়ে কর্তৃপক্ষের মোটেই মাথা ব্যথা নেই। বেশিরভাগ সংস্থার পলিসি হলো, কম টাকায় বেশি কাজ করানো। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব নেই–মোটামুটি এই দিশাতেই লোকজনকে দিয়ে কাজ করায় এরা। খিদের চোটে চলার পথে গ্রাহকের জন্য নির্দিষ্ট প্যাকেট খুলে কোনও এক ডেলিভারি বয়ের খাবার খেয়ে ফেলার করুণ কাহিনি আমাদের স্তব্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু সেও ছিল এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। তারপর চাকরি খুইয়ে কিভাবে চলছে তার সংসার, সে খবর রাখা আর সম্ভব হয়নি আমাদের পক্ষে।
চাকরি খোয়ানোর ব্যাপারটা হয়তো এখন সব ক্ষেত্রেই বড্ড নির্মমভাবে ঘটছে ! ওদের সমস্যা হলো, জমা পুঁজি বলে কোনওদিনই কিছু নেই ওদের। জেনে রাখুন ভদ্র ও শিক্ষিত (ডিগ্রি থাক না থাক) ছেলেমেয়েরা একেবারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরই এই পেশায় আসে সাধারণত। কারণ, অমানুষিক পরিশ্রম। সেই আনুপাতিক হারে পয়সা মেলে না। এদিকে, কোনও নির্দিষ্ট ডিউটি আওয়ার নেই। রাস্তাঘাটের যাবতীয় বাধাবিপত্তি ছাড়াও আছে গ্রাহকদের নানা বায়নাক্কা। সেসব সামলে দিনের শেষে যেটা ওরা ঘরে নিয়ে যায়, তাতে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ প্রবাদটি পাল্টে আপনাকে বলতে হবে, রোজ পান্তা জোটানোই এক অধরা স্বপ্ন ওদের কাছে।
এর বাইরে আমাদের, অর্থাৎ, গ্রাহকদের কথা। অমানবিকতায় আমরাও কিছু কম যাই না। পান থেকে চুন খসলে, যে প্রতিক্রিয়া দেখাই অনেকেই, তা ব্যাখ্যার অযোগ্য। পেটে খিদে, পিঠে বিপুল বোঝা, রাস্তার জ্যাম, শরীর খারাপ, প্রবল বৃষ্টি, কাঠফাটা রোদ–এসব নিয়েই চলা ওদের। ইদানীং অনেককেই দেখছি সাইকেলে চড়ে খাবার ডেলিভারি দিতে আসছেন। দু-একজনকে হেঁটেও আসতে দেখেছি। কোনওদিন খাবার পেতে দেরি হওয়ায় মনে মনে বিরক্ত হবার পর যখন সাইকেলে বা পায়ে হেঁটে ডেলিভারির ছেলেটিকে আসতে দেখেছি, তখন নিজের কাছেই লজ্জায় মাথা নত হয়েছে।
সবশেষে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি এবং সেই সূত্রেই কিছুটা সমাজমনস্ক হওয়ার বার্তা সকলের কাছে। চূড়ান্ত বেকার সমস্যায় আজকের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই যে যা পাচ্ছে হাতের কাছে, সেই কাজই করছে। যোগ্যতা ছাড়াই হয়তো করছে। কিন্তু পরিশ্রম করছে। চালাকি করছে না। পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে বাড়ি-গাড়ি করে ফেলছে চারপাশের লোকজন। সেখানে এই ডেলিভারি বয়দের সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি আমরা, যাঁরা নিজেদের সচেতন নাগরিক বলে মনে করি, তাঁরা যদি ক্ষমা করতে না পারি, তাহলে, নিজেদের কাছেই মানুষ হিসেবে আর একটু ছোট হয়ে যাব না কী ? ভেবে দেখবেন সবাই।