Monday, February 3, 2025
গানের ভুবনদর্পণে জীবন

কিন্নরকণ্ঠী প্রাণময়ী এক নারী

দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সুবাদে কাছে যাবার সৌভাগ্য হয়েছে সংগীত জগতের বহু গুণী মানুষের। তাঁদের নিয়েই এই বিভাগ। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে। আজ কিংবদন্তী আরতি মুখোপাধ্যায়

তখন তোমার একুশ বছর বোধহয়…উঃ কী প্যাশন, কী অপরূপ আবেদন–শুনেই পাগল হয়ে গেছিলাম। তারপর আরও কত !! এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে… না বলে এসেছি তা বলে ভেবো না… এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনায়… মরি মরি একী লজ্জা…গান তো নয়, যেন হৃদয়ের কথা বলছেন তিনি। এক একজন গীতিকার-সুরকার ওঁকে নিয়ে এক একরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। আর সবেতেই সেরা এই কিন্নরকণ্ঠী শিল্পী। বেসিক গান থেকে প্লে-ব্যাক–সমান সহজাত ও অনায়াস বিচরণ। বাংলার প্রায় সব নায়িকার লিপে তাঁর গান শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের। আরতি মুখোপাধ্যায়। আজ তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে কত স্মৃতি যে মনে পড়ছে !

বেশ কয়েক বছর মুম্বইয়ে থাকার পর কলকাতায় এসে থাকা শুরু করেছেন তিনি তখন। তাঁর দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাটে সে খবর পেয়ে অল্প অল্প করে জড়ো হতে শুরু করেছেন সংবাদ মাধ্যমের লোকজন। তবে, তাঁরা সকলেই তাঁর পূর্ব পরিচিত। আমি ওঁর কাছে একেবারেই অপরিচিতের দলে। অথচ, প্রথম যে সন্ধ্যায় ওঁর কাছে গেলাম, এক লহমায় এতটাই আপন করে নিলেন, মনে হলো কতকালের চেনা। আরতি মুখোপাধ্যায় এমনই একজন মানুষ। তিনি যত বড় শিল্পী তত বড় হৃদয়ের অধিকারী। সেদিন তাঁকে ‘দিদি’ ডেকে সম্বোধন করি। আজও সেই ডাক, সেই সম্পর্ক অক্ষুন্ন। আজও গলা শুনলেই,”অজন্তা, কেমন আছো?” এটা দিয়ে আমাদের বাক্যালাপ শুরু হয়।

মনে পড়ছে, একটি টিভি চ্যানেলের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম তাঁর কাছে। আমারই ভাবনায় প্রস্তুত সেই শোয়ের নাম ছিল ‘আমার গান আমার কথা’। এই শো-কে ঘিরে বাংলা সংগীত জগতের কিংবদন্তী শিল্পী থেকে তরুণ প্রজন্মের তারকা–অনেকেরই সংস্পর্শে আসার সুযোগ ঘটে। শিল্পীদের বাড়ি গিয়ে একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে কথা ও সেই অনুষঙ্গে গান নির্বাচন। হারমোনিয়াম বা তানপুরা বাজিয়ে নিজস্ব মেজাজে গান–সে এক একটি অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা ! সেই সন্ধ্যায় আরতিদির কাছে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সব অর্থেই ব্যতিক্রমী হয়ে রইলো। কত যে না বলা কথা জমেছিল অন্তরে তাঁর ! নির্ধারিত এক এপিসোডের পরিবর্তে দুটো এপিসোডে টেলিকাস্ট করতে হয়েছিল, আজও মনে আছে। অকপটে বলেছিলেন তাঁর যন্ত্রণা, বেদনার কথা। অত্যন্ত প্রতিভাবান গীতিকার সুবীর হাজরাকে বিয়ে করেন খুব অল্প বয়সে। সেই বিয়ে সুখের হয়নি। গানের মানুষ সুবীর আরতির গানের প্রতি আবেগ-ভালোবাসাকে মূল্য দেননি। আরতি যত সফল হয়েছেন, তত নিরাপত্তাবোধের অভাবে ভুগেছেন সুবীর ও আক্রমণ শানিয়েছেন আরতির বিরুদ্ধে।

সেইসব স্তর পার হয়ে একসময় মুম্বইতে সেটেলড হলেন আরতি। নতুনভাবে সংসার পাতলেন। জীবনকে সুন্দর করার চেষ্টায় গানের কেরিয়ারকে কিছুটা পাশে রেখে দ্বিতীয় স্বামী আর ছেলের প্রতি সম্পূর্ণ মনযোগ দেবার চেষ্টা করলেন তিনি। সাক্ষাৎকারে যখন এসব বলছেন, তখন তিনি নিছক পেশাদারী ও সুপ্রতিষ্ঠিত এক বরেণ্য সংগীতশিল্পী নন, একজন ঘরোয়া নারী। ঘরোয়া সুখ-দুঃখের পরোয়া যিনি করেন, আমার-আপনার মতোই। ছেলে সোহম মায়ের সাংগীতিক প্রতিভা, বোধ ও চেতনা পেয়েছে–এটা বহু অপ্রাপ্তির মাঝে প্রাপ্তি তাঁর। তবে, গান নয়, সোহমের প্রতিভা বিকশিত বিভিন্ন যন্ত্র-সংগীতে। মনে পড়ছে কলকাতার পার্ক হোটেলে নিজের জন্মদিন পালনে ছোট্ট সোহমের সঙ্গে যখন আলাপ করাচ্ছেন আমায়, তখন কী অপূর্ব এক আলো আরতিদির চোখে।

যখন উনি মুম্বইতে, তখনও কলকাতা-মুম্বই যাতায়াত করে বাংলা গান গাইছেন। আর কী সব গান ! বরাবরের ভার্সেটাইল শিল্পী আরতি মুখোপাধ্যায়ের গান মানেই তো শ্রোতার জন্য বিচিত্রগামী হওয়ার সুযোগ! অসংখ্য মঞ্চ অনুষ্ঠান, রেকর্ড, প্লেব্যাক ইত্যাদি। শুধু বাংলা বা হিন্দি নয়, দেশের আরও অনেকগুলি ভাষায় গাইতে পারেন তিনি। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, ঠুংরি, রাগ সংগীত–তাঁর ভান্ডারে উপাচারের অভাব নেই। ভেবেছিলেন সেইসব নিয়েই আবার এই বাংলায় জমিয়ে তুলবেন তাঁর সংগীতের আসর ও বাসর।

কিন্তু তাঁর ভাবনা মূল্য পেলো না। মাঝে অনেকটা সময় চলে গেছে। এখানে তখন বহু শিল্পী–নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে। প্রতিযোগিতা তীব্র। আর প্রতিযোগিতা মানেই ক্ষুদ্র রাজনীতি। স্বাভাবিক নিয়মেই তার শিকার হলেন আরতি। অন্যদিকে তাঁর সময়ের গীতিকার-সুরকাররাও অনেকেই নেই। যাঁরা আছেন, তাঁরাও আর সেভাবে কাজ করছেন না। আরতির মতো স্পর্শকাতর শিল্পী ক্ষতবিক্ষত হবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক ! তবে, শ্রোতারা ছাড়েনি তাঁকে। যতটুকু মঞ্চ অনুষ্ঠানে পারফর্ম করার সুযোগ পেয়েছেন, নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। শ্রোতারাও বিপুলসংখ্যক সাড়া দিয়েছে। 

সম্প্রতি এই প্রতিবেদককে কিংবদন্তী গীতিকার-সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ওঁর সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, “আরতিকে আমি শুধু আশা ভোঁসলের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। তেমনই শক্তিশালী ও ভার্সেটাইল। একই সঙ্গে একজন শিল্পী কী করে ‘আমায় তোমার মতো পাষান করে গড়ো’ আর ‘যা যা বেহায়া পাখি যা না’ গাইতে পারেন–ভাবলে বিস্ময়কর লাগে !” পাঠকের স্মরণে থাকবে, প্রথমটি ‘তিলোত্তমা’, দ্বিতীয়টি ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবির গান। এরই সঙ্গে মনে পড়ছে ‘দেয়া নেয়া’ ছবির ‘মাধবী মধুপে হলো মিতালি’–কী মিষ্টি একটি গান। অথবা অপর্ণা সেনের লিপে ‘আমি মিস ক্যালকাটা’–’বসন্ত বিলাপ’ ছবির এই গানটির দৃশ্যায়নে মিলেমিশে গেছিল আরতির কন্ঠ। অন্যদিকে মুম্বইতে ‘তপস্যা’, ‘গীত গাতা চল’ বা ‘মাসুম’ ছবিতে গাওয়া আরতি মুখোপাধ্যায়ের অলটাইম হিট গানগুলি প্রবলভাবে বাংলা ও মুম্বইতে স্বীকৃত।

তাঁর মুম্বইয়ের যাত্রাপথও কুসুম বিছানো ছিল না। পারিবারিক কিছু বিধিনিষেধ সেখানেও ছিল। অন্যদিকে সেখানেও পেশাদারী জগতের ঈর্ষা, প্রতিযোগিতা, পিছন থেকে ছুরি মারার ঘটনাক্রম ছিল। অসীম মাত্রার এক সংগীত প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন আরতি মুখোপাধ্যায়। এক একজন দিকপাল গুরুর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আজ এত বছর বয়সেও রেওয়াজ ছাড়েননি। গানের প্রতি নিবেদন ও ভালবাসায় আজও কোনও খাদ নেই তাঁর। প্রতিকূলতা তাঁর মতো অন্তহীন প্রতিভার অধিকারী শিল্পীকে কতদূর আর আটকাতে পারে ? পারে না বলেই আজ তিনি জীবন্ত কিংবদন্তী। বাংলা-মুম্বই মিলিয়ে আরতি মুখোপাধ্যায় একজনই আছেন।