কেমন আছো কাশ্মীর?
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম।
নিবিড়, নান্দনিক নিসর্গের কাশ্মীর বরাবর পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রে। ভূস্বর্গ কাশ্মীর নিয়ে আমাদের যত অহংকার, তত যন্ত্রনা। স্বাধীনতার পর কেটে গেল এতগুলি বছর, বদলালো না কাশ্মীরের ভাগ্য। সুন্দর প্রকৃতির মাঝে কেমন আছেন এখানকার মানুষ ? তাঁদের যাপনও কী এমন সুন্দর ? পড়ছেন ছন্দা চট্টোপাধ্যায়ের কলমে। ধারাবাহিক রচনার দ্বিতীয় পর্ব আজ।
বর্ণময় শ্রীনগর
ভূস্বর্গে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক ঘন্টা অতিবাহিত। শ্রীনগরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ডাল লেকের কথা আগের সপ্তাহে বলেছি। এটাও বলেছি, হোটেলের অবস্থানের কারণে, ডাল লেক একেবারে পা বাড়ালেই। সেই নান্দনিক প্রাপ্তি নিয়েই কাল ঘুমের দেশে গেছি। পরদিন সকালে উঠে স্নান, ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি হয়ে সকাল ন’টায় আমরা হোটেল থেকে বের হলাম। কাল রাতে অনেক টুরিস্ট এসে গেছে। সেইজন্য আজ বুফে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা। গতকাল ডিনারের মেনু এবং রান্না খেয়ে বুঝে গেছিলাম, কাশ্মীরে এসে মনের সুখে খাওয়াদাওয়া করতে পারবে ভোজনরসিক বাঙালি। কাশ্মীরি ঘরানার মোগলাই আইটেম তো আছেই। তাছাড়াও নর্থ-ইন্ডিয়ান, ভেজ-ননভেজ সবরকম বাঙালি রসনা তৃপ্তি করার মতো খাবারের আদর্শ জায়গা এটা। ব্রেকফাস্টে পেট পুরে আলু-পরোটা, সবজি, টক দই খেয়ে নিলাম, যাতে খিদের জন্য সাইট সিয়িংয়ে কাটছাট করতে না হয়।
হোটেলের বাইরে আসতেই ড্রাইভার একমুখ হাসি নিয়ে এগিয়ে আসতেই চিনে ফেললাম। আরে এর গাড়িতেই তো আমরা গতকাল এয়ারপোর্ট থেকে এসেছি। চেনা মুখ দেখে আমরাও খুশি হয়ে গেলাম। গাড়িতে ঢুকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি জানতেন আমরাই আপনার টুরিস্ট ? মৃদুহেসে ড্রাইভার বললো, না, না, জানতাম না মাডামজি। হোটেল থেকে কাল রাতে ফোন করে শুধু জানিয়েছে, ডিউটি আছে, সকাল নটায় আসতে হবে। দূর থেকে আপনাদের দেখেই চিনতে পেরেছি। খুবই খুশি হয়েছি।
জবাবে বলি, আমরাও খুব খুশি। তোমার নাম কি ?
লাজুক হেসে ড্রাইভার বলে, জি, আমার নাম মেহরাজ। কোথায় ঘুরতে যাবেন আজ ?
বললাম, আজ আমরা শঙ্করাচার্য টেম্পল, টিউলিপ গার্ডেন এগুলো দেখবো ভাবছিলাম।
ঠিক আছে, নো প্রবলেম। সবচেয়ে ওপরে আছে টেম্পল। তাহলে প্রথমে মন্দির দিয়ে শুরু করে নামতে নামতে পরপর পরীমহল, চশমাশাহী বাগ, টিউলিপ গার্ডেন…!
ওকে থামিয়ে বললাম, তুমি যা ঠিক মনে করবে, তাই হবে। আজ তুমিই আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড। যেখানে নিয়ে যাবে, চলে যাব।
খুশি খুশি গলায় ‘ওকে মাডামজি’ বলে গাড়ি স্টার্ট দিল মেহরাজ।
শুরু হলো যাত্রা। শঙ্করাচার্য পাহাড়ে ওঠার মুখে ডাল গেট-এ বেশ কড়া সিকিউরিটি চেকিং-এর পরে গাড়ি ওপরে উঠতে শুরু করল। পাহাড়ি পথের দুধারে ঘন সবুজবন। ডান দিকে গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সুন্দরী ডাল লেক। মন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছনোর কিছু আগে গাড়ি থামলো। এরপর হাঁটাপথ। মন্দিরে ওঠার আগে আর এক দফা সিকিউরিটি চেক। ক্যামেরা, মোবাইল কিছুই এলাউড নয়। শুধু পার্স নিয়ে ওপরে ওঠা যাবে। ২৫৩টা সিঁড়ি ভেঙে শংকরাচার্য শিবমন্দির। তবে সিঁড়ি খুব ভালো। ওঠার কোনও সমস্যা নেই। বড়ো বড়ো ল্যান্ডিং-এ বসারও ভালো ব্যবস্থা আছে। এছাড়া চতুর্দিকে প্রকৃতি এমন পসরা সাজিয়ে রেখেছে, চলতে চলতে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতেও ভালো লাগে।
৬০৭৭ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় সুদৃশ্য শিবমন্দির। শিবলিঙ্গটিও আকারে বেশ বড়ো। মন্দির চত্বর থেকে অনবদ্য কাশ্মীর উপত্যকার দৃশ্য। ডানদিক ঘিরে বিশাল ডাল লেক। আর বাঁদিকে বাঁকা ধারালো তলোয়ারের মত চকচক করছে ঝিলম নদী। বোঝা গেল সিকিউরিটির এত কড়াকড়ি কেন! এর আগে অনেক পাহাড়ী শহর দেখার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু এমন অভিনব ভিউ কোথাও পাইনি। শ্রীনগর নামের সার্থকতাও উপলব্ধি করলাম। আচার্য শংকরাচার্যর নামে মন্দিরের নামকরণ হলেও এই শিব মন্দির তিনি প্রতিষ্ঠা করেননি। শোনা যায় মৌর্য সম্রাট অশোকের পুত্র জালুকা খ্রীষ্টপূর্ব ২০০-তে এই শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই পাহাড়ের আগের নাম ছিল তখত-ই-সুলেমান। শংকরাচার্য সন্ন্যাস নেবার পরে ভারত পর্যটনে বেরিয়ে কাশ্মীরের এই পাহাড়ে এসে দীর্ঘদিন তপস্যা করেছিলেন। সেই থেকে এই পাহাড়ের নাম হয় শংকরাচার্য পাহাড়। এই শিবমন্দিরকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করা হয়। মহাশিবরাত্রিতে আলোর মালায় সেজে ওঠে শংকরাচার্য পাহাড়। আধঘন্টা মন্দির চত্বরে কাটিয়ে নেমে এলাম আমরা। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম পরীমহল। মোগল সম্রাট শাজাহানের ছেলে দারার প্রমোদ নিকেতন ছিল পরীমহল। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, তেমন আহামরি কিছু নয়। ছোটোখাটো একটা বাগান আছে। তবে এখান থেকেও অনবদ্য ডাল লেকের শোভা।
পরীমহল থেকে পাহাড়ি পথে কিছুটা নেমেই পৌঁছে গেলাম চশমাশাহী বাগ। টিকিট কেটে গেটে ঢোকার সময় বেশ ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। হইচই করছে স্কুলের ইউনিফর্ম পরা একদল ছোটো বাচ্চা। বারবার লাইন ভাঙছে আর টিচারের কাছে বকুনি খেয়ে আবার লাইনে দাঁড়াচ্ছে। ভেতরে ঢুকতেই দেখি সামনেই দুটি ধারায় নেমে আসছে পাহাড়ি ঝর্ণা। ওই ঝর্ণাধারাকে ঘিরে পাহাড়ের তিনধাপে চিনার ঝাউ সিডার ইত্যাদি নানারকম গাছে সুসজ্জিত দারুন দৃষ্টিনন্দন বাগান। কিছুক্ষণ ওখানে ঘোরাঘুরি করে ছবি তুলে আমরা যখন ওখান থেকে বের হলাম, ছোটদের ছুটোছুটি, হুল্লোড় তখনও চলছে।
এরপরে টিউলিপ গার্ডেন। প্রথমে সিরাজ বাগ নাম থাকলেও, ২০০৮ সালে নতুন নামকরণ হয় –ইন্দিরাগান্ধী মেমোরিয়াল টিউলিপ গার্ডেন। টিউলিপ চাষের পথপ্রদর্শক দেশ অবশ্য এশিয়ার তুরস্ক বা টার্কি। এরপরে ইউরোপের হল্যান্ডে শুরু হয় টিউলিপ চাষ। এখন অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইউ এস ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে টিউলিপ চাষ হলেও পৃথিবীজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে ইউরোপের নেদারল্যান্ডস (হল্যান্ড) এবং ভারতের শ্রীনগরের টিউলিপ গার্ডেন। প্রাথমিকভাবে হলান্ড থেকেই টিউলিপ আনা হয়েছিল শ্রীনগরে। ভারতের উত্তরাখন্ডের মুন্সিয়ারিতেও টিউলিপ গার্ডেন আছে। হল্যান্ড এবং শ্রীনগরে একই সময়ে টিউলিপ ফোটে। তিন সপ্তাহ থেকে বড়জোর একমাস টিউলিপের পরমায়ু।
শ্রীনগরে মার্চমাসের শেষভাগ থেকে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত টিউলিপ গার্ডেন দেখার সুযোগ। আমরা না জেনেও একদম সঠিক সময়ে এসেছি ভেবে খুশি হয়ে গেলাম। ভেতরে ঢুকে রঙের সমারোহ দেখে রীতিমতো হতবাক অবস্থা ! পাহাড়ের কোল জুড়ে সাতটি ধাপে থরে থরে সাজানো বিচিত্র বর্ণের টিউলিপ–এককথায় অনির্বচনীয় ! এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, যতদূর দৃষ্টি যায়, লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী, বেগুনি নানান রঙের টিউলিপ এমনভাবে হাওয়ায় দুলছে, মনে হচ্ছে খিলখিল করে হাসছে। আমরা নেশাগ্রস্তর মত ফটাফট ছবি তুলে চলেছি। একসময় হুস ফিরল, এবার ফিরতে হবে। খুব খিদেও পেয়েছে। আপাতত লাঞ্চ। আমাদের কথামতো মিনিট দশেকের মধ্যে একটা ভালো রেঁস্তোরায় নিয়ে গেল মেহরাজ। মেহরাজকে খাবার জন্য ভেতরে আসতে বলা হলো। ও মৃদুহেসে বলল, আমি সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি। দুপুরে চা ছাড়া কিছু খাই না। আমরা চায়ের জন্য টাকা অফার করতেই, ও বিনীতভাবে বললো, না না, আপনারা আমাদের মেহমান। আজ প্রথম দিন আমারই খাওয়ানো উচিত। আমি টাকা নিতে পারব না মাডামজি। মাফ করে দিন। আপনারা খেয়ে আসুন। বলে, বিনম্র হেসে, গাড়িতে গিয়ে বসলো। আমরা রেঁস্তোরার ভেতরে ঢুকে গেলাম।
(চলবে )
♦️ ছবি : লেখক