কেমন আছো কাশ্মীর?
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম।
নিবিড়, নান্দনিক নিসর্গের কাশ্মীর বরাবর পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রে। ভূস্বর্গ কাশ্মীর নিয়ে আমাদের যত অহংকার, তত যন্ত্রনা। স্বাধীনতার পর কেটে গেল এতগুলি বছর, বদলালো না কাশ্মীরের ভাগ্য। সুন্দর প্রকৃতির মাঝে কেমন আছেন এখানকার মানুষ ? তাঁদের যাপনও কী এমন সুন্দর ? পড়ছেন ছন্দা চট্টোপাধ্যায়ের কলমে। ধারাবাহিক রচনার সপ্তম পর্ব আজ।
সোনমার্গের অপরূপ নিসর্গকে বিদায় জানিয়ে চারটে নাগাদ আমরা গাড়িতে উঠেছিলাম আমরা। শ্রীনগরের কাছাকাছি যখন পৌঁছলাম, তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ছ’টা ছুঁই ছুঁই। সূর্যাস্ত হতে আরও অন্তত দেড় ঘন্টা বাকি। মেহরাজের সঙ্গে কথা বলে আমরা প্রথমে নিশাতবাগ তারপরে শালিমার বাগ ঘুরে হরি পর্বতে গেলাম। সুরক্ষার কারণে হরি পর্বতের ওপরে ফোর্ট তৈরীর পরিকল্পনা করেন মুঘলসম্রাট আকবর। তাঁর আমলে দুর্গ তৈরির কাজ শুরু, শেষ হয়েছে দুরানী সাম্রাজ্য চলাকালীন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দুর্গের একই চত্বরে মন্দির, গুরুদোয়ারা এবং দরগার সহাবস্থান। মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেবী জগদম্বা সারিকা –পার্বতীর অন্যতম রূপ। আর গুরুদোয়ারা তৈরি করা হয়েছিল গুরু নানকের স্মৃতিতে। জানা যায় কাশ্মীর ভ্রমণকালে গুরু নানক কয়েকদিন বাস করেছিলেল হরি পর্বতে।
সুন্দর বাগিচায় সাজানো দুর্গ-চত্বরে ছোট একটা মার্কেটও আছে। ফোর্টের বেশিরভাগ অংশ মিলিটারির দখলে। সন্ধের পরে আলোকমালায় সুসজ্জিত হরি পর্বত এককথায় অনন্য। পর্বতের ওপর থেকে চমৎকার ডাল লেকের দৃশ্য। ফেরার পথে মেহরাজ বলল, মাডামজি, শ্রীনগরের একটা পুরনো মসজিদে আপনাদের নিয়ে যাব এখন। বেশিরভাগ টুরিস্ট এই মসজিদের খবর জানে না। আমরা সঙ্গে সঙ্গে রাজি। দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম পুরনো শ্রীনগরের জামিয়া মসজিদ চত্বরে। চতুর্দশ শতকে তৈরি জামিয়া মসজিদ বয়সের ভারে জীর্ণ হলেও, প্রথমেই নজর কাড়লো পারসিয়ান কারুকার্য-খচিত অসাধারণ প্রবেশ দ্বার। ভেতরে ঢুকেও দেখলাম সমবেত নমাজের দারুণ ব্যবস্থা। চতুস্কোণ চত্বরে একটা সুন্দর বাগানও আছে। জামিয়া মসজিদ শুধু ধর্মীয় স্থান নয়, বহু রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী।
কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমরা গাড়িতে উঠলাম। শ্রীনগরে এসে একবার বাজারে যাব না, তাও কি হয় ? এখানকার সবচেয়ে বড় মার্কেটে নিয়ে যেতে বললাম মেহরাজকে। এখানে ছোটো-বড় অনেক মার্কেট আছে। তার মধ্যে লালচক মার্কেট সবচেয়ে জমজমাট। শুধু অনির্বচনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, কাশ্মীরের বিশেষ ঐতিহ্য তার নিজস্ব শিল্পকলায়, বিশেষত হস্তশিল্প এবং সুচীশিল্পে। বলার অপেক্ষা রাখে না কাশ্মীরি পোশাক, শাল, পশমিনা, কার্পেট, হান্ডিক্র্যাফটস, গয়না ইত্যাদি গুণে এবং মানে আন্তর্জাতিক বাজারেও দারুণ জনপ্রিয়। শ্রীনগরে বাজার করার অভিজ্ঞতা থেকে জানাই, দালাল থেকে সাবধান হওয়া দরকার। গাড়ির ড্রাইভারও দালালির কাজ করতে পারে। সেইজন্য পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ সরকারী বিপণি কাশ্মীর এম্পোরিয়ামে বাজার করা।
খুব ছিমছাম পরিচ্ছন্ন শহর শ্রীনগর। অতীতে নাকি নাম ছিল সূর্যনগর। অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য পরবর্তী সময়ে নামকরণ হয় –শ্রীনগর। এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা হিন্দু রাজা প্রবরসেনের নাম অনুসারে আগে শ্রীনগরকে প্রবরপুরাও বলা হতো। তারপরে একে একে এসেছে মুসলিম, মুঘল, শিখ আরও অনেকে। সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে আমরা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই অল্পস্বল্প কেনাকাটা করে হোটেলে ফিরে এলাম। শ্রীনগরে সেদিনই শেষ রাত্রিবাস। পরদিন সকালে শ্রীনগরকে বিদায় জানিয়ে রওনা দেব পহেলগাঁওয়ের উদ্দেশে। ঘুমোতে যাবার আগে ব্যালকনি থেকে শেষবারের মত দেখে নিলাম আলোকিত হরি পর্বত, ডাল লেক এবং আলো-আঁধারির মায়াজালে মোড়া শহর শ্রীনগর।
শ্রীনগর থেকে পহেলগাঁওয়ের দূরত্ব প্রায় ৯০কিমি। গাড়িতে সময় লাগে ঘন্টাতিনেক। উচ্চতা ২১৯৫ মি। সকালে রওনা দিয়ে ইতিমধ্যেই শহর শ্রীনগর ছাড়িয়ে সবুজের সমারোহে পৌঁছে গেছি আমরা। শ্রীনগর থেকেই ডানদিকে আমাদের সঙ্গী হয়েছে ঝিলম নদী। দূর-দূরান্তরে অর্ধবৃত্তাকারে সাজানো পাহাড়ের সারি। মাথায় রুপোলি মুকুট। দুপাশে পাইন-চিনার-দেবদারু দিয়ে সুসজ্জিত পথ। যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে ছোট ছোট জনপদ। একের পর এক পেরিয়ে যাচ্ছে আখরোট বাগান, আপেল বাগান। আপেল বাগানে আপেল ঝুলছে এর আগে দেখেছি। কিন্তু আপেলগাছে এত সুন্দর ফুল ফোটে আগে দেখিনি। সব গাছের মাথা সাদা ফুলে ঢাকা। মেহরাজের কাছে জানা গেল, আরও কিছুদূর ঝিলাম আমাদের সঙ্গে যাবে। তারপরে লিডারের সঙ্গে মিশে যাবে। দুই নদীর মিলনের পরে বাঁদিকে আমাদের সঙ্গী হবে লিডার।
চলতে চলতে হঠাৎ নজরে এল দুপাশে সোনালি ক্ষেত। মেহরাজ বলল এগুলো কেসরের খেত। এখানে খুব ভালো কোয়ালিটির কেসর আর জাফরান পাওয়া যায়। সোনালী-হলুদে মেশানো কেসরফুলে ভরা খেত —অনুপম দৃশ্য ! জাফরানও খুব দামী জিনিস। মনে পড়ে গেল, পৃথিবীর দুই জায়গায় উৎকৃষ্ট মানের জাফরান চাষ হয়। ইউরোপের স্পেনে আর ভারতবর্ষের কাশ্মীরে। আরও কিছুদূর এগনোর পরে দেখা গেল থরেথরে সাজানো ক্রিকেট ব্যাটের গুদাম। ফিনিশিং -এর কাজ চলছে। মেহরাজ বললো, উইলো কাঠের লোকাল প্রোডাক্ট এই ব্যাট দামেও সস্তা। চলতে চলতে আবার একটা ছোট জনপদ। তবে লোকজন দোকানপাটের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। রাস্তাটাও বেশ ঘিঞ্জি। তারই মধ্যে মেহরাজ বাঁদিকে গাড়ি থামিয়ে বললো, এটা পুরনো শহর অবন্তীপুর। বাঁদিকে শিবজি-বিষ্ণুজির মন্দির।
আমরা নেমে পড়লাম। গেটের মুখে পৌঁছে বোঝা গেল খুব পুরনো মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ। পাঁচিল দিয়ে যত্ন করে ঘিরে রাখা হয়েছে। এখন হেরিটেজ প্রপার্টি হিসেবে আরকিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তদারকিতে আছে। ভেতরে ঢুকতেই মাথায় পাগড়ি-বাঁধা এক শিখ ভদ্রলোক হাসিমুখে নমস্কার করে হিন্দিতে বললেন, নমস্কার। আমি গাইড। আপনারা চাইলে আমি আপনাদের এই মন্দির ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিতে পারি। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি অরিজিনালি কাশ্মীরের লোক, না বাইরে থেকে এসেছেন ? একমুখ হেসে ভদ্রলোক বললেন, আমি অরিজিনালি কাশ্মীরের লোক। এখানে আমাদের অনেক লোকের বাস। চলুন, বলে ভদ্রলোক এগিয়ে গেলেন।
জানা গেল অবন্তীস্বামী বিষ্ণুমন্দির এবং অবন্তীশ্বর শিবমন্দির–এই দুটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন উৎকল বংশের প্রথম রাজা অবন্তী বর্মা ৮৫৫-৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। অনেকের মতে মন্দিরগুলো তৈরি করেছিল পাণ্ডবরা। যাই হোক মন্দিরের আর্কিটেকচার এবং কারুকাজ যে কত সুন্দর ছিল, তা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকেও বোঝা যায়। সেইসময় কাশ্মীরের রাজধানীও ছিল অবন্তীপুর। ঘুরতে ঘুরতে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিলো চত্বরটা। মনে পড়ে গেল,এখানে শুটিং হয়েছিল একটি বিখ্যাত সিনেমার জনপ্রিয় গানের দৃশ্য। সিনেমার নাম আঁধি, পরিচালনায় গুলজার। অভিনয়ে সঞ্জীবকুমার-সুচিত্রাসেন। হঠাৎ নজরে পড়লো, মন্দিরের বাঁদিকে প্রায় গায়ে গায়ে লাগা একটা মসজিদ। গাইড বললেন, হ্যাঁ ম্যাডাম, মসজিদই !
মন্দির -মসজিদের পাশাপাশি অবস্থান দেখে বেশ ভালো লাগলো, হোক না ধ্বংসাবশেষ, তবুও। গাইডকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম। বাঁদিকে বড়োবড়ো বোল্ডার, নুড়ি-পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে কলকলিয়ে বয়ে চলেছে লিডার নদী। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে চারিদিকে বরফ-ঢাকা শৈলশিখর। মেহরাজ জানালো, আমরা পৌঁছে গেছি পহেলগাঁও। জম্মু-কাশ্মীর ট্যুরিজিমের কটেজ বুক করা ছিল আমাদের। কিন্তু বেশ খিদে পেয়েছিলো বলে আগে লাঞ্চ সেরে কটেজে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। (চলবে)
ছবি : লেখক