Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

গন্তব্য ঝাড়গ্রাম, মল্লরাজার দেশে

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। খুব দূরে নয়, ঘরের বাইরে পা বাড়ালেই ইতিহাসের দরজায়। আমরা খবর রাখি না। অথচ, এই রাজ্যের সীমার মধ্যেই রয়েছে সেই গৌরবের ইতিহাস। লিখেছেন লিপি চক্রবর্তী

ষোলো শতকের শেষ দিক, সালটা ১৫৯২, মোঘল সম্রাট আকবর তাঁর দোর্দণ্ড প্রতাপ সেনানায়ক মান সিংকে নির্দেশ দিলেন বাংলার পশ্চিমে যে জঙ্গলখন্ড আছে, যেখানে স্থানীয় ভূমিজ উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের রাজত্ব, সেই অঞ্চল জয় করতে হবে। এই রাজারা ‘মল্লরাজা’ নামে পরিচিত ছিলেন। মান সিংহের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত কর্মচারী রাজপুত যোদ্ধা সর্বেশ্বর সিংহ বীর বিক্রমে ঢুকে পড়লেন জঙ্গলখণ্ডে আর একের পর এক রাজ্য জয় করে ওই অঞ্চলে মল্লদেব উপাধি নিয়ে রাজা হয়ে বসলেন। মোঘলদের অধীনস্থ সামন্ত রাজা হিসেবে সর্বেশ্বর সিংহ ঝাড়গ্রামে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। ঝাড়গ্রাম কথাটির অর্থ ‘অরণ্যে ঘেরা গ্রাম’। বিষ্ণুপুরের রাজার সঙ্গে মিলে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রবল যুদ্ধ করেন ঝাড়গ্রামের রাজা, ইতিহাসের বিখ্যাত চুয়াড় বিদ্রোহ নামে যা পরিচিত।

আমাদের এবারের গন্তব্য সেই ঝাড়গ্রাম। ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির এক অংশে আছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন দপ্তরের অতিথিশালা। দু’দিনের জন্য ওখানেই থাকার বুকিং ছিল আমাদের। কলকাতা থেকে বেরিয়েছিলাম সাড়ে ছ’টা নাগাদ। দশটার আগেই পৌঁছনো উচিত ছিল, রাস্তা এত সুন্দর। কিন্তু থামতে থামতে আর উদরে কিছু চালান করতে করতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল। শীতের শুরু হলেও রোদের তেজ যথেষ্ট। তার ওপর রাজবাড়ির ওই বিশাল উঁচু উঁচু ছাদওলা খোলামেলা ঘর। এসির প্রয়োজনই হয় না। চা সহযোগে আড্ডায় জমে গেলাম। দুপুরে ভূরিভোজের পর জমিয়ে একটা ঘুমও দেওয়া গেল।

বিকেলে রাজবাড়ির মধ্যে ঘুরেফিরে বেরিয়ে এলাম চৌহদ্দির বাইরে। মূল রাজবাড়িতে অনুমতি ছাড়া ঢোকা যায় না। কারণ মল্লদেব পরিবারের মানুষরা এখনও এখানেই বাস করেন। ট্রাইবাল আর্টের একটা প্রদর্শশালা আছে একটু দূরে। সেটা ঘুরে দেখতে দেখতে সন্ধে ঘনিয়ে এলো। এবার চললাম হাটের দিকে। সুতির মেখলা জাতীয় পোশাক কিনে ফেললাম সকলে মিলে। স্থানীয় আদিবাসীদের বোনা জিনিসগুলো খুব সুন্দর ও রঙিন। রাজবাড়িতে ফিরে এসে মন্দিরে আরতি দেখে, আবার বাগানে হাঁটতে বের হলাম। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। সাজানো-গোছানো, কেয়ারি করা বাগানে অজস্র ফুলের গাছ, বিশাল বিশাল দরজা। দরজা না বলে অবশ্য তোরণ বলাই ভালো। দুধসাদা রঙের অতিথিশালা। বিশাল উঁচু প্রাচীর ঘেরা রাজবাড়ি। সব মিলিয়ে কিছুটা অচেনা এই পরিবেশ বেশ ভালো লাগছিল।

পরের দিন বেড়ানোর জন্য যাত্রা শুরু সেই ভোরবেলাতেই। যাব কনকদুর্গা মন্দির। পৌঁছতে হয়ে গেল সকাল সাড়ে নটা। চিলকিগড় রাজাদের তৈরি এই মন্দিরে আসার সময় বেশ অনেকটা রাস্তা জঙ্গল পেরিয়ে আসতে হয়েছে। পথে যেখানে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে উঠতে হলো, সেখান থেকে মানুষের বানানো জঙ্গল আর হাতির সারি পেরোনোর ছোট্ট রাস্তাটুকু হাঁটতে ভালোই লাগল। শুনেছি, এখানে অজস্র অবধি গাছ আছে। প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো এই মন্দিরে নাকি একসময় নরবলি হতো। এখন সেসবের প্রশ্ন না উঠলেও, পশুবলি প্রথা অব্যাহত আছে। অশ্বরোহিনী চারহাতের মায়ের মূর্তিতে লোকশিল্পের প্রভাব স্পষ্ট।

মায়ের পুজো দিয়ে বেরিয়ে এক টিয়াপাখির পাল্লায় পড়লাম। তার মালিক বলল, ও খুব ভালো। উড়েও যায় না। কাউকে বিরক্তও করে না। আদিখ্যেতা করে আমি ছেলেটির হাত থেকে নিজের হাতে নিলাম তাকে। আর সে আমার হাত বেয়ে উঠে কানে ঠোক্কর দিতে লাগল, সম্ভবত কানের দুলটিকে কোনও ফল ভেবে। এমনিতে এখানে বানর দলের খেলাধুলোর প্রাবল্যর জন্য দর্শনার্থীরা একটু বিব্রতই থাকে। কনকদুর্গা মন্দিরের একপাশ ঘিরে রেখে পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ডুলুং নদী। বহু পুরোনো কনকদুর্গা মন্দিরটি এখনও রয়েছে ডুলুংয়ে নামার সিঁড়ির মুখে ডান দিকে। সিঁড়ি ধরে নেমে একেবারে নদীর কাছে জল ছোঁয়ার দূরত্বে পৌঁছে যাওয়া যায়।

বড় রাস্তায় বেরিয়ে এসে ডুলুং নদীর ওপর সেতু পেরিয়ে একটু এগোলেই চিলকিগড় রাজবাড়ি। রাজদর্শন না হলেও রাজগৃহ আর মন্দির দর্শন হলো। রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে বাঁ হাতের পথ চলে গিয়েছে ঘাগড়া জলপ্রপাতের দিকে। রাস্তা যত নির্জন, ঝর্নার নির্জনতা তার থেকেও বেশি। তারাফেনি নামের এক ছোট্ট নদী, শতাব্দী-প্রাচীন পাথরে পাথরে ঠোক্কর লেগে এক নির্জন ঝর্না হয়ে বয়ে চলেছে গভীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। স্বচ্ছ জলের নিচে নুড়ি পাথর আর ছোট ছোট মাছের ঝাঁক বেঁধে চলা। শীতল জলে পা ডুবিয়ে পথের শ্রান্তি কিছুটা কাটল। ঘাগড়া জলপ্রপাত থেকে সন্ধে নাগাদ ফিরে এলাম ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে। সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে বেশ ক্লান্ত লাগছিল। তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে রাজকীয় বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।

পরের দিন বের হতে একটু বেলা হয়ে গেল। প্রথমে যাব ধাঙ্গিকুসুম। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। পাহাড়ের উচ্চতা পেরিয়ে প্রয়োজন ছাড়া কেউই বোধহয় এই গ্রামে যেত না, পর্যটক তো নয়ই। এই গ্রামে আছে নাকি এক অপূর্ব ঝর্না। এখন পর্যটনের উদ্দেশ্যেই পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি হয়েছে। গ্রাম পর্যন্ত গাড়ি যায়। ‘হদহদি’ নামের সেই ঝর্নার কাছে যেতে অবশ্য পা-গাড়িই ভরসা। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাথুরে রাস্তা। শেষের দিকে আর রাস্তার চিহ্ন নেই। পায়ের নিচে নরম ভেজা পাতার রাশি। সেই প্রপাতের কাছে পৌঁছে শুধু নির্বাক হয়ে তাকিয়ে দেখা, চোখের পলক না ফেলে। বেশি মানুষের পদচিহ্ন পড়ে না বলে হদহদি যেন একটু বেশিই জংলি। স্থানীয় একজন বললেন, এই সময় জল অনেক কম আছে ঝর্নায়। বর্ষায় ফুলে ফেঁপে ওঠে। তখন তার রূপ দেখার মতো বটে ! ধাঙ্গিকুসুম গ্রামের প্রায় সবাই পাথরের জিনিস তৈরি করেন। একমাত্র না হলেও, এটা তাঁদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জীবিকা বটে।

Img 20230919 Wa0054
গন্তব্য ঝাড়গ্রাম, মল্লরাজার দেশে 18

ফেরার পথে রাস্তার উল্টোদিকে বেশ খানিকটা টিলা আর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দৌড় কেটকি লেকের উদ্দেশে। জঙ্গল ঘেরা এক নির্জন নিস্তব্ধ হ্রদ। নীল জলের ধারে দাঁড়ালে, সব ক্লান্তি উধাও। শুনলাম, কয়েকদিন আগেই নাকি এখানে লেপার্ড দেখা গিয়েছে। যদিও আমরা একটা খরগোশও দেখিনি। তবু, স্থানমাহাত্ম্য এমনই যে, চারদিকের উঁচু উঁচু গাছ আর ঘন জঙ্গল দেখে মনে হলো, ‘তার’ দেখা পাওয়া অসম্ভব নয়। ফেরার পথে বেলিয়াবেড়া রাজবাড়ি দেখে নেওয়া হলো। ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির সঙ্গে এদের সম্পর্ক আছে, এমনই বললেন স্থানীয় মানুষজন।

Img 20230919 Wa0058
গন্তব্য ঝাড়গ্রাম, মল্লরাজার দেশে 19

মোটামুটি তিনটি রাত লাগে এই ট্রিপটার জন্য। চতুর্থ দিন সকালে ফেরা। যাঁরা আগ্রহী, তাঁদের জানাই–কলকাতা থেকে গাড়িতে সরাসরি ঝাড়গ্রাম যেতে কমবেশি চারঘণ্টার মতো সময় লাগে। এছাড়া হাওড়া থেকে এক্সপ্রেস ট্রেনে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। স্টেশন থেকে টোটো পাওয়া যায় রাজবাড়ি যেতে। গাড়ি রাখার জায়গা আছে। গাড়ির চালকের থাকার জন্য ঘর পাওয়া যায়। পর্যটন দপ্তরে অতিথি নিবাস বুকিং করার সময় চালকের থাকার বুকিং করে নিলে ভালো হয়। ভিতরে রেস্তোরাঁ আছে, খাবারের জন্য সমস্যা হবে না। খরচাপাতি আয়ত্তের মধ্যেই। বুকিং ও অন্যান্য তথ্য জানবার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পর্যটন নিগমের অফিসে। অনলাইন বুকিংও হয়।

◾ফোন:

6294024319 (Reservation)

6294024319 (Manager)

***ছবি : লেখক