Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

ভালো থেকো ডলফিন

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। আজ হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা জানিয়েছেন কেকা চৌধুরী। আমাদের এই সিরিজে তাজপুর নিয়ে আগেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তবে, এ একেবারে অন্যরকম এক  তাজপুরকে আবিষ্কার !

আজ যে লেখাটি লিখছি সেটা শুধুমাত্র বেড়াতে যাওয়ার বর্ণনা নয়। এটা দাদু, দিদা, নাতি, নাতনি আর একটি অসহায় ডলফিনের মানবিক গল্প।

গরমের ছুটিতে নাতি-নাতনির বায়নাতে দাদু-দিদা মানে আমি আর আমার স্বামী মানস ভাবতে বসলাম ওদের নিয়ে তিন-চারদিনের জন্য কোথায় যাওয়া যায় ! মে-জুন মাসে বেড়াবার জন্য আদর্শ স্থান সমুদ্র সৈকত। সমুদ্রের কথা শুনেই তো বুবুই-গিনি (আমাদের নাতি-নাতনি) খুব উত্তেজিত। সমুদ্র স্নানের অলীক হাতছানি ছোট-বড় সবার কাছেই রোমাঞ্চকর। আমাদের ইচ্ছা ছিল, পরিচিত মুখ আর পর্যটকদের ভিড় এড়িয়ে নির্জন সৈকতে কয়েকটি দিন নিজেদের মতো কাটানো। তাজপুরের সমুদ্র সৈকতের কথা শুনেছিলাম। নির্জন-শান্ত পরিবেশ। কলকাতা থেকে মাত্র ঘন্টা চারেকের পথ। কিন্তু যাওয়া হয়নি। অতএব চলো তাজপুর।

বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তুতি পর্বে প্রথম কাজটিই হল, থাকার জায়গা নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া। ভরসা একজন চেনা ট্রাভেল এজেন্ট। তিনিই আমাদের জন্য খুব সুন্দর একটি হোমস্টে-তে তিনদিনের বুকিং করে দিল।  কলকাতা থেকে তাজপুরে গাড়ি, বাস বা ট্রেন তিনভাবেই যাওয়া যায়। সেইসব তথ্য পরে বিশদে জানাবো। বাচ্চাপার্টির হুকুমমতো ভলভোর টিকেট অনলাইনে কেটে নেওয়া হল।

নির্দিষ্ট দিনে আমরা ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে ভলভোতে চেপে রওনা দিলাম। অ্যাডভেঞ্চার তাজপুর। বাস চলতেই দেদার মজা। হোমস্টে থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা ছিল। চাউলখোলাতে নেমে আমরা গাড়িতে উঠে পড়লাম। কিছুদূর যাওয়ার পরেই চোখে পড়ল ঝাউবীথি। সমুদ্র গর্জন কানে আসতেই বাচ্চাপার্টি উত্তেজিত। তখনই তারা সমুদ্রের ধারে যাবে। বাইরে প্রচন্ড রোদ। তাদের কোনওরকমে বুঝিয়ে আমরা হোমস্টে-তে ঢুকলাম। ঠিক হলো, দুপুরের খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম করেই আমরা সমুদ্র দর্শনে যাব। সমূদ্র কাছেই। হোমস্টে থেকে হেঁটে তিন-চার মিনিট।

Img 20220617 Wa0057 Edited
ভালো থেকো ডলফিন 9

বিকেলের পড়ন্ত রোদে সমুদ্রের ধারে গিয়ে মনটা অনাবিল আনন্দে ভরে গেল। নির্জন, মনোরম পরিবেশ। আদিঅন্তহীন সৈকত রেখার একদিকে মন্দারমনি, অপর দিকে শঙ্করপুর সমুদ্র সৈকত। ভেজা বালিতে পা-রেখে আমরা হাঁটছি, দিকশূন্যপুর। বিরামহীন নরম ঢেউ পাড়ে এসে ভেঙে পড়ছে। ভিজে যাচ্ছে পায়ের পাতা আলতো নোনা জলে। পায়ের তলায় বালি সরে যাওয়ার রহস্যময় আঁকিবুকির এক অজানা অনুভূতি। আকাশপানে তাকিয়ে দেখি, বিকেলের শেষ আলোয় মেঘেদের হোলি। একটু পরে, গোধূলি তার সিঁদুর রঙা আঁচলে ঘন নীল আর ধূসর রঙ মেখে নিল। আমরা ফেরার পথ ধরলাম।

কিছুটা এগিয়ে অপার বিস্ময়ে থমকে যাই। অদূরে ধূসর বালিতট ঢেকে আছে যেন লাল কার্পেটে। সামনে গিয়ে দেখি, সার বেঁধে লাল কাঁকড়ার দল চলেছে নিজ বাসভূমে। বাচ্চাপার্টি তো দারুণ উত্তেজিত, সঙ্গে আমরাও। শহুরে মানুষের কাছে নিঃসন্দেহে এ এক বিরল দৃশ্য। পায়ের শব্দ শুনেই কোথায় যে পালালো !

তাজপুর বীচে কোনও দোকানপাট, কোলাহল নেই। নেই কোনও কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা। গুটিকয়েক ঝুপড়ি চায়ের দোকানের টিমটিমে আলোয় মায়াবী আলোআঁধারি পরিবেশ। দোকানগুলোর সামনে বালিতটে প্লাস্টিকের গোল টেবিল আর চেয়ার সাজানো। খোঁজ নিয়ে জানলাম, চা-কফি, টোস্ট-ওমলেট পাওয়া যাবে। চাইলে পাওয়া যাবে স্পেশাল কাঁকড়া ভাজা। এই দোকানগুলোতে অনেক কম খরচে রাতের খাবারও পাওয়া যায়।

Img 20220617 Wa0058 Edited
ভালো থেকো ডলফিন 10

সামনে রাতের আকাশ মিশে গেছে সমুদ্রের কালো জলে। আলোআঁধারি পরিবেশে কফি খাচ্ছি, বাচ্চাপার্টি নিয়েছে পছন্দমতো খাবার। দেখলাম, আমাদের মতো ওরাও এই নির্জনতা খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করছে। হোমস্টে-তে ফিরে এসে আমরা তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন অনেক ভোরে উঠতে হবে সূর্যোদয় দেখার জন্য। ভাবতেও পারিনি, ভোরবেলায় এমন এক অনন্য অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, যার ভালবাসায় মোড়া স্মৃতি চিরস্থায়ী বসত করবে আমাদের হৃদয়ে।

ভোর পাঁচটায় আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছি। প্রায় মন্দারমণির কাছাকাছি। পূর্বতট বঙ্গোপসাগরে সূর্যোদয় এক অপরূপ দৃশ্য। সূর্যদেব যেন সমুদ্রের গভীর তলদেশ থেকে ধীরে ধীরে উদিত হলেন। রক্তিম সোনালি সূর্যালোক ছড়িয়ে পড়ল রুপোলি বালিতটে। সেই অনির্বচনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমরা বাকরুদ্ধ। মুগ্ধ-বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি।  চোখে যেন ধাঁধা লেগে যায়। আরও কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর আচমকা আমরা দেখলাম, সমুদ্রের ধারে কিছু একটা যেন পড়ে আছে। প্রথমে কিছু বোঝা না গেলেও, কাছাকাছি যেতে মানস আবিষ্কার করল সেটি একটি বড় আকারের ডলফিন।

মানস আর বুবুই সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে শুরু করল। আমি আর গিনি ওদের পিছনে। পৌঁছে মানস পরীক্ষা করে দেখল যে ডলফিনটি তখনও বেঁচে আছে। ওকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে যে কোনও ভাবেই হোক সমুদ্রের জলে ছেড়ে দিতে হবে। ওরা দুজনে মিলে অনেক চেষ্টা করেও ১৫০-২০০ কেজি ওজনের এক ডলফিনকে সরাতে সক্ষম হলো না। এদিকে জনমানবশূন্য সমুদ্রতট।   হঠাৎ দেখা গেল দূরে একজন পর্যটক ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছেন। আমরা হাত নেড়ে তাঁকে আসার জন্য ইশারা করছি। তিনি প্রথমে বুঝতে পারেননি। পরে যখন দেখলেন আমরা সমানেই হাত নেড়ে যাচ্ছি, তখন বুঝেছেন কিছু একটা ঘটেছে। উনি ছুটে এসে ডলফিন দেখে তো স্তম্ভিত।

Img 20220617 Wa0061 Edited
ভালো থেকো ডলফিন 11

তারপর চটপট তিনজন মিলে হাত লাগালো উদ্ধার কাজে। ডলফিনের পেটের তলা থেকে বালি সরিয়ে একটু আলগা করা গেল। বুবুই ইতিমধ্যে কয়েকবার আঁজলা করে জল এনে ডলফিনকে খাইয়েছে। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে মোটামুটি হাঁটুজলে এনে ছেড়ে দিলেও, দেখা গেল ডলফিনটি ঠিক সুবিধা করতে পারছে না। তখন আবার তুলে নিয়ে ওকে কোমর জলে ফেলতেই, সে একবার পাক খেয়ে নিল। ওরা ওকে ছেড়ে দিয়ে একটু সরে যেতেই, ডলফিনটি তিনবার পাক খেয়ে একবার মাথা উঁচু করে আমাদের দিকে তাকাল। মনে হল ও যেন দূর থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালো। এর পরেই ডুব দিয়ে গভীর সমুদ্রে চলে গেল।

তাকিয়ে দেখি বুবুই-গিনির চোখে জল। মনখারাপকরা এক ভাললাগা নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। সজ্জন ক্যামেরাম্যান তমালবাবুর সাথে আমাদের সুন্দর এক বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এরপর দুটো দিন কেটে গেল সমুদ্রস্নান-ডাব খাওয়া, ডাব খাওয়া-সমুদ্রস্নানে। রোদ বাড়লে ঝুপড়ির ভিতর আশ্রয় নেওয়া। সেখানেও পর্যটকদের জন্য চেয়ারপাতা। হোমস্টে-তে ফিরে গেলে তো মজাই শেষ। ওখানে আমরা বসে ডাব বা কখনও চা-কফির সাথে টুকটাক এটা-সেটা খেতে খেতে গল্প করতাম দোকানি পরিবারের সাথে। দোকানের পিছন দিকে একটু আড়াল করে তাদের ঘরসংসার।

দুপুর গড়িয়ে এলে উত্তাল সমুদ্র। হোমস্টে-তে ফিরে এসে স্নান-খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম। সমুদ্রস্নানের ক্লান্তিতে চোখে ঘুম নেমে আসে। বিকেল হতেই বেড়িয়ে পরা। ঝাউবীথির মাঝে সরু চলার পথ ধরে কিছুটা ঘুরে বেড়ানো। দীর্ঘ বালুতটে হাসি-গল্পে মনোরম হেঁটেচলা। সন্ধেবেলা রোমাঞ্চকর কফিপান এবং দিনভর উত্তেজনাময় ডলফিনবাবুর গল্প। ছোটদের সঙ্গে, তাদের মতো করে অমূল্য তিনটি দিন কেটে গেল। ফেরার দিন গাড়িতে ওঠার আগে একবার সমুদ্রের কাছে যাবার আবদার। সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ মুখে ওরা গুডবাই জানালো, অনেক অনেক দূর-সমুদ্রে নিজের পরিবার খুঁজে পাওয়া বন্ধুটিকে।

তাজপুর সমুদ্র সৈকত পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত। সুদীর্ঘ এই সমুদ্র সৈকতের বিশেষত্ব তার নিঃশব্দ নির্জনতা। এখনও এখানে ধ্বংস হয়নি ঝাউবনের সবুজ সজীবতা। সকালবেলা যে সমুদ্র উচ্ছ্বল, বাঁধভাঙা আনন্দের সমারোহ, রাত্রিবেলা সে ভারি অচেনা, রহস্যময়। অন্ধকার গায়ে মেখে কালো জলের সাদা ফেনা আর অবিরাম সমুদ্র গর্জন। অদূরে ঝাউবন থেকে ভেসে আসা ঝোড়ো হাওয়ার গায়ে হেলে পড়া ঝাউপাতার মৃদু প্রেমালাপ। চূড়ান্ত রোমান্টিকতা। যারা নির্জনতা পছন্দ করেন, প্রকৃতিকে ভালবাসেন আর সমুদ্রের ঢেউ হৃদয়ে জমে থাকে, তাঁদের অবশ্যই একবার তাজপুর সমুদ্র সৈকতে আসতেই হবে।

Img 20220617 Wa0060 Edited
ভালো থেকো ডলফিন 15

এবার বলি, কীভাবে যাবেন তাজপুর ! তাজপুরে কোনও রেল স্টেশন নেই। নিকটবর্তী রেল স্টেশনগুলি হলো রামনগর, কাঁথি পিএইচ এবং দীঘা ফ্ল্যাগ স্টেশন। স্টেশনে নেমে তাজপুর যাওয়ার জন্য অটোরিকশা বা গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। এছাড়া ধর্মতলা, এসপ্ল্যানেড এবং গড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে তাজপুর যাওয়ার এসি, নন এসি বাস এবং ভলভো প্রত্যেকদিন নিয়মিত যাতায়াত করে। দীঘাগামী সব বাসেই তাজপুর যাওয়া যায়। বালিসাই বা চাউলখোলাতে নেমে গাড়ি ভাড়া করে নিতে হবে। হোটেল বা হোমস্টে-তে বলা থাকলে তারাও ব্যবস্থা করে দেয়। নিজেদের গাড়ি বা রিজার্ভ করেও যেতে পারেন। কলকাতা থেকে তাজপুরের দূরত্ব প্রায় ১৭২ কিমি। জাতীয় সড়ক এন এইচ ১৬ এবং এন এইচ ১১৬ বি ধরে গাড়িতে যেতে সময় লাগবে চারঘন্টার মতো।

** ছবি সৌজন্যে : তমাল দাস