ভুলব না ‘সরখেজ রোজা’ ও ‘সিদি সঈদ নি জালি’
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। প্রাচীন ভারতের হারিয়ে যাওয়া অসাম্প্রদায়িক, মানবিক বন্ধনের রূপটি আহমেদাবাদে আবিষ্কার করে আপ্লুত হয়েছিলাম। লিখেছেন অজন্তা সিনহা। তিনপর্বের ভ্রমণ রচনার তৃতীয় ও শেষ পর্ব আজ।
আধুনিক ও প্রাচীন সময়ের মধ্যে ঘোরাফেরা চলছে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখাশোনা, আড্ডা, ভোজনপর্বও চালু। এদিকে হেরিটেজ শহরের তত্ত্বতালাশ বাকি এখনও। আহমেদাবাদের উষ্ণ বাতাবরণের খবর সকলেরই জানা। রাত পোহালেই রাগী সূর্যদেব গনগনে হয়ে ওঠেন। এদিকে সময়ও আর বেশি হাতে নেই। একদিন তাই সূর্য মাথায় নিয়েই চললাম অনেকটা পুরোনো এক ইতিহাসের খোঁজে। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ঝাঁ চকচকে শহর পার হয়ে আমাদের গাড়ি ঢুকলো তুলনায় ছোট এক পরিসরে। জায়গার নাম মকরবা।
চারপাশে বেশ একটা পুরোনো আমেজ। রয়েছে বাড়িঘর ও কিছু দোকানপাট। সামান্য পায়ে হেঁটে দাঁড়ালাম আমাদের গন্তব্যের সামনে। বিস্ময়ে স্তব্ধ হতে হয়। কয়েকশো বছরের পুরোনো ইতিহাস যেন সময়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আজও দাঁড়িয়ে। আহমেদাবাদ গেলে ইতিহাস প্রসিদ্ধ ‘সরখেজ রোজা’ দেখতেই হবে আপনাকে। সুলতান আহমেদ শাহ’র রাজত্বকালে (১৪১০-১৪৪৩) সরখেজ ছিল এক শান্ত গ্রাম। শেখ আহমেদ খাট্টু গঞ্জ বক্স বলে একজন সুফি, যিনি আবার ছিলেন আহমেদ শাহ’র বন্ধু ও পরামর্শদাতা, সরখেজের শান্ত পরিবেশে মুগ্ধ হয়ে জীবনের শেষ দিকে অনেকটা সময় এখানেই বসবাস করেন। কথিত আছে, ১১১ বছর বেঁচেছিলেন এই সাধক। আপামর মানুষের শ্রদ্ধাভাজন এই সুফির স্মরণেই তৎকালীন সুলতান মহম্মদ শাহ এই সৌধ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এই স্মৃতিসৌধের ভিতরে একটি মসজিদও রয়েছে।
জুতো বাইরে খুলে ঢোকা নিয়ম। এছাড়া মাথাও আবৃত রাখতে হবে। নিয়ম মেনে প্রবেশ করলাম। পরিচ্ছন্ন বিস্তৃত প্রাঙ্গণ, কক্ষগুলি সেই প্রাঙ্গণ ঘিরে দাঁড়িয়ে। পায়রার দল ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভিতরে সংগ্রহশালা ও অফিস। মুগ্ধ হয়ে গেলাম স্থাপত্যকলা দেখে। মুসলিম, হিন্দু ও জৈন স্থাপত্যের অপরূপ মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। সেকালের আহমেদাবাদ, যেখানে একদিকে মুসলিম সুলতানদের রাজত্ব, অন্যদিকে হিন্দু ও জৈন সম্প্রদায়ের ব্যবসায়িক বাড়বাড়ন্ত। কোথাও কোনও অশান্তি নেই। সবাই একে অপরকে সমীহ করে। একে অপরের পরিপূরক হয়ে উন্নতির সোপান অতিক্রম করেছে। তৎকালীন ভারতের সেই আভাস মেলে এই সরখেজ রোজা-র ইট-কাঠ-পাথরে। রক্ষণাবেক্ষণ প্রশংসনীয়।
আধুনিক ব্যবস্থা সমন্বিত চওড়া রাস্তা ভদ্রা রোড। পথে নামী-দামি মডেলের অসংখ্য গাড়ি। ব্যস্ত, দ্রুতগতির জীবন। তারই মাঝে দাঁড়িয়ে সিদি সঈদ মসজিদ। ১৫৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত। প্রাচীনত্বের বহর সহজেই অনুমেয়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের কারণেই একেবারে ঝকঝকে। বিখ্যাত এই মসজিদ তৈরি হয় গুজরাতে সুলতান সাম্রাজ্যের শেষ দিকে। অতুলনীয় গঠনসৌকর্য। নিপুণভাবে পরিচালিত ও সংরক্ষিত। বিশাল গম্বুজাকৃতি ছাদ, পাথরের জালি সদৃশ জানালা, বড় বড় থাম। ওই জালি অর্থাৎ জানালা থেকেই এর আঞ্চলিক নামকরণ ‘সিদি সঈদ নি জালি’। সৌন্দর্য দেখলে আপনা থেকেই মাথা নত হয়। প্রচুর পর্যটকের ভিড়, তার মধ্যে ভিনদেশি মানুষও আছেন। বলা বাহুল্য, প্রত্যেকেই বিস্ময়াবিষ্ট। শহরের প্রায় প্রাণকেন্দ্র, প্রচুর ভিড় ও হট্টগোল, গাড়ি চলাচলের শব্দ। তারই মাঝে শান্ত, সমাহিত এই মসজিদ।
দেখা হয়ে ওঠেনি, কিন্তু বলার মতো কয়েকটি দ্রষ্টব্যের নাম বলব এবার। ‘অদালজ স্টেপওয়েল’ অথবা ‘রুদাবাঈ স্টেপওয়েল’–এটি তৈরি হয় ১৪৯৮ সালে। গ্রামের নাম অদালজ। সেই নামেই এই সৌধের নাম। বিখ্যাত বাঘেলা বংশের রানা বীর সিং-এর স্মৃতিতে এই সৌধ তৈরি করেন তাঁর স্ত্রী রানী রুদাদেবী। ভারতীয় স্থাপত্যের বর্ণময় প্রভাব এখানেও লক্ষ্য করা যায়। মণিনগর অঞ্চলে আছে ‘কানকারিয়া লেক’। এর সৌন্দর্যের বর্ণনা শুনে, না দেখার আক্ষেপ জোরালো হলো। ১৪৫১ সালে সুলতান দ্বিতীয় কুতুবউদ্দিন আহমেদ শাহ’র সময়ে তৈরি এই বিশাল হ্রদ। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে আকর্ষণীয় আরও কিছু উপকরণ হাজির এখানে। রয়েছে চিড়িয়াখানা, টয় ট্রেন, কিডস সিটি ইত্যাদি।
এছাড়াও বলতে হবে ‘জামি মসজিদ’-এর কথা। এর প্রতিষ্ঠা ১৪২৪-এ সুলতান প্রথম আহমেদ শাহ’র সময়ে। এরই সঙ্গে বলব ‘ভদ্রা ফোর্ট’-এর নাম। প্রতিষ্ঠার সময়কাল ১৪১১। ফোর্ট অর্থাৎ দুর্গের ঠিক বাইরে অবস্থিত মসজিদ। ভদ্রা ফোর্টের পূব দিকে অবস্থিত ঐতিহাসিক প্রবেশপথ ‘তিন দরওয়াজা’। এইরকম মোট ১২টি দরওয়াজা আছে পুরো আহমেদাবাদ জুড়ে। প্রতিটিই ইতিহাসের সাক্ষী। প্রত্যেকটি নির্মাণের পৃথক পৃথক গল্প রয়েছে। ১৪১১ সাল থেকে এগুলির নির্মাণ শুরু, তৈরি হয় বিভিন্ন সুলতানের আমলে। কালের অঙ্গুলিহেলনে এই প্রবেশপথগুলিও আর আগের চেহারায় নেই, স্বাভাবিক। প্রাচীনতা শরীর জুড়ে। তবে, দ্রষ্টব্য আজও।
১৮৪৮ সালে তৈরি ‘হাথিসিং জৈন মন্দির’। তখনকার দিনে ৮ লক্ষ টাকা খরচ হয় এর নির্মাণে। ধনী ব্যবসায়ী হাথিসিং কেশরীসিং এর নির্মাণ শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি। তাঁর অকালমৃত্যুর পর স্বামীর আরাধ্য কাজ শেষ করেন স্ত্রী হরকুনভর। স্থাপত্য সৌন্দর্যের ছাপ এই মন্দিরেও। ‘দ্য ক্যালিকো মিউজিয়াম অফ টেক্সটাইলস’ তৈরি হয়েছে ১৯৪৯-এ। ঐতিহাসিক মূল্য অসীম। গুজরাতের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ তাঁতশিল্পের ধারাবাহিকতা খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষিত এখানে। এই মিউজিয়াম দেখলে বোঝা যাবে, একদা তাঁতশিল্পকে ঘিরে এই অঞ্চলের বাণিজ্য ও অর্থনীতি কতদূর প্রসারিত ছিল!
ভৌগোলিক কারণ হোক বা অঞ্চলের সংস্কৃতি, বাণিজ্যক্ষেত্রে সেই ইতিহাসের কাল থেকেই স্বতন্ত্র এই শহর। বিভিন্ন সময়ে ভিন দেশি শাসকরা পা রেখেছেন আহমেদাবাদে। ‘দিবে আর নিবে’-র মাঝেই নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এখানকার মানুষ। একই সঙ্গে ইতিহাসকেও রক্ষা করছেন শ্রদ্ধার সঙ্গে। সেই ইতিহাসে ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মেলবন্ধনটা অত্যন্ত দৃঢ়। মুসলিম শাসকদের প্রতিষ্ঠিত সৌধ, মসজিদে অপূর্ব সমন্বয়ে এসেছে হিন্দু ও জৈন শিল্পসৌকর্য। প্রাচীন ভারতের এই মানবিক বন্ধনের রূপটি আহমেদাবাদে যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম। আজকের দিনে, যখন চারপাশে কেমন এক অচেনা বিচ্ছিন্নতাবাদের সুর, তখন আহমেদাবাদ এসে, নিজের চেনা দেশকে খুঁজে পেয়ে অনেকটাই শান্তি ও তৃপ্তি পাওয়া গেল।