Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

মন্দির কেল্লা ও লস্যি

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। ইতিহাস প্রসিদ্ধ লখনউ-এলাহাবাদ-বেনারস ঘিরে চলছে এই ভ্রমণ ধারাবাহিক। লিখছেন লিপি চক্রবর্তী। আজ চতুর্থ পর্ব।

বারাণসীবাসের তৃতীয় দিন সকালে রামনগর অভিমুখে যাত্রা শুরু। বেড়াতে বেরিয়ে যাতে সংকটে না পড়ি, তার ব্যবস্থা করতে হবে তো ! আমাদের যাতায়াতের বাহন অটোচালক ভাই যেন সেই অনুষঙ্গেই আমাদের প্রথমেই নিয়ে গেল সঙ্কটমোচন হনুমান মন্দিরে। এখানে বলে রাখি, বারাণসীর কোনও মন্দিরে ক্যামেরা, মোবাইল এমনকী কাঁধের ‘অল পারপাস’ ঝোলাটি পর্যন্ত নিয়ে ঢোকা মানা। মন্দির চত্বরের থেকে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে কোনও পূজা উপাচারের দোকানে সেসব জমা রেখে, যেতে হয় দেবদর্শনে। 

সঙ্কটমোচন হনুমান মন্দিরে পুজো দিয়ে আমরা চললাম রামনগর ফোর্টের দিকে। বারাণসী থেকে এই ফোর্টের দূরত্ব মাত্র ১৪ কিলোমিটার। এটি হলো কাশীর মহারাজার বাসস্থান। ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন কাশীর মহারাজা বলওয়ান সিং এই কেল্লাটি বানিয়েছিলেন। আকারে বিশাল নয়, কিন্তু অপূর্ব সুন্দর। মেটাল ডিটেক্টর প্যাঁ পোঁ ইত্যাদি শব্দে আমাদের গ্রহণ করলে, আমরা কেল্লার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম। এখানে রয়েছে একটি বিশাল প্রদর্শশালা। এটি সরস্বতী ভবন নামে পরিচিত। কী নেই সেই সংগ্রহশালায় !  রাজাদের ব্যবহার করা সেই কোন পুরোনো দিনের গাড়ি, পাল্কি–বস্ত্র আর অস্ত্র যে কত রকমের, দেখে একদিনে শেষ করা মুশকিল !

এই কেল্লাতে এখনও কাশীর মহারাজের পরিবার বসবাস করেন। সেই অংশে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। বিশাল কোর্ট ইয়ার্ড পেরিয়ে প্রদর্শশালার উল্টোদিকে উঁচু উঁচু সিঁড়ির ধাপ নেমে গিয়েছে গঙ্গার ধার পর্যন্ত। কেল্লার ভিতরে রয়েছে বেদব্যাস মন্দির। এই রামনগর ফোর্টকে ঘিরেই রামলীলা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। রাজবাড়ির সদস্যরাও সেই উৎসবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে অংশ নেন। রামলীলা অভিনীত হয় সারা রামনগর জুড়ে বিভিন্ন মঞ্চে, শেষ হয় এসে রামনগর ফোর্টে। এটা অবশ্য আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়নি। উৎসব দেখতে হলে, ক্যালেন্ডারে নির্দিষ্ট তারিখ দেখে বেড়ানোর পরিকল্পনা করতে হবে। আমাদের পর্যটন ভাবনা যেহেতু একটু অন্য পথে চলে, তাই কোনও একটি বিশেষ ধর্মীয় উৎসবকে উপলক্ষ করে পরিকল্পনা করা মুশকিল।

Img 20230508 Wa0014
মন্দির কেল্লা ও লস্যি 14

রামনগরে এসেছি আর লস্যি খাব না তাই আবার হয় নাকি? আহা অমৃতের স্বাদ সেই শীতল তক্রের। বিকেলে বারাণসীতে ফিরে আবার দৌড় দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে, আরতির অপার্থিব স্বাদ নিতে। এরপর আরও দুটো দিন থাকা আমাদের বারাণসীতে। পরের দিনের গন্তব্য চুনার কেল্লা ও বিন্ধ্যাচল। বারাণসী থেকে দূরত্ব ৪২ কিলোমিটার। চুনার কেল্লায় পৌঁছনোর আগে পথে পড়ল বিন্ধ্যাবাসিনী মন্দির। পুরানকথা অনুসারে মহিষাসুর বধের পর এখানেই দেবী দুর্গা প্রকট হয়েছিলেন। পরে শুম্ভ-নিশুম্ভকেও এখানেই বধ করেন। 

পার্কিং লটে গাড়ি রেখে আমরা ঠিক করলাম দেবীকে দর্শন করে চলে আসব। গোল বাঁধল অন্য জায়গায়। পুজোর ডালি না নিলে গাড়ি রাখতে দেবে না। চালকও অন্যত্র রাখার চেষ্টা করবে না। তারও ইচ্ছে পুজোর ডালি নিতেই হবে। যাই হোক, বাধ্য হয়েই একপ্রকার, পুজোর ডালি নিয়ে মন্দিরের দিকে রওনা হলাম। জুতো রাখার জায়গায় চুনরি কিনতে হল, নয়তো জুতো রাখতে দেবে না, টাকা দিলেও না। যাকে বলে, জোর করে ভক্তিমার্গে মাথা ঠেকানো। একটা অসম্ভব ভিড় ঠেলে কোনও রকমে মন্দিরের ভিতরে যাওয়ার পর দু সেকেন্ডও দাঁড়াতে দিল না দেবীর রক্ষকরা, ৫০১ টাকা দক্ষিণা দেওয়ার ইচ্ছে আমাদের নেই বলে। এমনকী পুজোর ডালির প্রসাদটিও ফেরত দিচ্ছিল না। বলে-কয়ে সেটি হস্তগত হলো। মা দুর্গার এখানে রূপ কেমন বলতে পারব না। হাজার হাজার টাকা হাতের মুঠোয় নিয়ে মন্দিরে ঢুকলে হয়তো বুঝতে পারতাম।

এখান থেকে কিছু দূরত্বে পাহাড়ের ওপর সীতাকুণ্ড, অষ্টভুজির মন্দির। যাওয়ার রাস্তাটি বড়ই মনোরম। সেই রূপ দেখতে দেখতে, পাহাড়ের ওপর উঠে মনটা হঠাৎ করেই ভালো হয়ে গেল। আগের তিক্ততার প্রভাবমুক্ত হলাম প্রকৃতির অমল স্পর্শে। রামচন্দ্রের বনবাসকালে অরণ্যের পথ দিয়ে চলার সময় সীতাদেবীর খুব তেষ্টা পায়। কিন্তু কাছেপিঠে কোথায় একবিন্দু জল নেই। লক্ষ্মণ তখন পাহাড়ের গায়ে তির ছুঁড়ে মারেন। সৃষ্টি হয় এক সুন্দর ঝরনার। জলপানে তৃপ্ত হন সীতা। তাই এর নাম সীতাকুণ্ড। (চলবে)

ছবি : লেখক