Monday, February 3, 2025
কৃষ্টি-Culture

হারানো দিনের গানের গল্প… 

চল্লিশ পেরিয়ে আসা বাঙালি এখনও স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ে পুরনো বাংলাগান শুনে। সেইসব গানের গল্পই এই বিশেষ ধারাবাহিক প্রতিবেদনে। আজ দ্বিতীয় পর্ব। লিখছেন প্রদীপ্ত চৌধুরী

জীবনের প্রতি কোণে, যাপনের প্রতি স্তরে কথা-সুরের আলপনা আঁকা হয়। মাঝি দাঁড় বেয়ে চলে গানের সুরে। শ্রমিক হাতুড়ির ঘা মারে গান গাইতে গাইতে। আবার অন্ধ কানাইয়ের ভিক্ষার হাতিয়ারও সেই গান। আর কে না জানে, বাংলা গানের মানচিত্রে প্রথাগত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি সমান গুরুত্বে স্থান পেয়েছে লোকায়ত জীবনের এহেন কথা ও সুর। এক একজন দিকপাল স্রষ্টা রেখে গিয়েছেন অমর সৃষ্টির সম্ভার। কেউ হেঁটেছেন প্রচলিত পথে, কেউ মেতেছেন চূড়ান্ত পরীক্ষানিরীক্ষায়! ইতিহাস স্থান দিয়েছে সকলকেই। 

‘মায়ামৃগ’ ছবিতে সুর করেছিলেন মানবেন্দ্র। সে ছবির গানও আজ ইতিহাস। মানবেন্দ্ররই গাওয়া একটা গান ছিল তাতে… ‘মেটেরিয়া মেডিকার কাব্য’। গানটায় বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন গীতিকার শ্যামল গুপ্ত। ফার্মাকোলজি, ডিসেকশন, প্রেসক্রিপশন…এইরকম কিছু বিজাতীয় শব্দ। এক সন্ধ্যায় গানটায় সুর করতে বসে মানবেন্দ্র খুব রেগে গিয়েছিলেন। গুচ্ছ ইংরেজি শব্দ দেখে বিরক্ত হয়ে গান-লেখা কাগজটা দলা পাকিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছিলেন। শ্যামল তাতে হতাশ হয়ে পড়ায় কিছুক্ষণ বাদে একটা টর্চ নিয়ে দু’জনে মিলে সেই কাগজটা আবার খুঁজতে বের হলেন। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে সেটা পাওয়া গেল একটা ড্রেনের মধ্যে। কী ভাগ্য, জলের তোড়ে তখনও ভেসে যায়নি। আজ প্রায় ৬০ বছর পরেও সেই গান সমান জনপ্রিয়। কালস্রোতে ভেসে যায়নি সে গান। 

কত ব্যক্তিগত অনুষঙ্গই যে জড়িয়ে যায় গানের জন্মের সঙ্গে। কলকাতায় সেবার বইমেলার আসর বসেছে প্রথম। গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় গেছেন সেই মেলায়। হঠাৎই দেখা হয়ে গেল কলেজ জীবনের এক পুরনো বান্ধবীর সঙ্গে। বান্ধবীটি তখন প্রায় চল্লিশের চৌকাঠে। সঙ্গে রয়েছে তাঁর অল্পবয়সি ছেলে। পুরনো বন্ধুকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে তিনিও দারুণ খুশি। এরপর চা খেতে খেতে দু’জনেই মেতে গেলেন ফেলে আসা দিনের গল্পগাছায়। চমৎকার কেটে গেল অনেকটা সময়। সেদিন রাতেই গান লিখে ফেললেন শিবদাস। ‘ভালো করে তুমি চেয়ে দেখ / দেখ তো চিনতে পার কি না…’। ভূপেন হাজারিকার সুরে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল লতার গাওয়া সেই গান।

Images4
হারানো দিনের গানের গল্প…  9

নিছক ব্যক্তিগত ঘটনার প্রভাব গানের খাতায় উঠে আসায় তা সর্বজনীন হয়ে গেছে, এমন ঘটনা আরও বেশ কয়েকবার ঘটেছে। সুরকার (কিছু গানের গীতিকারও) অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন গভীর প্রেমে জড়িয়ে পড়েছেন তাঁর এক ছাত্রীর সঙ্গে। একদিন বিকেলে কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় তাঁদের দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, ছাত্রীটি সেদিন আসতে পারেননি। তখন তো আর মোবাইলের যুগ নয়। কেন তিনি আসেননি বা ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারেননি, অভিজিৎবাবুর পক্ষে তা জানা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় খুব হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। সেদিনই রাতে সেই হতাশা প্রতিফলিত হয় তাঁর নিজের লেখা একটি গানে, যেটি গেয়েছিলেন সুবীর সেন। অতি পরিচিত এই গানটি হল ‘সারাদিন তোমায় ভেবে হল না আমার কোনও কাজ’। এই সম্পর্ক এবং তার টানাপোড়েন অভিজিৎবাবুকে দিয়ে আরও বেশ কিছু মনে রাখার মতো গান আদায় করে নিয়েছে। যেমন, ‘সবাই চলে গেছে’ বা ‘এমন একটা ঝড় উঠুক’ ইত্যাদি।

Images 33 1
হারানো দিনের গানের গল্প…  10

‘মায়ামৃগ’ ছবির আর একটি গান ‘বকম বকম পায়রা’, গেয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সুরের দিক থেকে গানের শুরুটা কিছুতেই পছন্দ হচ্ছিল না সুরকার মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের। ভাবছিলেন শুরুর আগে আরেকটা শুরু থাকলে ভালো হয়। সেই সময় একদিন বন্ধু কমেডিয়ান শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে কী একটা কাজে গিয়েছিলেন মানবেন্দ্র। বহু পুরনো বাড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শুনতে পেলেন, ওপরের ঘুলঘুলি থেকে নাগাড়ে ভেসে আসছে পায়রার বকম বকম শব্দ। খুব মনোযোগ দিয়ে শব্দটা তিনি শুনলেন। বেশ কিছুক্ষণ। তারপর বাড়ি ফিরে গানটা নিয়ে বসলেন। গানের শুরুটা নিয়ে একটা খচখচানি ছিল। এবার সেটা কেটে গেছে। শুরুর ‘বকম বকম’ শব্দ দুটোর আগে নিজেই যোগ করে নিলেন ‘ও বক বক বক বক’ শব্দগুলি। একটা অন্যরকম মাত্রা পেল মুখরাটা। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের দুরন্ত গায়কিতে সেটা আরও প্রাণ পেল।        (চলবে)